বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কেড়ে নিয়েছিল স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ। মহামারির দুঃসময় কাটিয়ে ফের এসেছে স্বাভাবিকতার আলো। নতুন বছরেও স্বাভাবিকতার এ আলোকে ধরে রাখার প্রত্যাশায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। সেই প্রত্যাশার ভাষিক প্রকাশের জন্য প্রখ্যাত বাঙালি গীতিকার ও সুরকার রজনীকান্ত সেনের একটি গীতিকবিতার চরণ ধার করে এবারের শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে, ‘নির্মল করো, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে।’

বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখ আজ বৃহস্পতিবার। রমজান মাস হওয়ায় এবারের পয়লা বৈশাখের সকালে পান্তা-ইলিশের আয়োজন হয়নি। তবে পুরোনো গ্লানি, হতাশা আর মলিনতাকে পেছনে ফেলে নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশায় নতুন বছর ১৪২৯-কে বরণ করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হচ্ছে আজ। সকাল নয়টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) এলাকার সড়কদ্বীপ থেকে শোভাযাত্রা শুরু হওয়ার কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি চিরন্তন চত্বর হয়ে পুনরায় টিএসসিতে এসে শেষ হবে শোভাযাত্রা।

মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ টিএসসি এলাকায় এসেছেন। শোভাযাত্রায় অংশ নিতে আসা নারীদের অনেকের পরনে শাড়ি আর মাথায় নানা রঙের ফুল। পুরুষদের পরনে পাঞ্জাবি। তবে সবারই চোখে-মুখে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়। শোভাযাত্রাকে ঘিরে গতকাল বুধবার রাত থেকেই টিএসসিসহ পুরো ক্যাম্পাস এলাকায় কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়। মোতায়েন আছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য। 

বিগত শতকের আশির দশকে সামরিক শাসনের অন্ধকার ঘোচানোর আহ্বানে পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে একটি শোভাযাত্রা বের হয়েছিল। এটিই পরে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নাম ধারণ করে। গত তিন দশক ধরে প্রতি বছরই পয়লা বৈশাখে চারুকলার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হচ্ছে। ২০১৬ সালে ইউনেসকোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পায় এই শোভাযাত্রা। মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বাঙালির হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যের মেলবন্ধনের মাধ্যমে কূপমণ্ডূকতা ও সংকীর্ণতার ঘৃণ্য অবয়বের ওপর সাংস্কৃতিক আঘাত হিসেবে দেখা হয়ে থাকে।

প্রতি বছরের মতো এবারও মঙ্গল শোভাযাত্রার তহবিল সংগ্রহের জন্য চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণে গত এক সপ্তাহ ধরে ‘আর্ট ক্যাম্প’ হয়। এখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও প্রখ্যাত শিল্পীদের আঁকা ছবি বিক্রি করে সংগৃহীত অর্থ খরচ হচ্ছে শোভাযাত্রার ব্যয় নির্বাহে। শোভাযাত্রার প্রস্তুতি শুরু হয় তারও এক সপ্তাহ আগে। মুখোশ, টেপা পুতুল, মাছ ও পাখির প্রতিকৃতিসহ লোকসংস্কৃতির নানা উপাদান থাকছে এবারের শোভাযাত্রায়।

করোনা পরিস্থিতির কারণে ২০২০ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়নি। ২০২১ সালে হয়েছে সীমিত পরিসরে, যেখানে সবার অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল না। দুই বছর পর এবার অনেকটা চেনা রূপে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন হচ্ছে। নির্মাণাধীন মেট্রোরেলের কারণে চলাচলের পথ সরু থাকায় মঙ্গল শোভাযাত্রা এবার চারুকলা অনুষদের পরিবর্তে টিএসসির সড়কদ্বীপ থেকে বের করা হচ্ছে। এ বছর মঙ্গল শোভাযাত্রার সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছে চারুকলা অনুষদের ২২ ও ২৩ তম ব্যাচ।

এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্যের বিষয়ে চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, এবারের প্রতিপাদ্য অনেকটা প্রার্থনা সংগীতের মতো। করোনা মহামারির কারণে আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ছন্দ হারিয়ে গিয়েছিল। মহামারি কাটিয়ে আমাদের জীব পুনরায় স্বাভাবিক ছন্দে ফিরেছে। সেই স্বাভাবিকতা ধরে রাখার প্রত্যাশায় ‘নির্মল করো, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে’-চরণটিকে এবারের শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য করা হয়েছে।


প্রতিবেদক, বাংলাদেশ দর্পণ