বিভূতি সিকদার ||

বেশ ছোটোবেলায় গুলতি দিয়ে একটা পাখি মেরেছিলাম, কেননা বন্ধুদের তাই করতে দেখতাম! আমাদের কাছে সেটা ছিলো নিছক ক্রীড়া-কৌতুক, আর যার প্রাণ গেলো, তার কেমন লেগেছিলো? আহা! তারপর একদিন সেই দুঃখে, না ঠিক দুঃখ নয়, ভয়াবহ এক আত্মগ্লানি ও যন্ত্রণায় কেঁদেছিলাম! সেই পাখি ও পৃথিবীর কাছে আমি নতজানু হয়ে ক্ষমাপ্রার্থী। প্রাণীদের জীবনের জন্য এক অদ্ভুত মর্মানুভূতি কাজ করতে থাকে! তাই এখনো ঘৃণা হয় নিজের উপর! আমার যদি বেঁচে থাকার ও পূর্ণভাবে বিকাশের অধিকার থাকে, তবে তার/তাদের কেন নেই? শুধু আমিই তাকে বুদ্ধির জোরে মেরেকেটে নিজের উদরপূর্তি করবো সাথে থাকবে শারীরিক-ধর্মীয়-বিবর্তনগত নানান যুক্তির সৈন্যবাহিনী, এটাকে ভণ্ডামি বলে মনে হয়! পশুদের উপর কী ভয়াবহ নির্যাতন করা হয়, বিভিন্ন ডকুমেন্টারিতে তা বিশদে দেখানো হয়েছে, যা ইউটিউবে পাওয়া যায়! ব্যাপারটি প্রথমত নৈতিক, মানবিক ও আধ্যাত্মিক; একান্তই আমার নিজস্ব বিশ্বাস পদ্ধতি!

কেন সচেতনভাবে প্রাণী হত্যা করে মানুষ? নিশ্চয়ই কোন না কোন উদ্দেশ্য, লোভ বা স্বার্থ থাকে পেছনে! কিন্তু আর একটা প্রাণীকে শুধুমাত্র আমার জিহ্বার লোভাতুর লালসা উদযাপনে রসদ দেবার জন্য "প্রাণীজ আমিষের আপাত বৈধ দোহাই দিয়ে" হত্যা করবো-- সেটা একদিন থেকে আর মানতে পারলাম না! নিজের ভেতরটা গুঁড়িয়ে দিলো একটা চিন্তা! ভেতরে ভাংচুর হলো ভীষণ! মায়া লাগলো বড্ড! ইতিহাস পরিক্রমায় পৃথিবীর মহামনীষীদের একটা অংশ এই সহমর্মিতায় বিশ্বাস করতেন! বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানী বা ডাক্তারদের একটা শ্রেণিও কিন্তু মাংস খাওয়ার চরম অপকারিতা সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত-প্রমাণ (Data-Fact-Evidence) দিয়েছেন; কিন্তু আবার সেই সঙ্গে একটা বড় শ্রেণি এর বিরুদ্ধেও বলছেন! শেষ পর্যন্ত জিতে যায় রসনা বিলাসের বাসনা, বহুদিনের ভোগবাদী মনস্তত্ব, ও পঁজিবাদী মাংস শিল্পমহল (Capitalist meat industries).

প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের (Natural sciences) চিরায়ত পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ার আস্থা আছে আমার; আমার গভীর আস্থা আছে "DATA-FACT-EVIDENCE" ভিত্তিক সেই বিজ্ঞানে, যা কেবলমাত্র বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে লাভজনক প্রযুক্তি উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয় না বরং সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সত্য আবিষ্কার যার একমাত্র লক্ষ্য; যখন থেকে Global Heating, Climate Crisis, Global Environmental Policies, Sustainable Development পড়তে ও পড়াতে শুরু করলাম, তখন নতুন করে আর একবার পাল্টে গ্যালো চিন্তা-ভাবনার দিকদর্শন ও রূপরেখা! এবং সেটা স্থায়ীভাবে! একটা গাছ আসলে কতোটা দরকারী, কেন একটা গাছকে আমরা অকারণে খুন করতে পারিনা, কী এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বৃক্ষহীন পৃথিবী সেগুলো আমাকে ভাবিয়েছিলো ভীষণ রকম! হাজার বিজ্ঞানীর হাজার গবেষণা আমাদেরকে প্রতিনিয়ত সতর্ক করছে "Climate Crisis" নিয়ে, নতুবা এক অকল্পনীয় ধ্বংসাত্মক ভবিতব্যে পা বাড়াতে পারে মানব সভ্যতা!

