নড়াইলের কালিয়ায় করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে এক ব্যক্তির মৃত্যুর পর স্বজনরা ‘অসহযোগিতা করেছে’ বলে প্রকাশিত খবরের নিন্দা জানিয়েছেন ওই পরিবারের একজন।

‘স্বজনেরা এগিয়ে না আসায় মৃত ব্যক্তির সৎকার করলেন ইউএনও’, ‘করোনা সন্দেহে বাবার মুখাগ্নি করতে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলের অস্বীকৃতি!’- এ ধরনের ‘চটকদার’ শিরোনামে মানুষ সহজেই প্রলুব্ধ হয়ে তাদের নিয়ে যাচ্ছেতাই মন্তব্য করছে বলে জানিয়েছেন প্রবীর রায় নামে প্রয়াতের একজন ভাতিজা।

বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর নড়াইলের বড়দিয়া শাখার সাধারণ সম্পাদক প্রবীর মঙ্গলবার (১২ মে) বলেন, দৈনিক প্রথম আলো ও কালের কণ্ঠ ওই দুই শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করেছে। আরও অনেক সংবাদমাধ্যম এ ধরনের খবর প্রকাশ করেছে।

“প্রথম আলো ও কালের কণ্ঠের প্রতিবেদকরা ঘটনাস্থলে আসেননি। আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, কিন্তু আমাদের পরিবারের কারো সঙ্গে কথাও বলেননি। এভাবে সংবাদ প্রকাশ করা তো সাংবাদিকতার নীতিমালার বাইরে।”

প্রবীর জানান, তার চাচা বিশ্বজিৎ রায় চৌধুরী (৫০) ঢাকায় একটি সিকিউরিটি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। গত বৃহস্পতিবার তিনি বড়দিয়ায় বাড়িতে ফেরার পর তার কাশি শুরু হয়। এর আগেও তার কাশির সমস্যা ছিল। করোনাভাইরাসের উপসর্গ বলে সন্দেহ হওয়ায় তাদের একজন চিকিৎসক বোন কাকাকে আলাদা ঘরে থাকার পরামর্শ দেন। গত রবিবার সকালে কালিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে চিকিৎসক এসে তার নমুনা সংগ্রহের কথা ছিল। কিন্তু সকালে চাচী গিয়ে ঘরে তাকে মৃত অবস্থায় দেখতে পান।

করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে কেউ মারা গেলে প্রশাসনকে জানানো এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে তার সৎকারের বিষয়ে জানা থাকায় তার মৃত্যুর খবর কালিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নাজমুল হুদাকে ফোনে জানানো হয়। পরে তিনি চিকিৎসক ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের নিয়ে আসেন। নমুনা সংগ্রহের পর ইউএনও’র তত্ত্বাবধানেই চাচার মরদেহ শ্মশানে নিয়ে সৎকার করা হয়।

“সেখানে পরিবারের পক্ষ থেকে আমি, যে চাচা মারা গেছেন তার ছেলে দীপ রায়, আরেক চাচাত ভাই স্নেহাশিস রায় এবং আমাদের আত্মীয় অঙ্কিত বিশ্বাস অংশ নিই।

“পত্রিকাগুলোর রিপোর্টের সঙ্গে যে ছবি প্রকাশ করা হয়েছে, সেখানে পিপিই পরা চারজনকে দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে একজন দীপ রায় (প্রয়াতের ছেলে), আরেকজন অঙ্কিত বিশ্বাস (প্রয়াতের আত্মীয়)।”

ইউএনও নাজমুল হুদাও পিপিই পরে মরদেহ নিয়ে যাওয়া ও সৎকারে অংশ নিয়েছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, “সনাতন ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী প্রয়াতের ছেলে দীপ বাবার মুখাগ্নি করে। আধা ঘণ্টাখানেক পর ইউএনওসহ অন্যরা চলে গেলেও আমরা শব পোড়ার পুরোটা সময় (প্রায় ৫ ঘণ্টা) সেখানে ছিলাম। সব কিছু শেষ হওয়ার পর শ্মশান থেকে ফিরে আসি।”

