আর্য মুনি ঋষিগণের লব্ধ ঐশী জ্ঞানই মূলত সনাতন ধর্মীয় শাস্ত্র এবং শাস্ত্রের নির্দেশনাই ধর্ম ও ধর্মীয় নীতি-আদর্শ। সনাতন ধর্ম ও ধর্মীয় বিধান সর্বকালের জন্যই যুগোপযোগী; কেননা হাজার হাজার বছর ধরে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এই রীতিনীতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাপূর্ণভাবে বিশ্বাসের মাধ্যমে সুন্দর সুশৃঙ্খলভাবে জীবন ও ধর্ম পালন করে আসেছে। আদৌ এসকল রীতিনীতিকে কেন্দ্র করে কোথাও কোন সমস্যার উদ্ভব হয়নি। এমনকি একবিংশ শতাব্দীতেও এই বিধান পরিবর্তনের আবশ্যকতা দেখা দেয়নি। উল্লেখ্য, যেকোন ধর্মীয় শাস্ত্রের নীতিবিরুদ্ধ কোন কিছু পরিবর্তনের অর্থ হচ্ছে সেই ধর্মীয় শাস্ত্রকে বিকৃতি বা তার মৌলিক প্রতিপাদ্যতায় আঘাত হানা। 

হিন্দু পারিবারিক আইন সংস্কারের নামে বর্তমানে হিন্দুদেরকে‘গরীবের বউ’ হিসেবে পরিণত করছে একদল অসাধু অর্থলোভী মহল! কেননা বিদেশী সহায়তায় দেশের নারী সমাজের অধিকার ও উন্নয়নের নামে বিভিন্নভাবে ছল-চাতুরীর ফাঁদে ফেলে তাদের স্বার্থ হাসিল একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। আর এর ধারাবাহিকতায় হিন্দু পরিবারগুলো বানরের রুটি বিভাজনের ন্যায় চতুরতার ফাঁদে পড়েছে। আমরা জানি বানরের রুটি বিভাজনে বস্তুত কোন পক্ষেরই কোন উপকার হয় না। এক টুকরো রুটিও কোন পক্ষের ভাগ্যে জোটে না। শুধুমাত্র সময়ক্ষেপণ, পরিশেষে পুরো রুটিটা ক্রমান্বয়ে বানরের পেটেই যায়। 

হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন করতে এ প্রক্রিয়া অনেক আগেই শুরু হয়েছে। এখন প্রায় শেষের দিকে। এখানে নীরব-সরব সবার অংশগ্রহণ রয়েছে। কেননা হিন্দুদের পারিবারিক ক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদ বা তালাক প্রথা, পুনঃবিবাহ বা বহুবিবাহ প্রচলন, নারীদের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার প্রভৃতি শাস্ত্রবিরুদ্ধ নীতি বাস্তবায়ন যেন দেশের পত্রপত্রিকা এবং অনেক বুদ্ধিজীবীদের একমাত্র চিন্তা-চেতনা আর স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। এতে হিন্দু নারীরা কতটুকু উপকার পাবেন সেটা প্রশ্নাতীত হলেও পরিণামে ঐসব স্বার্থান্বেষী মহল ঠিকই তাদের এজেন্ডা শতভাগ বাস্তবায়ন করবে। এটা অপ্রিয় সত্য। ভাবখানা এমন যেন মায়ের চেয়ে মাসীর দরদটা বেশী!

আর্য মুনি ঋষিগণের ঐশ্বরিক জ্ঞানের আলোকে প্রচলিত আইনকেই সনাতনধর্মীয় বিধান যা পরবর্তীতে হিন্দু আইন হিসেবে পরিচিত লাভ করে। উক্ত আইনে উল্লেখিত যে, হিন্দু পরিবারের মোট সম্পত্তির পরিমাণ এক টাকা কিংবা হাজার কোটি টাকা যাই হোক না কেন মূলত ‘হিন্দুদের পারিবারিক সম্পত্তি পুরুষ কিংবা নারী কোন ব্যক্তিরই নয়, সম্পত্তির প্রকৃত মালিক হলো পরিবার’। 

আর্য সভ্যতার সেই প্রাচীন যুগের গোত্র ব্যবস্থা থেকে যৌথ পরিবার তথা পরিবারের কর্তা ব্যক্তি পরিবারের কার্য্যনির্বাহী প্রধান হিসেবে সকল সদস্যের (শুধু পরিবারের মানুষই নয়, বরং পরিবারের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত সকল মানুষ, পোষা প্রাণী, বণ্য প্রাণীসহ সকল কিছুর) ভরণ-পোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে থাকেন। 

