বাংলাদেশে নারী ও সংখ্যালঘু নির্যাতন বাড়ছে। অভিযোগটা দেশের ভেতরে মুখ ফুটে কেউ বলার সাহস না দেখালেও বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে যেসব চিঠিপত্র পাই, তাতে বিশ্বাস না করে পারছি না যে, দেশে নারী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নানা উপায়ে নির্যাতন হচ্ছে। এমনকি মিডিয়ার নারী কর্মীরা তাঁদের পেশাদারি জীবনে নিরাপত্তা পান না। উদাহরণ, একটি প্রথম শ্রেণির দৈনিকের নারী সাংবাদিক রোজিনার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে হয়রানি। রোজিনা করোনার টিকা আনা সম্পর্কে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নানা দুর্নীতি ফাঁস করতে যাচ্ছিলেন। এ অবস্থায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তাঁকে শুধু নাস্তানাবুদ করা হয়নি, বেআইনিভাবে আট ঘণ্টা আটক রাখা, তাঁর বিরুদ্ধে বিদেশে দেশের গুপ্ত খবর পাচারের অভিযোগও আনা হয়েছিল। এটা রাষ্ট্রদ্রোহ এবং এই অভিযোগই তাঁর বিরুদ্ধে আনার চেষ্টা করা হচ্ছিল।

রোজিনার কপাল ভালো। যে দৈনিকটিতে তিনি কাজ করেন, সেটি অত্যন্ত প্রভাবশালী। এই দৈনিকের এবং সাংবাদিকদের সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে রোজিনাকে আর হেনস্তা করা সম্ভব হয়নি। নইলে র‍্যাব অথবা পুলিশের এক ব্যাটালিয়ন এসে তাঁর বাড়ি ঘেরাও করত। তাঁর বাড়িতে হয়তো (আগে থেকেই রাখা) রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কাগজপত্র পাওয়া যেত। তাঁকে রিমান্ডে নিয়ে তাঁর কাছ থেকে অনেক সাংঘাতিক তথ্য উদ্ধার করা হয়েছে বলে তদন্তকারী অফিসাররা দাবি করতেন। সাংবাদিকদের ঐক্যের ফলে রোজিনা এ যাত্রায় বেঁচে গেছেন।

রোজিনার আগে আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। মৃত্যুদণ্ডের রায় গলায় ঝুলিয়ে কাশিমপুর কারাগারে দুই বছর ধরে ধুঁকছে। সে-ও কলেজছাত্রী। তাঁর ওপর নজর পড়েছিল ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী এমপির প্রতাপশালী পুত্রের। এখানেও থানা-পুলিশ পুত্রের সহায়। মেয়েটির বিরুদ্ধে স্বামী হত্যায় সহায়তার অভিযোগে দেশের উচ্চ আদালত তাঁর ফাঁসির আদেশ মঞ্জুর করেছেন। আমি মহামান্য আদালতের রায় সম্পর্কে তর্ক তুলতে পারি না। তবে মিন্নির কেউ হলে উচ্চ আদালতেই তাঁর রিট্রায়ালের দাবি জানাতাম।

আরেকটি ঘটনা। জীবন নামে আমার ছোট ভাইয়ের মতো বন্ধু। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র। ঊর্মিও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী। উভয়ের মধ্যে প্রেম হয়। জীবন হিন্দু এবং ঊর্মি মুসলমান। ঊর্মি তাঁর পিতামাতার অমতে গোপনে জীবনকে বিয়ে করেন। এটা বঙ্গবন্ধুর আমল। বাংলাদেশ সেক্যুলার স্টেট। মিশ্র বিবাহে কোনো বাধা থাকার কথা নয়। তবু পুলিশ ঊর্মির বাবার অভিযোগ গ্রহণ করে এবং হাউন্ডের মতো খুঁজতে থাকে। নবদম্পতি আমেরিকার নিউইয়র্কে পালিয়ে যান। উচ্চশিক্ষার গুণে দুজনেই নিউইয়র্কে খুব উচ্চপদে চাকরি পান। তাঁরা সেখানে খুব ভালো আছেন। জীবন খুব ভালো গীতিকার ও সুরকার। তাঁর গানের অ্যালবামও বেরিয়েছে।

