আজম খান আমার গুরুর নাম। আমরা যারা বাংলা ব্যান্ডের ভক্ত তাদের গুরুর নাম আজম খান।

বাংলা ব্যান্ডের ইতিহাস যদি রুপকথা হয় সেই রুপকথার রাজপুত্র হলো আজম খান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যদি আমাদের গর্বের পরিশুদ্ধ অনুভূতি হয়, সেই অনুভূতির রুপকারদের একজন হলেন আজম খান।

গুরুর সাথে ব্যক্তিগত সখ্যতা থাকলে আজ আমি বেদনাবিধুর হয়ে সেই মুহূর্তগুলো স্মৃতির দেরাজ খুলে বের করে আনতাম। কিন্তু সে রকম কিছু নেই আমার। সে নিয়ে আমার যে বিন্দুমাত্র দুঃখবোধ আছে তাও কিন্তু না। গুরুর সাথে আসলে অদৃশ্য ইথারে সব গানপাগল, বাংলা গানপাগল মানুষের বন্ধুত্ব বাঁধা হয়ে আছে।

সালেকা মালেকা, হাইকোর্টের মাজারে, আলাল দুলাল, রেললাইনের ঐ বস্তিতে, আসি আসি বলে তুমি আর এলে না...কত কত সহজিয়া গান! বাংলা রক গানের আদি ও অকৃত্রিম আদল। বহু ইন্সট্রুমেন্ট বা টেকনোলজির পরিবর্তনে যার আবেদন এতটুকু কমেনি, কমবেও না। বাংলা গান ভালোবেসে যে সব সহজিয়া গান হয়েছে, মাটির গন্ধে যে সহজ শব্দচয়ন সুরে বাঁধা পড়ে গেছে বা গিটারের ডিসটর্শনে যে রাগী এ মাইনর উঠে এসেছে স্টেজ থেকে পথে, পথ থেকে প্রান্তরে...সে থাকে যাবে হাজার বছর পর্যন্ত। এই বাংলায়।

২০১১ তে বোধহয়। প্রথম আলোর কোনো এক অনুষ্ঠান, রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চে। বাপ্পা ভাই, বাচ্চু ভাই, ফোয়াদ নাসের বাবু ভাই অনেকেই উপস্থিত। গ্রে-তে কাজ করি তখন। গ্রের ইভেন্ট দেখে বিকেলে চলে এসেছিলাম অনেক দিন পর কনসার্ট দেখব বলে। তার চেয়েও বেশি আসলে গুরুর সাথে দেখা হবে বলে।

২০০১-০২ এর দিকে শ্রদ্ধেয় পার্থ মজুমদার এর সুরে একটা মিক্সড এলবামে (দেখা হবে দুজনে নাম ছিল। অসাধারণ একটা মিক্সড এ্যালবাম) আমার লেখা একটা গান ছিল। গুরুর গলায়। 'নীল আকাশে' শিরোনামে। 'নিষিদ্ধ সময় এখন/ ভালো থাকার অনিয়ম'... এ রকম ছিল কথাগুলো। তখনও আমার সাথে গুরুর বাক্যালাপ হয়নি। কিন্তু আমি খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম গুরুর সাথে করমর্দন করে এই কথাটা জানাবো।

পড়ন্ত বিকেলে একে একে বাপ্পা ভাই, বাচ্চু ভাই গান গেয়ে স্টেজ থেকে নেমে গেল। আমি চুপ করে আজম খানকে দেখছি। গুরু স্টেজের পিছনে শান বাঁধানো বসার জায়গায় বসে আছেন। একটু ঝুঁকে হাতে মাটি তুলে নিলেন। তারপর হাতে-পায়ে-মুখে আলতো করে মেখে নিলেন সেই মাটি। আমি অবাক হয়ে দেখলাম খানিকক্ষণ।

সাহস করে আর করমর্দন করা হলো না। স্টেজে নাম ঘোষণা হতেই দর্শকদের উচ্ছ্বাস দেখে কে! ততক্ষনে তুমুল হাততালির মধ্যে স্পঞ্জের স্যান্ডেল, হাফ হাতা শার্ট আর গ্যাভাডিন কাপড়ের প্যান্ট পড়ে বাংলা ব্যান্ডের গুরু 'বাংলাদেশ' গান গাইছে উদাত্ত কন্ঠে। 'ছেলেটি মরে গেছে'...

অনেকদিন পর কবির সুমনের একটা টিভি প্রোগ্রাম দেখেছিলাম।

'আপনাকে সবাই গুরু বলে, কেমন লাগে শুনতে'-

সুমনের প্রশ্ন শুনে সলজ্জ কন্ঠে এক প্রকার উড়িয়ে দিলেন এইসব।

'আরেহ, আমাদের উচ্চারনের এক গিটারিস্ট আমাকে গুরু ডাকতো, ওর দেখাদেখি সবাই একসময় গুরু ডাকা শুরু করলো। আমি বলি গুরু আবার কি! আজম ভাই বলো। আমার কথা শোনে না। কি আর করা!'- গুরুর উত্তর।

এত সহজ আর সুন্দর একটা মানুষ যে বাংলা ব্যান্ডের গুরু- এটা আসলে বাংলা গানের জন্যই একটা আশীর্বাদ, পরম আশীর্বাদ।

সহজিয়া মানুষ এর জন্মদিনে শ্রদ্ধা আর সালাম।

তোপধ্বনি দেই গুরু। মাথায় পট্টি বেধে রাস্তায় নামি গুরু। সব কলুষতা, কথা না রাখা, অর্থ-অনর্থের এই কপিরাইট জালে আটকা হাঁসফাঁস, হাঁসফাঁস দুনিয়ায় আমাকে শিষ্য করো গুরু।

'ধুর, গুরু আবার কি! আজম ভাই বল!'

শুভ জন্মদিন মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান। শুভ জন্মদিন আমাদের গুরু।

তুমি আমাদের গুরু, আজন্মকালের।

 

লেখক: শেখ রানা, গীতিকার‘গুরুর জন্মদিনে’ টুকরো নাগরিক জার্নাল - বই থেকে