ঋষিগণের লব্ধ জ্ঞানে হিন্দু পরিবার বা সমাজ একটি কর্পোরেশন ব্যবস্থার ন্যায়। যেখানে পরিবারে বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষ পরিবারের কর্তা হিসেবে দায়িত্ব পান, পুরুষের অবর্তমানে নারীও পুরুষ ব্যক্তির ন্যায় পরিবারের কর্তার দায়িত্ব পালন করে থাকেন। 

এখানে উল্লেখ্য যে, কর্তা বা কোন পুরুষের কোন ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার স্বীকৃত নয়; কিন্তু শুধুমাত্র নারীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকবে, যাকে বলা হয়েছে 'স্ত্রীধন'। হিন্দু আইনে পুরুষকে তাঁর স্ত্রী, পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা, ভাই, বোন, নাতি-নাতনী, অসহায় পিতার বোন (পিসি) ও অন্যান্য নিকট আত্মীয় পরিজন, এমন কি পোষা প্রাণী, বণ্য প্রাণী’সহ আশ্রিত ও অভ্যাগতদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নির্বাহ করতে বাধ্য করার বিধান রাখা হয়েছে। পরিবারের যাবতীয় ঋণ, রাষ্ট্রীয় পাওনা, পরিবারের সদস্যদের যেকোন অপরাধের দায়-দায়িত্ব সর্বাবস্থায় কর্তা ব্যক্তির উপর অর্পিত হয়েছে। 

তবে হিন্দু আইনে নারীর কোন দায়-দায়িত্ব নেই। নারী তার পিতা, মাতা, স্বামী, পুত্র, কন্যা, শ্বশুর, শাশুরী, ননদ বা কোন আত্মীয়ের বা আশ্রিতের ভরণ-পোষণ করতে বাধ্য নয়; এমনকি হিন্দু নারী যদি প্রচুর সম্পত্তির মালিক হলেও অন্য কারো তো নয়ই, বরং নিজের ভরণ-পোষণের জন্যও কোন ব্যয় করতে বাধ্য নয়, সেটাও স্বামীর উপর বর্তায়। পুরুষ যা আয় করে তা পরিবারের সম্পত্তি, কিন্তু নারী যা আয় করে তা একান্তই নিজের সম্পত্তি 'স্ত্রীধন' হিসেবে গণ্য হয়; যা পরিবারের একান্ত দৈন্য অবস্থাতে নারী উক্ত স্ত্রীধন ব্যয় করতেও পারে আবার নাও করতে পারে, এক্ষেত্রে কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। 

নারীরা যেন কোনভাবেই পরিবার থেকে বিচ্যুত না হয়, বরং নারী জীবন সুন্দর ও সুশৃঙ্খল থাকলেই পরিবার সুরক্ষিত থাকবে - এই মতবাদই ছিল আর্য মুনি ঋষিগণের লব্ধ নারী সম্পর্কিত ঐশী ধারণা। এই জন্যই সনাতন শাস্ত্রে নারীকে সর্বোচ্চ স্থান তথা দেবীরূপী আখ্যায়িত করা হয়েছে। পৃথিবীর আর কোন ধর্মেই নারীকে ঈশ্বরস্বরুপ জগজ্জননী তথা দেবীশক্তি বা মাতৃশক্তিরূপে পূজা করা হয়না, যা শুধুমাত্র সনাতন শাস্ত্রেই প্রচলিত। এজন্যই সনাতনীরা বলে থাকে, মায়ের পায়ে নীচে সন্তানের স্বর্গ। এমনকি সনাতন শাস্ত্রে পুরুষ অপেক্ষা নারী অধিক ক্ষমতাধর হিসেবে আদ্যাশক্তির পূজারও প্রচলন রয়েছে। 

আর্য মুনি ঋষিগণের প্রদত্ত শাস্ত্রানুযায়ী পরিবারে কোন বিবাহ বিচ্ছেদ, তালাক তথা পরিবারিক আন্তঃসম্পর্ক বিঘ্নিত হয় এমন কোন বিধান নেই। ফলে হিন্দু বিবাহিত নারীরা সম্পূর্ণ সুরক্ষিত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রাষ্ট্রের রাজকর্মচারী বা সরকারী চাকুরীজীবীদের যেমন জীবিকা নির্বাহ তথা পারিবারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় অতিরিক্ত উৎকন্ঠার কোন অবকাশ থাকে না, বরং কোনভাবে মাস পেরুলেই সরকার থেকে প্রাপ্তব্য সকল সুবিধাদি নিশ্চিত হয়, এক কথায় নিশ্চিন্ত জীবন উপভোগ করেন, তেমনি হিন্দু বিবাহিত নারীগণ বিবাহের মাধ্যমে তাঁর সকল দায়িত্ব স্বামীর পরিবার তথা স্বামীর উপর অর্পণের মাধ্যমে সুন্দর, সুশৃঙ্খল তথা নিশ্চিন্ত জীবন উপভোগ করার সুযোগ পান। 

