অনুসন্ধিৎসু মন, আত্মবিশ্বাস আর নিরন্তন অনুশীলন; এই গুণগুলোর সহাবস্থান যে কোনও মানুষকে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে দিতে পারে। দারিদ্র্য বা উচ্চতর ডিগ্রির অভাব কোনও প্রতিবন্ধকতা হতে পারে না তা প্রমাণ করেছেন শরীয়তপুরের প্রকৃতিবিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য।

বাংলাদেশে কিংবা গোটা ভারতবর্ষে কীটপতঙ্গ-চর্চার পথিকৃৎ তিনি। যিনি পিঁপড়ার প্রণয়, মাকড়শার লড়াই সবই খেয়াল করতেন নিবিষ্ট মনে। তার নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা অচেনাকে চেনার আর অজানাকে জানার আগ্রহ আর আকর্ষণই পরবর্তী সময়ে তাকে বিজ্ঞান সাধনায় অনুপ্রাণিত করেছিল। ফলশ্রুতিতে তিনি পরবর্তীতে এই উপমহাদেশের একজন অন্যতম প্রধান স্বভাববিজ্ঞানী, প্রকৃতিবিজ্ঞানী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।

প্রায় ১২০ বছর আগে ১৮৯৫ সালের ১ আগস্ট পূর্ববাংলার তৎকালীন ফরিদপুর জেলার শরীয়তপুরের (বর্তমানে জেলা) লোনসিং গ্রামে জন্মেছিলেন প্রকৃতি বিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য। বাবা অম্বিকাচরণ ছিলেন নিতান্ত গরীব মানুষ। অম্বিকাচরণ ছিলেন পুরোহিত। গান-বাজনা সংস্কৃতিচর্চাও করতেন। গোপালচন্দ্রের পাঁচ বছর বয়সে তার বাবা মারা যান। প্রতি মুহূর্তে জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করে তাকে চলতে হতো।

তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ১৯১৩ সালে গ্রামের লোনসিংহ স্কুল থেকে জেলার মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে ম্যাট্রিকুলেশনে প্রথম বিভাগে পাস করেন। ১৯১৪ সালে আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হন। শহরে থেকে পড়াশোনার খরচ জোগানো সংসারের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। এদিকে বিশ্বযুদ্ধের ঝাপটা এসে পড়ল। ফলে পাকাপাকিভাবে পড়াশোনা বন্ধ করে গ্রামে যেতে হলো। গ্রামে ফিরে পণ্ডিতসার স্কুলে সহকারী শিক্ষকের পদে ১৬ টাকা বেতনে শিক্ষকতার কাজে যুক্ত হন। স্কুলে পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য বনে-জঙ্গলে ঝোপে-ঝাড়ে, বাঁশবনে, মজা পুকুরে, খাল-নদীতে  প্রকৃতির রহস্য খুঁজতে ঘুরে বেড়াতেন।

ছেলেবেলা থেকেই পিঁপড়া, মাকড়সা, প্রজাপতি প্রভৃতি কীটপতঙ্গের স্বভাব, জীবনযাত্রা প্রণালী, বসতি ইত্যাদি বিষয়ে জানবার ব্যাপারে গোপালচন্দ্রের কৌতূহল‌ ছিল অপরিসীম। আর হয়তো তাই তাঁর মৌলিক গবেষণা ছিল প্রধানত মাকড়সা, পিঁপড়ে, প্রজাপতি, শুঁয়োপোকা, মাছ ও ব্যাঙাচি নিয়ে। পথেঘাটে যেখানে তিনি যেতেন, সব জায়গায় তার তীক্ষ্ণ কৌতূহলী দৃষ্টি পড়তো।

পোকামাকড়েরা কোথায়–‌কী করছে, কী খাচ্ছে প্রভৃতি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন। বসু বিজ্ঞান মন্দিরের গবেষণাগারে স্বাভাবিক পরিবেশ তৈরি ক‌রে তার মধ্যে তিনি মাকড়সা, পিঁপড়ে, প্রজাপতি প্রভৃতি প্রতিপালন করে এদের ওপর পরীক্ষা–‌নিরীক্ষা চালাতেন।

