কিশোরগঞ্জ : কিশোরগঞ্জ জেলার হাওর উপজেলা অষ্টগ্রামে অবস্থিত প্রত্নতত্ত্বের এক অপূর্ব নিদর্শন কুতুবশাহ মসজিদ। মসজিদটিতে মুঘল ও সুলতানি আমলের স্পর্শ পাওয়া যায়।

কারও মতে, সুলতানি আমলের শেষদিকে এটি নির্মিত। পরবর্তী সময়ে মোঘল সংস্কারের প্রলেপ পড়েছে আদি কাঠামোতে। কেউবা এটিকে পুরোপুরি মুঘল আমলেরই স্থাপনা মনে করেন। সিলেট থেকে আসা বিখ্যাত দরবেশ কুতুব শাহ এই মসজিদ নির্মাণ করেন বলে জনশ্রুতি প্রচলিত। তাই এটি কুতুবশাহ মসজিদ নামে পরিচিত।

মসজিদটির কাঠামো আয়তাকার। উত্তর-দক্ষিণে ১৪ মিটার ও পূর্ব-পশ্চিমে আট মিটার দীর্ঘ। ছাদ জুড়ে পাঁচটি গম্বুজ। মাঝেরটি তুলনামূলক বড়। কার্নিশগুলো বাংলার চৌচালা ঘরের চেয়েও অধিক বাঁকা। পূর্ব ও পশ্চিমের দেয়াল প্রায় দেড় মিটার, উত্তর ও দক্ষিণের দেয়াল প্রায় সোয়া এক মিটার প্রশস্ত। পশ্চিম দেয়ালের ভেতরের দিকে তিনটি মিহরাব।

বাইরের দেয়ালে পোড়ামাটির চিত্রফলকের অলঙ্করণ, প্যানেলের কারুকাজ। চারটি কোণে আট কোণা মিনার বা ট্যারেট। বলয়াকারের স্ফীতরেখায় অলঙ্কৃত। পূর্ব দেয়ালে তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে দুটি করে মোট সাতটি প্রবেশপথ। প্রতিটিতেই অর্ধ বৃত্তাকার খিলান। 

 

মসজিদের দক্ষিণে একসারিতে পাঁচটি পাকা কবর। অনুচ্চ বেদীর ওপরে নির্মিত। কবরের দেয়ালে ক্ষয়ে যেতে যেতে পোড়ামাটির কিছু অলঙ্করণ। যা পাঁচ পীরের মাজার বলেও পরিচিত। 

 

মসজিদটির শিলালিপি হারিয়ে যাওয়ায় মসজিদ নির্মাণের সাল নিশ্চিত হওয়া যায় নি। তবে সেই ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দেই এটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণা করা হয়েছে।

 

‘গ্লিমসেস অব ঢাকা’ গ্রন্থে সৈয়দ মোহাম্মদ তৈফুর লিখেছেন, ঈশা খাঁ’র সঙ্গে যুদ্ধে জিতে ১৫৭৬ থেকে ১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মোঘলরা অষ্টগ্রামে থাকে। 'অষ্টগ্রামের ইতিহাস’ গ্রন্থে আবুল কাসেম মনে করেন, ওই সময়েই গড়ে তোলা হয় মসজিদটি।

 

‘বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ’ গ্রন্থে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া মসজিদটি মুঘল আমলের প্রথম দিকে নির্মিত বলে অনুমান করেছেন। তার মতে, পাঠান রাজত্বের শেষ দিকে ঈশা খাঁর মসনদ-ই-আলা ১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই অঞ্চলের শাসক ছিলেন। এখানে মুঘল অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় সুবেদার ইসলাম খানের আমলে, ১৬১২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। তাই মোঘল অধিকারের পরে যদি এটি নির্মিত হয়ে থাকে তাহলে তা সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয় দশকের আগে হতে পারে না। আর যদি ঈশা খাঁর আমলে এই মসজিদ নির্মিত হয়ে থাকে তবে তা ষোড়শ শতকের শেষ দশকে হতে পারে।

তবে মুঘল বিদ্বেষী হওয়ায় বারো ভূঁইয়া নেতা ঈসা খাঁর আমলে নির্মিত মসজিদে এত বেশি মুঘল প্রভাব থাকার কথা নয়। এতে অতিসঙ্গত কারণেই ধারণা করা যায় যে, মসজিদটি মুঘল আমলের গোড়ার দিকে নির্মিত। খুব সম্ভবত সেই অঞ্চলের স্থপতি ও প্রকৌশলীদের মধ্যে সুলতানি আমলের স্থাপত্যকৌশলের ধারা তখন পর্যন্ত টিকে ছিল। তাই এতে সুলতানি আমলের প্রভাব বিদ্যমান।

 

মুঘল বা সুলতানি আমল যাই হোক না কেন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের একটি আদি নিদর্শন হিসেবে অষ্টগ্রামের কুতুবশাহ মসজিদ স্বমহিমায় বিদ্যমান।

অর্জুন কর্মকার, নিজস্ব প্রতিনিধি | বাংলাদেশদর্পণ.কম