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, দেশের কিছু চতুর ও অর্থলোভী গোষ্ঠী হিন্দুদের এই ঐশ্বরিক পারিবারিক বন্ধনে ফাঁটল ধরানোর লক্ষ্যে বিদেশী মদদপুষ্ট হয়ে সুদীর্ঘ বছর ধরে বিভিন্ন কৌশল চালাচ্ছে। ইতোমধ্যে তারা কিছুটা সফলতাও অর্জন করেছেন। কথায় আছে, জাহাজ একসাথে ডোবানো যায় না। কিন্তু জাহাজের তলায় একটু ফুটো করার মাধ্যমে অল্প কিছুদিনের মধ্যে জাহাজ যত বৃহৎ ও শক্তিশালীই হোক ডুবতে বাধ্য হবে। তেমনিভাবে দেশের হিন্দু নারীদের পারিবারিক বন্ধন থেকে দূরে রাখা, অরক্ষিত করা, আশ্রয়হীন করা, ধর্ষিত, ধর্মান্তরিত প্রভৃতি বিষয়গুলোকে পুঁজি করেছে অসাধু কিছু এনজিও। তারা বিদেশী অর্থের বিনিময়ে সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করে অর্থাৎ দেশের আপামর হিন্দু নারী জনগোষ্ঠীকে বলির পাঁঠা বানিয়ে মহাবিপদের সম্মুখীন করে সেই সমস্ত ঘটনা আগামীতে বিদেশে তুলে ধরে বিদেশী সহায়তার নামে অর্থ কামানোই মূলত তাদের অন্যতম ব্যবসা। এই ব্যবসায় ঘরের শত্রু হিসেবে কিছু অসাধু হিন্দুরাও জড়িত রয়েছে। অথচ এই হিন্দু নারীরা যখন অপহৃত, ধর্ষিত, বিপদগ্রস্থ বা যে কোন প্রকারের নির্যাতনের স্বীকার হয় তখন এই সমস্ত বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীদের বস্তুত কোন অস্তিত্বই চোখে পড়ে না।

একসময় বিদেশীরা বিনামূল্যে চা খাওয়ায়ে এদেশের মানুষকে চা পানের নেশা ধরিয়েছিল। পরবর্তীতে দেখা যায় চুলোয় চাল চড়ে না, হাঁড়িতে আগুন ধরে না, সন্তান-পরিবার অভূক্ত, কিন্তু চাখোড় রিক্সাভাড়া দিয়ে চা পান করতে যাচ্ছে। এদেশের হিন্দু নারীদের এই অবস্থায় দাঁড় করানোর নিমিত্তেই এসকল বুদ্ধিজীবীরা যেন সদলবলে উঠে পড়ে লেগেছে। প্রশ্ন হলো, যারা নিজস্ব উদ্যোগে হাজার বছরের সনাতন ধর্মীয় রীতিনীতি পরিবর্তনের ডাক দিয়েছেন, তারা কি আদৌ কোন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব? নাকি সনাতন ধর্মশাস্ত্রের কোন স্বীকৃত বিদগ্ধ পন্ডিত? নাকি ধর্মশাস্ত্রের আইন প্রণয়নের জন্য হিন্দু সম্প্রদায় তাদেরকে বিশেষ কোন দায়িত্ব অর্পণ করেছে? আরো কথা হলো, বিবাহ-বিচ্ছেদ ও তালাক, বহুবিবাহ প্রথার উদ্ভব, উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পত্তি ভাগাভাগির জন্য হিন্দু নারীরা কি দেশে কোন বিদ্রোহ সৃষ্টি করছে! কোন গৃহযুদ্ধের পাঁয়তারা করছে! তবে কেন, এই আইন সংস্কারের মহোৎসব? 