স্কুলে যাওয়ার পথে, রাস্তার পাশে ছোট ছোট পোকামাকড়, তাদের জীবনযাত্রা খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করতেন। তিনি এই সব অভিজ্ঞতা, তার বিস্তারিত পরীক্ষা নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ করে তা লিপিবদ্ধ করতেন এবং প্রবাসী, ভারতবর্ষ, সহ অন্যান্য পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশ করতেন।

ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বিজ্ঞানের প্রতি উৎসাহ সৃষ্টি করা, প্রকৃতির সংস্পর্শে এনে প্রকৃতির প্রতি তাদের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। তিনি বিজ্ঞান ক্লাব গড়ে তুলেছিলেন হাতেকলমে বিজ্ঞানের বিভিন্ন সৃষ্টিকে উপলব্ধি করার জন্য। ১৯১৭ সালে প্রকাশ করেন ‘শতদল’ নামে হাতে লেখা পত্রিকা যা প্রতিমাসেই প্রকাশ হতো। এছাড়াও ‘সনাতন’ নামের একটি পত্রিকার সম্পাদনাও তিনি করতেন।

বিজ্ঞানের মৌলিক গবেষণার প্রতি তার যেমন আগ্রহ ছিল তেমনি তিনি ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা ও আগ্রহ তৈরি করতেন। কীটপতঙ্গের জীবনযাত্রা নিয়ে তিনি পর্যবেক্ষণ করতেন এবং ছাত্রদের প্রশ্নের সহজ ও সরল উত্তর দিতেন।

তার গবেষণার নানাবিধ বিষয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কীটপতঙ্গের গবেষণা। ছোট লাল পিঁপড়ে, নালসে পিঁপড়ে, মাকড়সা, শিকারি মাকড়সা, সাপ, ব্যাং, টিকটিকি, প্রজাপতি, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণী প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তার গবেষণার বিষয় নিয়ে অনেকে দেশে-বিদেশে গবেষণা করে প্রতিষ্ঠিত হন, নোবেল পুরস্কার পান কিন্তু তিনি পাননি। ‘বাংলার কীটপতঙ্গ’ তার অন্যতম সেরা গ্রন্থ। ১৯৩০ সালে বাংলার মাছ খেকো মাকড়সা সম্বন্ধে তার পর্যবেক্ষণ জগদীশচন্দ্র বসুর নজরে পড়ে।

পিঁপড়া অনুসারী মাকড়সা, টিকটিকি, শিকারি মাকড়সা সম্পর্কে বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি, সোসাইটি জার্নাল, আমেরিকার সায়েন্টিফিক মান্থলি, কলকাতার সায়েন্স অ্যান্ড কালচার-এ প্রকাশিত হয়। তার মোট ২২টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়।

গোপালচন্দ্র যখন একা একা তার গবেষণা করে যাচ্ছিলেন, তখন বিজ্ঞানের এই শাখার মূলধারাটি ছিল জার্মানিতে। যদি তিনি এই মূলধারার সঙ্গে মিলে যেতে পারতেন তাহলে তিনি হয়তো সারা বিশ্বে সুপরিচিত নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ত্রয়ী লরেঞ্জ, টিন বার্গেন ও ফন প্রিন-এর সমগোত্রীয় হয়ে যেতেন। তিনি চার্লস ডারউইন, জ্যাঁ অ্যারি ফ্যাবার, ওজিন মারেদের সঙ্গে এক সারিতে অবস্থান করতেন।

গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য সারা জীবনে আট শতাধিক প্রবন্ধ লেখেন। বেশিরভাগ বাংলা পত্র পত্রিকায় যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রবাসী, আনন্দবাজার পত্রিকা, যুগান্তর নতুনপত্র, মন্দিরা, সাধনা, জ্ঞান ও বিজ্ঞান, বঙ্গশ্রী, শিশুসাথী, সন্দেশ, নবারুণ, প্রকৃতি, নতুনপত্র, অন্বেষা, দেশ প্রভৃতি। গোপালচন্দ্র এই উপমহাদেশের বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে অনন্য পথিক।

গোপালচন্দ্র প্রথমে জগদীশচন্দ্র বসু’র সহকারী হিসাবে পরে ‘স্যার জগদীশচন্দ্র বোস স্কলারশিপ’ নিয়ে ১৯২৩ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত টানা প্রায় ৪৮ বছর বসু বিজ্ঞান মন্দিরেই গবেষণার কাজে নিয়োজিত থাকেন।

তার ব্যাঙাচি থেকে ব্যাঙের রুপান্তরে পেনিসিলিনের ভূমিকা নিয়ে এই গবেষণার গুরুত্ব অনুধাবন করে তাকে অবসরের পরও গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তিনি ১৯৫১ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত সামাজিক পতঙ্গ বিষয়ে আলোচনাচক্রে ভারতীয় শাখা পরিচালনার জন্য আমন্ত্রিত হন।

গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য তার জীবনব্যাপী যে সমস্ত বিজ্ঞানের বই লিখেছেন তার মধ্যে অনেকগুলি বিভিন্ন পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছে। তার লেখা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই হল- আধুনিক আবিষ্কার, মহাশূন্যের রহস্য, বাংলার কীটপতঙ্গ, মনে পড়ে, প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ, করে দেখ, রোমাঞ্চকর জীবজগৎ, জীবন নিয়ে যে বিজ্ঞান, জীববিদ্যা, বিষয় উদ্ভিদ, আরও অনেক বই।

ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যেই রয়েছে সৃষ্টির অফুরন্ত উৎস, তাদের মধ্যেই এই শক্তিকে জাগরিত করার মধ্য দিয়েই বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারের উৎসাহ দিতে হবে, যা গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য উপলব্ধি করেছিলেন তার ছোটবেলা থেকেই।

গোপালচন্দ্র পরাধীন দেশের মুক্তিকামী বিপ্লবীদের কাজে সহায়তা করতেন। তিনি গুপ্ত সমিতির জন্য নানা বিস্ফোরক পদার্থের ফরমুলা সরবরাহ করা ছাড়াও অন্যান্য সাহায্য করতেন। গ্রামের অবহেলিত মানুষদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য স্থাপন করেছিলেন ‘কমল কুটির’। বিনা বেতনে সেখানে লেখাপড়া, মেয়েদের হাতের কাজ শেখানো হত। গোপালচন্দ্র সামাজিক কুসংস্কার ও জাতপাতের বিরুদ্ধেও ছিলেন প্রতিবাদমুখর।

সাধারণ মানুষের কাছে বিজ্ঞানকে পৌছে দেওয়ার এই কাজের স্বীকৃতি হিসাবে তিনি ১৯৬৮ সালে লাভ করেন ‘আনন্দ পুরুস্কার’। ১৯৭৪ সালে লাভ করেন আচার্য সতেন্দ্রনাথ বসু ফলক। ১৯৭৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর তাকে দেওয়া হয় জাতীয় সংবর্ধনা। ১৯৭৫ সালে ‘কীটপতঙ্গ’ গ্রন্থের জন্য তিনি পান রবীন্দ্র পুরস্কার। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৮১ সালের ২১ জানুয়ারি তাকে সম্মানসূচক ডক্টর অব সায়েন্স উপাধিতে ভূষিত করে।

১৯৮১ সালের এপ্রিল মাসের ৮ তারিখ প্রকৃতির মহান সাধক গোপালচন্দ্র শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করে।

লেখক: ইসমাইল হোসেন স্বপন, প্রবাসী সাংবাদিক, ইতালি