মার্টিন-বার্ন কোম্পানি। ইংরেজ আমল। ঘরভর্তি সাদা চামড়ার ‘সায়েব’। ‘কালা আদমি’দের অন্য ব্যবস্থা। অন্য ঘর। ওদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে স্কুল-কলেজ। সেসব পাশ করে একঝাঁক কেরানি সায়েবি অফিসে কলম পিষছে। ওরা আর ‘স্যাভেজ’ নেই। এই সবই তো সম্ভব হল ‘কুইন আর লর্ড’দের দয়ায়। কোথায় কৃতজ্ঞ থাকবে, তা না। সারাক্ষণ হুজ্জুতি লেগেই আছে। ইংরেজি শেখানো হয়েছে, কাজ চালানোর জন্য। ব্যাকরণ ভুল করে মাঝে মধ্যে। সেই ভুলের সুযোগ নিয়ে ‘ডার্টি নিগার’ বলাটাই তো মালিকপক্ষের রেয়াজ! হাজার হোক, প্রজাদের স্থান ইংরেজ বুটের নিচে।

কিন্তু এই ‘বেঙ্গলি-বাবু’রা বসতে দিলে শুতে চায়। তেমনই একজন ঢুকে পড়েছেন মার্টিন বার্নের অফিস লাইব্রেরিতে। সায়েবদের জন্য সংরক্ষিত লাইব্রেরিতে কালা আদমি ঢুকবে, এ চলতে দেওয়া যায় না! তৎক্ষণাৎ তাঁকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল পেয়াদা। লাইব্রেরিয়ানের মুখ থেকে বাছা বাছা বিশেষণ উড়ে এল ‘নেটিভ’ বাবুটির দিকে। 

অপমান হজম করতে পারেননি, মার্টিন বার্নের সেই কর্মচারী প্রফুল্লকুমার দে সরকার ওরফে পি-কে-দে সরকার। চাকরিটাই দিলেন ছেড়ে। তারপর অঙ্কের বই মানে কেশবচন্দ্র নাগ। আর বাঙালিকে ইংরেজি ব্যাকরণ শিখিয়েছেন পিকে দে সরকার। প্রজন্মের পর প্রজন্ম, তাঁর লেখা ‘A textbook of Higher English Grammar, Composition, and Translation’ ঘষটে পেরিয়েছে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি।

A textbook of Higher English Grammar, Composition, and Translation (নতুন সংস্করণ) 

পিকে দে সরকারের গ্রামার বই, গ্রাম-মফস্সল-শহরতলীর ছাত্র-ছাত্রীদের বাইবেল। যারা ইংরেজিটায় একটু কাঁচা, যাদের ভুল হয়ে যায় প্রিপোজিশন-কনজানকশনে, হেডমাস্টারকে ‘ফর্মাল লেটার’ লিখতে গিয়ে হিমশিম খায়, তাদের জন্যই লিখেছেন প্রফুল্ল সরকার। বলা বাহুল্য আজও এই বইয়ের চাহিদা বিপুল। কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলের প্রতিটি দোকানে শোভা পায়, ‘...Higher English Grammar, Composition, and Translation.’ওপার বাংলায়, রংপুরে জন্ম।

১৯১১ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে ইংরেজিতে এমএ করবেন বলে ভর্তি হলেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেকালে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তরের সুযোগ, হাতের মোয়া মোটেই ছিল না। দস্তুরমত দখল রাখতে হত ভাষাটির উপর। আর কলকাতায় এমএ পড়ার খরচ চালাতে, অনেকেই চাকরি করতেন। প্রফুল্লবাবুও মার্টিন-বার্ন-এ ঢুকেছিলেন। অপমানিত হয়ে বেরিয়ে এলেন, কিন্ত দমে যাননি। বুকে বইছে কাঠ বাঙাল রক্ত। শুরু করলেন স্কুলে শিক্ষকতা। রাজশাহীর ভোলানাথ বিশ্বেশ্বর হিন্দু একাডেমি স্কুলে ছিলেন প্রধানশিক্ষক। ছোট্ট স্কুলটির ছাত্র সংখ্যা বাড়তে থাকে ধীরে ধীরে। শিক্ষকমহলে নাম ছড়িয়ে পড়ে সরকার মহাশয়ের।

পড়াতে পড়াতে লক্ষ্য করছিলেন, অধিকাংশ বাঙালি ছাত্ররা দুর্বোধ্য ব্রিটিশ ‘নেসফিল্ড’-এর পাঠোদ্ধার করতে গিয়ে কাহিল। সমাধান বেরোলো ১৯২৬-এ। পিকে দে সরকারের গ্রামার বই, নেসফিল্ডকে ছাপিয়ে বাজারে হট-কেক। প্রতিবছর পাল্টে যেত সংস্করণ। সময়োপযোগী সংশোধন রাখতেন তিনি। 

১৯৪৮-এ দেশভাগের পর ওপার বাংলা ছেড়ে, স্ত্রী-ছেলেমেয়ের হাত ধরে কলোনি সংলগ্ন এলাকায় বাসা বাঁধলেন পিকে দে সরকার। নতুন জীবন শুরু হল। ভূঁইফোঁড়ের জীবন। যেদিন চলে এসেছিলেন, কেঁদেছিল রাজশাহীর মানুষ। ধর্ম নির্বিশেষে। প্রাণের চেয়ে প্রিয় ‘মাস্টারমশাই’কে তারা যেতে দিতে চায়নি।

স্থায়ী চাকরি না করে, রয়্যালটির টাকাতে চলেছে অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা। চাহিদা বলতে ছিল না কিছুই। কেবল প্রকাশকদের কাছ থেকে উপহার পেতেন ক্রিকেট ম্যাচের টিকিট। দুই ছেলে আর দুই মেয়েকে মানুষ করেছিলেন। তাঁরা কেউ অবিশ্যি ইংরেজি নিয়ে পড়েননি। মেয়েদের বিজ্ঞান পড়তে পাঠিয়েছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। তারা থাকত বাড়ির বাইরে। হস্টেলে। রক্ষণশীল সমাজে এমন ঘটনা বড়ো একটা দেখা যায় না। ৮২ বছর বয়স অবধি কাট-ছাট করে গিয়েছেন ব্যাকরণ নিয়ে মৃত্যুর ৪৪ বছর পর, আপামর ভারতবাসীকে ইংরেজি শিখিয়ে চলেছেন পিকে দে সরকার। তাঁর ‘বাইবেল’ আসাম-মেঘালয়-মণিপুরেও সমান জনপ্রিয়। 

বাঁকুড়ার গ্রাম থেকে বিসিএস দিতে আসা ছেলেটা কলেজ স্ট্রিটের দোকানে খোঁজ করছে ভালো ‘ইংরেজি মানে বই’। আর নানা দেশী-বিদেশী কোয়েশ্চন ব্যাংকের তাক হাতড়ে দোকানি ধরিয়ে দিচ্ছেন, প্রায় একশো বছর পুরোনো, লাল মলাটের বইটা। কিছু জিনিস থেকে তো যাবে শিক্ষাব্যবস্থার শেষ দিন অবধি! থাকবেন মাস্টারমশাই, বইয়ের পাতায়।