আসলে আইন সংস্কারের উদ্যোক্তারা কী চায়? তাদের উদ্দেশ্যই বা কী? তাদের আসল পরিচয় জানা খুব মুশকিল, কেননা তারা সমাজে বুদ্ধিজীবী সেজে ছলে-বলে-কলা-কৌশলে এদেশের ভূমিপুত্র হিন্দুদের গৃহহীন, আশ্রয়হীন, অর্থহীন সর্বোপরি জাতিগত মেরুদণ্ডহীন করার প্রয়াসে সুকৌশলে কাজ করে যাচ্ছে। এ বিষয়ে সাধারণ হিন্দুরা যেন গভীর ঘুমে। তারা জানলোই না তাদেরকে বোঁকা বানিয়ে তাদেরকে দিয়েই তাদের ঘরে কত বড় আগুনের লেলিহান জ্বালিয়ে দিচ্ছে এই সকল চতুর বুদ্ধিজীবীগণ!

এদেশের প্রতিদিন কত সংখ্যাক হিন্দু বাড়ীতে-মঠ-মন্দিরে হামলা ভাংচুর, জমি বেদখল, ধর্ষণ, জোরপূর্বক নারী অপহরণ, ধর্মান্তরকরন হয়ে নির্মমতায় দিনাতিপাত করছে এসবের খবর কেউ রাখে না। বিচার ব্যবস্থায় কাউকে পাশেও পাওয়া যায় না। কিন্তু নারীদের সম্পত্তির ভাগাভাগির ব্যাপারে সবার মেজাজ যেন ফুরফুরা!

এই সকল বুদ্ধিজীবীগণ কথায় কথায় ভারতের সংখ্যালঘুদের সাথে বাংলাদেশের তুলনা করে। কিন্তু তাদের চোখে কি দৃশ্যমান হয় না যে, ভারতে সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রীয়ভাবে উপ-রাষ্ট্রপতি, উপ-প্রধানমন্ত্রী পদ, সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সুরক্ষা ব্যবস্থাসহ যথাযথ আইন ও প্রয়োগ বহু আগে থেকেই বিদ্যমান। বাংলাদেশ মুসলিম রাষ্ট্র হয়েও ইমাম-মুয়াজ্জিনদের কোন সরকারী ভাতা নেই, কিন্তু ভারতে ইমাম-মুয়াজ্জিনদের জন্য সরকারী বেতন-ভাতা চালু রয়েছে। আরো অনেক লিখিত-অলিখিত সুযোগ সুবিধা তারা ভোগ করছে, তা লিখতে গেলে কয়েক পৃষ্ঠার দরকার। সেই তুলনায় বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের জন্য রাষ্ট্রীয় কি কি সুযোগ সুবিধা আছে, তা দেশের জনগণ জানে। দীর্ঘ ১২ বছরের বেশী সময় ধরে দুর্গাপূজার ০৩ (তিন) দিন ছুটির জন্য আন্দোলন করে আসছে হিন্দু ধর্মীয় বিভিন্ন সংগঠন। সেটা অদ্যাবধি বাস্তবায়ন হয়নি। আদৌ হবে কিনা সন্দেহ। উপ-রাষ্ট্রপতি, উপ-প্রধানমন্ত্রী, সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ অন্যসব তো অনেক দূরের বিবেচনা। 

ভারতে সনাতন ধর্মীয় বিধি-নিষেধ ব্যতিরেকে বিবাহ বিচ্ছেদ আইন প্রচলন করায় ভারতীয় নারীরা প্রতিনিয়ত বিবাহ বিচ্ছেদের স্বীকার হচ্ছে, পরিবারগুলো ভেঙ্গে নারীরা আশ্রয়হীন, গৃহহীন ইত্যাদি নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। পরিবারগুলো নিউক্লিয়াস থেকে অতি নিউক্লিয়াসে রূপান্তরিত হচ্ছে। এই নীতির বাস্তবায়নে বাংলাদেশের হিন্দু পরিবারগুলোও ক্রমান্বয়ে ধ্বংস ও নিঃশেষ হয়ে যাবে। তাই এখনো আমরা মনে করি হিন্দুবিবাহ নিবন্ধন, বিচ্ছেদ ও তালাক আইন একদিকে যেমন শাস্ত্রবিরুদ্ধ, অন্যদিকে এদেশে হিন্দুদের জন্য যথাপোযুক্ত নয়। বরং যতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে তাও বাস্তব পরিপন্থী। 