সেখানে স্বজনরা ‘পালিয়েছে’ বা ‘কেউ এগিয়ে আসেনি’- এ ধরনের খবর প্রকাশে পরিবারের সদস্যদের চরমভাবে হেয়প্রতিপন্ন হতে হচ্ছে বলে জানান প্রবীর।

এরপর যে কারও ক্ষেত্রেই সত্য যাচাই ছাড়া এ ধরনের খবর প্রকাশ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “এ রকম একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর রিপোর্ট প্রকাশের ফলে সমাজে কী প্রভাব পড়ে, অভিযুক্তের ওপর দিয়ে কী ধরনের মানসিক ঝড় বয়ে যায়, সেটা উপলব্ধি করার অনুরোধ জানাই। এই রিপোর্টের সঙ্গে একটি পরিবার, একটি অঞ্চল ও একটি কমিউনিটির সম্মান-মর্যাদা গভীরভাবে যুক্ত। মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর রিপোর্ট সম্পর্কে সতর্ক থাকার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানাই।”

তার এই বক্তব্য এবং ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে ইউএনও নাজমুল হুদা বলেন, “প্রথমে তারা সবাই ভীত-সন্ত্রস্ত ছিল। তবে সৎকারের সময় প্রয়াতের ছেলে এবং তাদের বংশের একজন ছিল।”

প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ছেলে প্রথমে শ্মশানে আসেননি। এক পর্যায়ে ইউএনও ফোন করে শাসানোর পরে তিনি এসেছিলেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাজমুল হুদা বলেন, “না, মরদেহ বাড়ি থেকে বের করার সময় থেকেই তারা সঙ্গে ছিল। তবে ছেলে মরদেহ ধরেনি। আমি, স্থানীয় সাংবাদিক ফসিয়ার রহমান, ভ্যানচালক এবং কালিয়া থেকে নিয়ে যাওয়া পেশাদার সৎকারকারী মন্টু বৈরাগী মরদেহ ধরে উঠানো-নামানো করেছি।”

তাহলে খবর কি অতিরঞ্জিত করা হয়েছে- প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “হ্যাঁ, তা কিছুটা হয়েছে। তবে মৃত ব্যক্তির পরিবারের লোকজন প্রথম দিকে আমাদের তেমন সহযোগিতা করেননি।”

এই বিষয়ে প্রকাশিত সংবাদ নিয়ে আপত্তি ও পুরো ঘটনা তুলে ধরে ফেইসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন প্রবীর রায়।

তিনি লিখেছেন, “প্রিয়জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত মিথ্যা রিপোর্টের জন্য আমাদের পরিবারকে হেয়-প্রতিপন্ন হতে হচ্ছে। আমাদের পরিবারের একজন হয়ে আমাদের মানসিক যন্ত্রণার বিষয়টি উপলব্ধি করার জন্য সকলের প্রতি বিশেষ অনুরোধ জানাই। আমার ছোট ভাই (প্রয়াতের ছেলে) দীপ রায়কে কেউ কেউ ‘কুলাঙ্গার’ বলেও গালি দিচ্ছেন। কিন্তু তার কী অপরাধ? এই গালি কি তার প্রাপ্য?

আমার ছোট ভাই দীপ ও আমাদের পরিবার অপরাধ না করেও তাদের কাছে অপরাধী থেকে যাব! আমার বক্তব্য সবাই যে বিশ্বাস করবেন, সে আশা করি না। কেউ কেউ ভাবতে পারেন, পত্রিকায় যেহেতু এসেছে কিছুটা তো সত্য! এখন নিজেদের বাঁচানোর জন্য এসব আত্মরক্ষামূলক কথা আমি বলছি। এমন যদি কেউ ভেবে থাকেন, তাকে শুধু অনুরোধ করব প্রকৃত সত্য জানার জন্য প্রয়োজনীয় খোঁজ-খবর নিন।