আমি দু-দুবার আমেরিকায় গিয়ে জীবন-ঊর্মির বাসায় অতিথি হয়েছিলাম। ওদের এখন একটি মেয়ে আছে, উদিতা। সে-ও মেধাবী ছাত্রী। আমি যখন নিউইয়র্কে, তখন জীবনের দুঃখের কথা জানলাম। জীবন ফরিদপুরের ছেলে। প্রচুর জায়গা-জমির মালিক। আকস্মিকভাবে দেশ ছেড়ে আসায় তাঁর জায়গা-জমি প্রতিবেশী মুসলমানরা দখল করে নেয়। এমনকি তাঁর আত্মীয়স্বজন হুমকির মুখে পড়েছে। তাদের বলা হয়েছে, ‘তোমরা বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদে ভারতে চলে যাও।’

আত্মীয়স্বজনকে সাহায্য করার জন্য জীবন দেশে যেতে চেয়েছিলেন। দেশে ফিরলে তাঁকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। জীবন বহু দিন দেশে যেতে পারেননি আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে। এটা বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা। জীবন এখন দেশে যেতে পারছেন। ঘরবাড়ি উদ্ধার করতে পেরেছে কি না, জানি না। এই ধরনের অন্তত এক শ ঘটনার কথা জানি। জীবনের ঘটনাটি সংখ্যালঘু নির্যাতনের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করলাম। আমাকে এক সংখ্যালঘু বন্ধু বলেছেন, আওয়ামী লীগের আমলেও সংখ্যালঘু নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। শুধু প্রক্রিয়াটা পাল্টেছে।

বিএনপির আমলে সরাসরি সংখ্যালঘুদের বাড়িতে হামলা চালানো হতো। তারপর ভয় দেখানো, ঘরবাড়ি তাদের লিখে না দিলে সংখ্যালঘু পরিবারের পুরুষ সদস্যদের হত্যা করা হবে এবং নারীদের নির্যাতন করা হবে। আওয়ামী লীগ আমলে কৌশলটি একটু অন্য রকম। সংখ্যালঘু পরিবারকে জানানো হয়, ‘এ অঞ্চলে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আপনারা নিরাপদে ভারতে চলে যান। আমরা কিছু টাকাপয়সাও দিচ্ছি। আপনাদের বাড়িঘর, সম্পত্তি আমাদের হেফাজতে রেখে যান। আপনারা ফিরে এলে পাবেন।’ সংখ্যালঘুদের মতে, এটা হচ্ছে সংখ্যালঘুদের ওপর সাইলেন্ট টর্চার বা নীরব অত্যাচার।

আমার জীবনে সর্বাধিক আঘাত পেয়েছিলাম একটি ঘটনায়। সেটি আজ বলছি। যদিও আসল নামধাম প্রকাশ করতে পারছি না, পরিবারটির নিরাপত্তার কথা ভেবে। এক উপজেলা শহরে এক হিন্দু স্কুলমাস্টারের বাড়িতে বছর চারেক আগে বেড়াতে গিয়েছিলাম। তাঁর দুই মেয়ে। বড় মেয়ে সুজাতা (কল্পিত নাম) বিএ ক্লাসের ছাত্রী। ইংরেজি অনার্স পড়ার শখ ছিল তাঁর। শখ মেটেনি। আমাকে টি এস এলিয়টের টাইম পাস্ট অ্যান্ড টাইম প্রেজেন্ট কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনাল। আবৃত্তির মাঝখানে এক গুন্ডামতো ব্যক্তি ঘরে এসে দাঁড়াল। কর্কশ কণ্ঠে ডাক দিল, ‘সুজাতা’। সুজাতা অবনত মস্তকে উঠে দাঁড়াল। আমার দিকে তাকাল। করুণ মিনতিমাখা চোখ।

সে চলে গেলে মাস্টারমশাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, গুন্ডার মতো দেখতে এই যুবকটি কে? মাস্টারমশাই জবাব না দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর কেঁদে ফেললেন। বললেন, ‘যুবকটি আমার কেউ নয়। একজন নামকরা গুন্ডা। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের লোক। কিছু বলতে পারি না। যখন-তখন আমার মেয়েটিকে এসে নিয়ে যায়। সবাই জানে সুজাতা তার রক্ষিতা।’

প্রশ্ন করেছিলাম, ‘আপনি এটা মেনে নিলেন কেন?’ তিনি বললেন, ‘কী করব, ভারতে যাওয়ার সময় ও সুযোগ পাইনি। দশ কাকে এসে ওকে ঠুকরে খাবে, তার বদলে এক কাকের প্রোটেকশনে ওকে রেখেছি।’