হিন্দু নারীদের প্রতি অতি দরদী এই বুদ্ধিজীবীগণ মতামত দিয়েছেন, যেমন: ‘স্বামী বা স্ত্রী কিংবা উভয়ের উদ্যোগে আদালতের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ করা যাবে এবং বিচ্ছেদের পর পুণরায় বিবাহের সুযোগ’; হিন্দু নারীদের ‘উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তিতে পুত্রের সাথে কন্যার পূর্ণ ও সমান অধিকার থাকতে হবে এবং বিধবা পূর্ণস্বত্ত্বে উত্তরাধিকারী হবেন” ইত্যাদি যা অন্যান্য অপসংস্কৃতির ন্যায় হিন্দু সমাজকেও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়ার পথ সুগম করার কূটকৌশল মাত্র। ধর্মীয় শাস্ত্রে যাই থাকুক না কেন, তারা যেকোনভাবেই হিন্দুদের মধ্যে অপসংস্কৃতি তথা বিবাহ-বিচ্ছেদ, তালাক, পুনঃবিবাহ, উত্তরাধিকার সম্পত্তির ভাগাভাগি প্রভৃতি সংযোজনে বাধ্য করার প্রয়াস করছে। 

আমরা জানি, যে কোন ধর্মীয় শাস্ত্র বিষয়ে যদি কোন নীতিগত সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের একান্ত আবশ্যকতা থাকে, তবে সেই ধর্মের স্কলারগণ, চিন্তাবিদ প্রভৃতি শ্রেণীভূক্তদের সর্বসম্মত মতামতই প্রাধান্য পায়। যেমন, বিশ্বের আলেম, উলামা ও ইসলামী বিশিষ্ট চিন্তাবিদগণ তাদের বিদগ্ধ আলোচনা ও পর্যালোচনা শেষে সর্বসম্মতিক্রমে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হন, পরবর্তীতে তাহাই বাস্তবায়িত হয়। বৌদ্ধ খ্রিস্টানসহ অন্যান্য সকল ধর্মের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। কিন্তু একমাত্র বাংলাদেশের হিন্দুদের ধর্মীয় শাস্ত্র পরিবর্তনের ঠিকাদারী নিয়েছেন বিদেশী মদদপুষ্ট এনজিও আর চতুর বুদ্ধিজীবীগণ। বিষয়টি সত্যিই উদ্বেগের!
হিন্দু নারীগণ উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পত্তিতে পুরুষের সমান অংশ পাবে। প্রশ্ন হলো এই অতিমাত্রার দরদটা হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদে সকল নারীর জন্য বাঞ্চনীয় হওয়া দরকার। কেননা নারী অধিকার বলতে সকল ধর্মের নারীদের সমান অধিকার বোঝায়, এখানে হিন্দু নারীদের জন্য এক নিয়ম অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য অন্য নিয়ম এটা নিশ্চয়ই হতে পারেনা। 

কোরান হাদিসের নিয়ম যেমন আল্লাহর বিধান, তেমননি হিন্দু নারীদের নিয়েও যে বিধান রয়েছে তা আর্য মুনি ঋষিগণের লব্ধ ঐশী জ্ঞান তথা ঈশ্বরের বিধান। আইন সংস্কারে এতই দরদী ও উদ্যোগী থাকলে হিন্দু নারীদের উত্তরাধিকারসূত্রে পুত্রের ন্যায় কন্যার পূর্ণ ও সমান অধিকারের ন্যায় মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য সকল ধর্মের নারীদেরও উত্তরাধিকার ক্ষেত্রে একই নীতির নিশ্চিতে যথাক্রমে সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতির ভিত্তিতে বাস্তবায়নের দাবী জানাচ্ছি। 

বাস্তবিক ক্ষেত্রে এই সকল বুদ্ধিজীবীদের বু্দ্ধিতে নারীরা এখন প্রায়শঃ বিবাহ বিচ্ছেদের স্বীকার হচ্ছে, পরিবারগুলো ক্রমান্বয়ে ভাঙছে, সন্তান নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি তথা গৃহহীন-আশ্রয়হীন হয়ে পথে পথে ঘুরছে, সন্তানরা পরিবারহীন পিতৃহীন হওয়া’সহ নারীরা ক্রমান্বয়ে বিপথগামী হয়ে গোটা সমাজ ব্যবস্থাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে শুরু করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় এবার চলছে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন সংস্কারের নামে পুনরায় হিন্দুদের পারিবারিক ব্যবস্থাকে ধংসের পাঁয়তারা। 

