প্রত্নতাত্বিকরা আবিস্কার করেছেন, হরপ্পা সভ্যতা যিশুখ্রিস্টের জন্মেরও ৭০০০ বছর আগেকার। ৪০০০ বছর আগে এই সভ্যতা উৎকর্ষতার শীর্ষে উঠে হঠাৎই রহস্যজনকভাবে ধ্বংস হয়ে যায়। এই হরপ্পাই ছিল প্রথম ভারতীয় আরবান সিভিলাইজেশন। এই সভ্যতা নির্মাণে তথাকথিত বহিরাগত আর্যদের কোন ভূমিকাই ছিল না।

হরিয়ানার রাখিগড়িতে, হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের ২২ মিটার নিচে পাওয়া ৪৫০০ বছরের পুরনো নরকঙ্কালের Petrous Bone’-এ পাওয়া ডিএনএ রিপোর্ট কি দিতে চলেছে চাঞ্চল্যকর কোনও ঐতিহাসিক তথ্য? যা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হলে কেঁপে যাবে ভারত আর ভারতের ইতিহাস? ভারতের ইতিহাস এক ঐতিহাসিক মোড় নেবে, যা ছিল কল্পনার অতীত? সম্প্রতি একটি সর্বভারতীয় কাগজে  হেডলাইন ছিল, "হরপ্পার ধ্বংসাবশেষ রাখিগড়ি। ডিএনএ পরীক্ষা বলছে তাতে মধ্য এশিয়ার চিহ্ন নেই। আর্য আগ্রাসনের তত্ত্ব কি বাতিল?”

রাখিগড়ির খননক্ষেত্রে পাওয়া নরকঙ্কাল

কারা ছিলেন হরপ্পা সভ্যতার মানুষ? জে. জি. স্যাফার ও ডি. এ. লিচেনস্টাইনের মতে, হরপ্পা সভ্যতার মানুষরা হল “ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের ঘগ্গর-হাকরা উপত্যকার বাগোর, হাকরা ও কোটি ডিজ সম্প্রদায় বা ‘জাতিগোষ্ঠী’ সংমিশ্রণ। কিন্তু এই চিন্তা ভাবনার গোড়ায় কি এবার কুড়ুল মারতে চলেছে হরিয়ানার রাখিগড়ির এক নরকঙ্কাল! বিশ্বজুড়ে যার প্রত্নতাত্বিক পরিচিতি আই-৪৪১১হিসেবে!

গত দেড় দশক ধরে রাখিগড়ির নাম ভারতের স্কুলের পাঠ্যপুস্তক, পর্যটন দফতরের লিফলেট এবং সাংবাদিকদের কলামে কলামে ঘুরছে। রাখিগড়ি হলো হরপ্পা সভ্যতার সবচেয়ে বড় খননক্ষেত্র। যেটির অবস্থান ভারতে। ২০১৪ সালে  শোনা যায় এই রাখিগড়ি, ১৯২০ সালে পাকিস্তানের সিন্ধুপ্রদেশে আবিষ্কৃত মহেঞ্জোদাড়োর চেয়েও অনেক বড়। যদিও রাখিগড়িতে খননের কাজ শুরু হয় অনেক পরে, ১৯৬০ সাল থেকে।

রাখিগড়িতে পাওয়া হরপ্পা সভ্যতার মানুষদের জিনিসপত্র

 

রাখিগড়ির খননক্ষেত্র

৪৫০০ বছর বয়সী হরপ্পা মানবের করোটিতে প্রাপ্ত ডিএনএ-এর বহু প্রতীক্ষিত ফলাফল আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশিত না হলেও কিছুটা ফাঁস হয়ে গেছে।  ডিএনএ পরীক্ষায় হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে মধ্য এশিয়ার কোনও যোগসূত্র মেলেনি। সুতরাং, হরপ্পা সভ্যতায় র্আয আগ্রাসন  থিওরি  নস্যাৎ হতে চলেছে।  কারণ ডিএনএ পরীক্ষায় সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্যটি হল— হরপ্পা মানবের ডিএনএটিতে জেনেটিক মার্কার R1a1 বা আর্য জিনের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি।