বর্তমান পৃথিবীর গভীরতম সমস্যার একটি হলো "বৈশ্বিক তাপায়ন" বা "Global Heating" (NOT "global warming" anymore) ও "জলবায়ু সমস্যা" বা "Climate Crisis". ভয়ঙ্কর লোভী আধুনিক মানুষেরা তাদের নিজেদের কাম ও লোভ চরিতার্থ করবার লক্ষ্যে গত প্রায় ৩০০ বছর ধরে নির্বিচারে কয়লা-তেল-গ্যাস পুড়িয়ে বিলিয়ন বিলিয়ন টন গ্রিনহউস গ্যাস বাতাসে নিঃসরণ করেছে! সেই কারণেই মূলত এই জলবায়ু সমস্যা তৈরি হয়েছে! জাতিসংঘের Intergovernmental Panel on Climate Change (IPCC) এর ২০১৯ সালে প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুযায়ী "Global Meat industry" এবং "Individual meat consumption" জলবায়ু সমস্যার ক্ষেত্রে খুবই ঋণাত্মক ভূমিকা পালন করছে! যে মাংস আস্বাদিত হবার জন্য আমাদের প্লেটে আসছে অনেকভাবে প্রক্রিয়াজাত হবার পর, তার "Carbon footprint" অভাবনীয় রকম বেশি! আমি জেনেশুনে কী করে একজন জলবায়ু সচেতন মানুষ হিসাবে আরও বেশি করে নিজের "Carbon footprint" বাড়াই? নিজের বিবেকের কাছে আটকে যাই! আমার রসনা বিলাস যখন পুরো পৃথিবীর আসন্ন দুর্গতিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে, সেই সমস্ত কাজ আমি অন্তত করতে পারি না! সেই সঙ্গে যেসব কারণে আমার "Carbon footprint" বাড়তে পারে যেমন সিএফসি (CFC) নির্গমনকারী ফ্রিজ, এয়ার কন্ডিশনার, প্লেন ফ্লাইট ইত্যাদি আমি সর্বোচ্চ হারে বন্ধ করে দিয়েছি! একদম স্বেচ্ছায়। পুরো পৃথিবীতে এখন মানুষ সচেতনভাবে "Vegetarianism & Veganism" কে তাদের জীবনপদ্ধতি হিসাবে গ্রহণ করছে, এটা এখন একটা "Growing movement".

যদি এই লেখা আপনার চিন্তার খোরাক হয়ে ওঠে, আপনার ভাবনার দিগন্তে করাঘাত করে-- ভাল্লাগবে আমার! আপনি গভীরভাবে ভাবুন, বারবার ভাবুন, তারপর নিজেই সিদ্ধান্ত নিন কী করা উচিৎ! নিজের লোভকে জয় করা উচিৎ, যা আত্মিক উৎকর্ষের সঙ্গে সম্পর্কিত! আপনার বিবেক, শুভবুদ্ধি, আর মনুষ্যত্বের উপর নির্ভর করবে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক অনেক বিষয়! এটি একটি যুদ্ধ, যেখানে ধীরে ধীরে শক্তিশালী হচ্ছে সৈন্য সংখ্যা; এ সম্পর্কিত অঢেল বৈজ্ঞানিক গবেষণা এখন অনলাইনে বিনামূল্যে পাওয়া যাচ্ছে; আপনি শুধু খুঁজে দেখুন, পড়ুন, এবং বাস্তবায়িত করুন। এবং সমাজের বৃহৎ পরিবর্তন এক একজন করেই হয়ে থাকে! আমার কাজ আপনাকে মহত্বে অনুপ্রাণিত করা!

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। বাংলাদেশ দর্পণ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।]