এদেশের হিন্দুরা ‘সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন’ বাস্তবায়ন চায়, ‘সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়’ চায়, ‘সংসদে পৃথক নির্বাচন’ ব্যবস্থা চায়, ধর্মীয় আচার পালনে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা চায়। কিন্তু এই কপট বুদ্ধিজীবীরা এগুলো বাস্তবায়নে কোন আগ্রহ নাই। কেননা এগুলো করলে হিন্দুরা উপকৃত হবে, অন্যদিকে তাদের পকেটও ভারি হবে না। তাদের পকেট ভরবে তখন, যখন দেখবে সম্পত্তি নিয়ে হিন্দু পরিবারগুলোতে তথা ভাই-বোনে, মা-ছেলে, পিতা-পুত্রে ঝগড়া-মারামারি, মামলা-মোকদ্দমা, বিবাহ-বিচ্ছেদ, তালাক, বহুবিবাহ লেগেই থাকবে, তখন তারা এই সুযোগে মীমাংসার নামে অর্থ রোজগারের ফন্দী আটবে। অর্থাৎ উপকার নয় বরং শতভাগ অপকারের মাধ্যমে হিন্দু পরিবারগুলোর মধ্যে ঝগড়া, ফ্যাসাদ, বিবাদ বাধিয়ে হিন্দুদের চরম ক্ষতি করাই তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। 

অসাম্প্রদায়িক দেশে রামু, নাসিরনগর, রংপুর, কুমিল্লার মুরাদনগর, সুনামগঞ্জের শাল্লা’সহ বিভিন্ন এলাকায় মাইকে পূর্বঘোষণা দ্বারা হিন্দু বাড়ী ঘর মঠ-মন্দিরে হামলা, ভাংচুর, ধর্ষণ, লুঠপাট’সহ অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হয়েছে এবং প্রতিনিয়ত নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। রাতের অন্ধকারে দেশ ত্যাগে করতে বাধ্য করা হচ্ছে। সঠিক বিচারহীনতা ও সহজ জামিনে মুক্তি ব্যবস্থায় হিন্দু নির্যাতনকারীদের অপরাধ প্রবণতা যেন ক্রমশঃ আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। সকল ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের মুখে কুলুপ! মনে হয় তারা অন্ধ এবং বধির। শুধুমাত্র সম্পদ ও নারীর গন্ধ পেলেই তারা সরব এবং অস্তিত্ব জানান দেয়। এদের জাতির কাছে প্রকাশ ও সমূলে উৎপাটন করা না গেলে এদেশের হিন্দু সমাজের ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী। 

যদি কোন পরিবারে কোন অনাঙ্খাঙ্খিত ঘটনার স্বীকার হয় সেই বিষয়ে পরিবারিক বিচারিক পদ্ধতি কিংবা আদালত রয়েছে। এছাড়াও The Hindu Married Women’s Right to Separate Residence and Maintenance Act, 1946, The Hindu Women’s Right to Property Act, 1937’সহ বিবদমান পরিস্থিতি নিরসনে যথেষ্ট আইনী ব্যবস্থা রয়েছে। এগুলো ছাড়াও হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন বিচ্ছেদ ও তালাক আইন বাস্তবায়ন, উত্তরাধিকার আইন সংস্কার তথা হিন্দু নারীদের সম্পত্তি ভাগাভাগি বিষয়ে এনজিওগুলোর নিজ উদ্যোগে আইনের খসড়া প্রণয়ন করার অতিমাত্রার উৎসাহ উদ্দীপনা ও বিশেষ দায়িত্ব নেওয়ার উদ্দেশ্যে কী? এতে কার স্বার্থ কতটুকু? 

সর্বোপরি বলতে চাই আর্য মুনি ঋষিগণের লব্ধ ঐশী জ্ঞানে প্রচলিত হিন্দু আইন নারী পুরুষ ভেদাভেদে পরিপূর্ণ আইন, ঐশী আইনের নীতি পরির্বতন গোটা ধর্মীয় ব্যবস্থাকে হেয় এবং কলঙ্কিত করার সামিল। তাই হিন্দু উত্তরাধিকার আইন সংস্কার নয়, বরং সত্যিকার অর্থেই যদি হিন্দু নারীদের উপকার করার মন-মানসিকতা থেকে থাকে তবে পরিবার ব্যবস্থায় আঘাত না হেনে পারিবারিকভাবে সমস্যার সমাধান’সহ যে কোন নির্যাতনের শতভাগ বিচার নিশ্চিতে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করছি। 

 

লেখক: দেবাশিস সাহা

অধ্যক্ষ, আর্যসংস্কৃত কলেজ, ঢাকা