ধারণাকৃত আর্যদের আদি বাসভূমি পন্টিক স্তেপ্‌

R1a1 নামক জিনটি তাম্রযুগের সেই মানুষদের মধ্যে দেখা গিয়েছিল, যাদের মাতৃভূমি ছিল মধ্য এশিয়ার পন্টিক স্তেপ্ (Pontic Steppe) তৃণভূমি। যেটির  অবস্থান কৃষ্ণসাগর ও কাসপিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে । যারা  প্রায় ৪০০০ বছর আগে ছড়িয়ে পড়েছিলো। তাদের জিনের বৈশিষ্ট্য বলেছিল, তারা পরিশ্রমী, শক্তপোক্ত গড়নের এবং পিতৃতান্ত্রিক। তারাই উত্তর ইউরোপের সঙ্গে উত্তর ভারতের ভাষাগত (ইন্দো-ইউরোপীয়) মিলন ঘটিয়েছিল। কিন্তু ঐতিহাসিকরা আগেই বলেছিলেন হরপ্পা সভ্যতা নির্মাণে এই R1a1 জিনের অধিকারী মানুষ বা আর্যদের বিন্দুমাত্র অবদান ছিল না।

খুঁজে পাওয়া গেছে ৭০০০ বছর পুরনো সভ্যতার নিদর্শন

সর্বভারতীয় পত্রিকাটি  এই বিষয়ে গবেষণারত এক বিজ্ঞানীর উদ্ধৃতি দিয়েছে। তিনি হলেন রাখিগড়ি ডিএনএ প্রজেক্টের  দলনেতা পুণের ডেকান কলেজের ডঃ বসন্ত সিন্ধে। ডঃ সিন্ধে বলেছেন, “রাখিগড়ির  হরপ্পা মানবের ডিএনএ প্রমাণ করছে , এটা পুরোপুরি স্থানীয় ডিএনএ। মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএর সর্বাত্মক উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। যদিও খু্ব সামান্য বৈশিষ্ট্য পেয়েছি , যেগুলি স্থানীয় বৈশিষ্ট্য নয়। তবুও সন্দেহাতীত ভাবে আমাদের কাছে  পরিস্কার হয়ে গেছে  এটি স্থানীয় মানুষেরই ডিএনএ।  সিন্ধে আরও বলেন, “এই ডিএনএ প্রত্নতত্বগত ভাবে  প্রমাণ করছে হরপ্পা সভ্যতার  প্রতিষ্ঠা  আর্যরা করেননি। করেছেন ইণ্ডিজেনাস মানুষেরা। যাঁদের বাইরের সঙ্গে খুবই সামান্য যোগাযোগ ছিল।”

                                                             

রাখিগড়ি ডিএনএ প্রজেক্টের দলনেতা ডঃ বসন্ত সিন্ধে

“আমরা R1a1 নিয়ে এই প্রজেক্টে আলোচনা করিনি”, বললেন রাখিগড়ি ডিএনএ প্রজেক্টের  অন্যতম গবেষক নিরজ রাই। “কারণ ডিএনএ তে R1a1 পাওয়াই যায়নি। রাখিগড়ি ডিএনএ তথ্য থেকে জানা গিয়েছে  আই-৪৪১১ একজন পুরুষ। তবে এটা ঠিক মধ্য এশিয়া থেকে বিশাল এক জনগোষ্ঠী বিভিন্ন দিকে অগ্রসর হয়েছিল। সেই গোষ্ঠীর জিন  দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন গোষ্ঠীর  মানুষের জিনের উপরেও প্রভাব ফেলেছিল। তবে সেই ছাপ হরপ্পা সভ্যতার মানুষদের উপর পড়েনি। এবং আমরা ভারতের মানুষরা মাত্র ১৭.৫ শতাংশ  ‘পন্টিক স্তেপ্’-এর  জিনগত  বৈশিষ্ট্য বহন করছি।” চমকপ্রদ আরেকটি  তথ্য দিয়েছেন প্রত্নতাত্বিক নিরজ রাই। তাকে যখন আমাদের ৪৫০০ বছর বয়েসি পূর্বপুরুষের পরিচয়  নিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়। নিরাজ রাইয়ের সংক্ষিপ্ত উত্তর ছিল,” আই-৪৪১১ এর সঙ্গে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পাওয়া গেছে দক্ষিণ ভারতের নীলগিরি পর্বতাঞ্চলের ইরুলা আদিবাসীদের। এবং সম্ভবত হরপ্পার মানুষরা আদি-দ্রাবিড়ীয় ভাষায় কথা বলতেন।”