রবীন্দ্রনাথ ‘অক্ষমক্রোধ’ বলে একটা কথা বাংলা ভাষায় যোগ করেছেন। মাস্টারমশাইয়ের কথা শুনে আমি সেই অক্ষমক্রোধ নিজের বুকে অনুভব করেছি। কিন্তু হিন্দু পরিবারটির জন্য কিছু করতে পারিনি। করতে গেলে পরিবারটির ওপর যদি আরও অত্যাচার নেমে আসে! সংখ্যালঘুরা কি এখনো বাংলাদেশে নিরাপদ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের মতো নাগরিক অধিকারপ্রাপ্ত? যদি নাগরিক অধিকার সম্পূর্ণ পেয়ে থাকে, তাহলে সুনামগঞ্জের শাল্লার ঘটনাটি কী করে ঘটে? অপরাধীরা, মূল অপরাধীরা অতি সহজে জামিন পেয়ে গেল। ঝুমন জামিন পাচ্ছে না কেন? তাকে নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত জামিনের জন্য ঘুরতে হচ্ছে কেন? ঠিক পরীমণির মতো। সংখ্যালঘু ও নারী নির্যাতনে বাংলাদেশ কি কখনো তার লজ্জা মুছে ফেলতে পারবে না?

সবচেয়ে দুঃখ হচ্ছে, এগুলো ঘটা অব্যাহত রয়েছে আওয়ামী লীগের শাসনামলে, যারা সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতা উচ্ছেদের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজনীতি করছে এবং ক্ষমতায় বসেছে। আওয়ামী লীগ যে তার অঙ্গীকারে দৃঢ় অবস্থানে থাকতে পারছে না, আমার বিবেচনায় তার বড় দুটি কারণ–কোনো কোনো ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের আদর্শিক পশ্চাদপসরণ এবং শাসনক্ষমতা প্রকৃত অর্থে আমলাতন্ত্রের হাতে। বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলেও ক্ষমতা আমলাদের হাতে ছিল। এটা কলোনিয়াল ব্যুরোক্রেসি। তৈরি হয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের আমলে। দুধ-কলা খেয়ে বড় হয়েছে পাকিস্তান আমলে। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসে, তখন ব্রিটিশ দার্শনিক জ্যাক ওয়াডিস সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ শুধু অফিসে বসেছে, ক্ষমতায় বসেছে আমলাতন্ত্র।’

এই আমলে আমলাতন্ত্রের প্রতাপ আরও বেড়েছে। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ও আদর্শিক ত্রুটি-দুর্বলতার কারণে আমলানির্ভরতা বাড়ায় তাদের এখন পোয়াবারো। পরীমণিকে পুলিশের অত্যাচার থেকে রক্ষা করার ব্যাপারে দুই মন্ত্রীর অসহায়তা দেখেছি। সম্প্রতি মিডিয়ায় একটি মজার খবর দেখলাম। কোনো এক মন্ত্রী, আমার পরিচিত, অত্যন্ত ভালো মানুষ, তাঁর মন্ত্রকের সচিবের মায়ের করোনা হয়েছে। তাঁকে দেখভাল করার জন্য মন্ত্রকের দুই ডজনের মতো কর্মচারী হাসপাতালে পালাক্রমে ডিউটি করছে। এটা সচিবের হুকুমেই হয়েছে মনে করে খবরটি মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। সচিব বলেছেন, তিনি কাউকে তাঁর মায়ের দেখভাল করার জন্য হাসপাতালে ভিড় জমাতে বলেননি। কিন্তু তিনি তাঁদের এই ব্যাপারে না করেছিলেন কি না, সেটাও খোলাসা করেননি।

এক মন্ত্রীকে একটা অনুরোধ জানিয়েছিলাম। তিনি বলেছেন, ‘গাফ্ফার ভাই, আমার সচিবকে বলুন।’ আমাদের বিখ্যাত চিত্রপরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘এক শনিবারের বিকেল’ ছবিটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে না। ছবিটি আমি দেখেছি। আন্তর্জাতিক মানের ছবি। ছবিটি ছাড়পত্র দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছি–জবাব নেই। তাঁর তথ্যমন্ত্রীকে বলেছি। তিনি বলেছেন, এই ছবির ছাড়পত্র দেওয়ার ক্ষমতা তাঁর নেই। তাহলে ক্ষমতা কার হাতে? আমরা কোন দেশে বাস করছি? এ দেশের নারী ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা কে দেবে? কিছু নারীকে উচ্চপদে বসালে কি নারীর ক্ষমতায়ন হয়? আর কিছু মন্দির ভেঙে তা পুনর্নির্মাণের জন্য টাকা দিলেই সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানের নিরাপত্তা বিধান ও নাগরিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়? এই প্রশ্নটিও-বা কার কাছে করব?

লেখক: বর্ষীয়ান সাংবাদিক ও কলামিস্ট