দক্ষিণভারতের ইরুলা আদিবাসী

“আমরা জানতাম আর্যরা ভারতে আসার হাজার হাজার বছর আগে থেকেই ভারতে ছিল অত্যন্ত উন্নত এক সভ্যতা। সেই সভ্যতা গড়ে তুলেছিল তৎকালীন  ভারতের উত্তর দিকে বসবাসরত  বাগোর, হাকরা ও কোটি ডিজ সম্প্রদায়।  যে সভ্যতা যিশুখ্রিস্টের জন্মেরও দুহাজার বছর আগে দক্ষিণ এশিয়ায় মানবের শৌর্য, বীর্য এবং বিকাশের প্রতীক হয়ে উঠেছিল । সেই  সিন্ধুসভ্যতা আসলে কাদের, এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিল হরপ্পা মানব? প্রশ্ন উঠে গেল, এত দিন ধরে অভ্রান্ত ভাবা  বিশ্ববরেণ্য ঐতিহাসিকদের ইতিহাস নিয়ে?

              রাখিগড়ি খননক্ষেত্রের আরেকটি অংশ

 

সর্বভারতীয় পত্রিকাটি লিখেছে ,  রাখিগড়ি ডিএনএকে মানুষ ভেবে যদি প্রশ্ন করা হতো, বুঝি এই উত্তর গুলিই পাওয়া যেত।

প্রশ্ন: হরপ্পা সভ্যতাই কি সংস্কৃত ও বৈদিক হিন্দুত্বর জন্মদাতা?
রাখিগড়ি ডিএনএর উত্তর :- না।

প্রশ্ন :  হরপ্পা সভ্যতার মানুষদের জিনের সঙ্গে কি বর্তমান ভারতবাসীর জিনের মিল আছে ? 
রাখিগড়ি ডিএনএর উত্তর : হ্যাঁ অবশ্যই।

প্রশ্ন : জনপ্রিয় মতবাদ অনুযায়ী আর্যদের সঙ্গে হরপ্পার মানুষদের  নিকট সম্পর্ক ছিল। এরাও ছিলেন আর্য। কিন্তু রাখিগড়ি ডিএনএ কি বলছে ?

রাখিগড়ি ডিএনএর উত্তর : আর্যদের সঙ্গে হরপ্পার মানুষদের বিন্দুমাত্র জিনগত সম্পর্কের প্রমাণ মেলেনি। অতি নিকট সম্পর্ক  মিলেছে  দ্রাবিড় গোষ্ঠীর মানুষদের সঙ্গে।

প্রশ্ন : হরপ্পার মানুষদের জিনের সঙ্গে উত্তর না দক্ষিণ ভারতীয়, কোন মানুষদের সঙ্গে জিনগত মিল পাওয়া গিয়েছে ?

রাখিগড়ি ডিএনএর উত্তর: দক্ষিণ ভারতীয়।

৪৫০০ বছর পুরনো হরপ্পা মানব ‘আই-৪৪১১’

সাম্প্রতিককালে চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী এই গবেষণাটি কি ভারত জুড়ে ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটে তীব্র বিতর্ক তুলতে চলেছে ? ভারতের ইতিহাস ও ভারতে ইতিহাস চর্চার মোড় ঘুরিয়ে দিতে চলেছে? ভারতীয় সভ্যতার উৎকর্ষে  উত্তর ভারতের অসামান্য অবদান নিয়ে এত দিনের আত্মশ্লাঘাতেও চূড়ান্ত আঘাত হানতে চলেছে, দক্ষিণভারতীয় জিনের  দ্রাবিড়ীয় হরপ্পা-মানব। অপেক্ষা শুধু রাখিগড়ি ডিএনএ প্রজেক্ট রিপোর্টের আনুষ্ঠানিক প্রকাশের।

দর্পণ / দীপা