হিন্দুধর্মে ভগবান একজন নয়, অনেক। তাহলে হিন্দুধর্ম একেশ্বরবাদী ধর্ম হয় কী করে? স্পষ্টত হিন্দুদের উপাস্য অনেক, ভগবানের সংখ্যাও অগণিত। সুতরাং হিন্দুধর্মকে একটি বহুঈশ্বরবাদী ধর্ম বললে কি ভুল হবে? এমন প্রশ্ন অনেক অহিন্দুই করে থাকেন। অনেক হিন্দুও এ বিষয়ে দ্বিধান্বিত। এমনকি এরকম প্রশ্ন করলে অনেক হিন্দুই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন।

এই দ্বন্দ্বের নিরসনের শুরুতেই হিন্দুদের কয়েকজন ভগবানের পরিচয় জেনে নেওয়া যাক।

১। ভগবান শ্রীহরি: শ্রীহরির অনেক নাম। এর মধ্যে বিষ্ণু, নারায়ণ, মাধব, মধুসূদন, কেশব, মুকুন্দ ইত্যাদি প্রতিটি নামের আগেই ভগবান বিশেষণ প্রযোজ্য। ভাগবত পুরাণ, বিষ্ণুপুরাণসহ প্রচুর শাস্ত্রে ভগবানরূপে তারই উপাসনা ও গুণকীর্তন করা হয়েছে। হরিনাম কীর্তন, জপ ও প্রচার করা কলিযুগে প্রধান ধর্ম বলে বিবেচিত হয়।

২। ভগবান শিব: শিবকে মহেশ্বর বা দেবাদিদেব বলা হয়। শাক্ত, শৈব ও তান্ত্রিক মতে শিবই পরমেশ্বর। কিন্তু বৈষ্ণবীয় শাস্ত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শ্রীহরিকে চূড়ান্ত ঈশ্বররূপে এবং কিছু গ্রন্থে শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর মানা হয়। ভাগবত পুরাণসহ অনেক বৈষ্ণবীয় শাস্ত্রে শিবকেও ভগবান বলা হয়েছে।

৩। ভগবান পরশুরাম: ভগবান বিষ্ণুর অবতার। ভাগবত পুরাণ, মহাভারতসহ অনেক শাস্ত্রে তাকে ভগবান বলে অভিহিত করা হয়েছে। বিষ্ণুর প্রতিটি অবতারই ভগবান পদবাচ্য।

৪। ভগবান শ্রীরাম: রামায়ণের প্রাণপুরুষ এবং ভগবান বিষ্ণুর অবতার। কোটি কোটি হিন্দু ভগবান শ্রীরামের ভক্ত। শ্রীরামকে প্রকৃষ্ট সুশাসন ও উত্তম মানব চরিত্রের আদর্শ পুরুষ হিসেবে মান্য করা হয়।

৫। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ: ভগবান বলে অধুনা যিনি সর্বাধিক জনপ্রিয়, তিনি মহাভারতের মহাপ্রাণ শ্রীকৃষ্ণ। মহাভারতে মহামহিম ভীষ্ম শ্রীকৃষ্ণকে ভগবান বলে প্রথম ঘোষণা দেন। এরপর হরিবংশ, ভাগবত পুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণসহ অজস্র বৈষ্ণব শাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণকে ভগবান হিসেবে মান্য করা হয়। বলা হয় ‘কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ং’ অর্থাৎ কৃষ্ণই স্বয়ং ভগবান। বাকিরা পূর্ণ ভগবান নয়। কিছু গ্রন্থে কৃষ্ণকে বিষ্ণুরও ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়েছে এবং তাকে ‘অনাদিরাদি গোবিন্দ’ ও ‘সর্বকারণকারণম্’ বলা হয়। অর্থাৎ একেশ্বররূপে চূড়ান্তভাবে শ্রীকৃষ্ণকেই গ্রহণ করা হয়েছে। এমনকি সকল দেবদেবী এবং দেবাদিদেব মহাদেবকেও কৃষ্ণের অধীনস্থ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

৬। ভগবান বলরাম: বৈষ্ণব সাহিত্যে শ্রীকৃষ্ণের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলরামকেও শ্রীবিষ্ণুর অবতার এবং ভগবান বলে অভিহিত করা হয়েছে।

৭। ভগবান বুদ্ধ: সিদ্ধার্থ বা গৌতম বুদ্ধকে হিন্দুরা শ্রীবিষ্ণুর অবতার হিসেবে শ্রদ্ধা করেন। বুদ্ধকে হিন্দুরা মহান সমাজ সংস্কারক হিসেবে মান্য করেন। বুদ্ধ নিজে আজীবন হিন্দু ছিলেন এবং সুসংহতভাবে সনাতন ধর্ম প্রচার করেছেন। তাই হিন্দুরা গৌতম বুদ্ধকে ভগবান বলে অভিহিত করেন।

৮। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য: অনেক আধুনিক বৈষ্ণবীয় গ্রন্থে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য বা নিমাইকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অবতার রূপে বিশ্বাস করা হয়েছে এবং ভগবান বলা হয়েছে। প্রভু নিত্যানন্দকেও ভগবান বলরামের অবতার মানা হয়। বৈষ্ণবদের প্রতিষ্ঠিত মহাপ্রভুর অনেক মন্দির রয়েছে এবং সেখানে মহাপ্রভু ও নিত্যানন্দকে উপাস্য হিসেবে পূজা করা হয়।

৯। শ্রীরামকৃষ্ণ: রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের নিজস্ব গ্রন্থগুলোতে রামকৃষ্ণকে অবতার রূপে বর্ণনা করা হয়েছে এবং ভগবান বলে অভিহিত করা হয়েছে। মিশনের মন্দিরে রামকৃষ্ণকেই ভগবান বলে পূজা করা হয়।

১০। শ্রীহরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ: বাংলাদেশে পিছিয়ে পড়া হিন্দু জনগোষ্ঠীর মহান পরিত্রাতা শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর তার শীষ্যদের মহাপ্রভু প্রবর্তিত যুগধর্ম হরিনামে মাতোয়ারা রাখতেন। তাই তার অনুসারীদের মতুয়া বলা হয়। মতুয়ারা শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুরকে ভগবান নয়, ‘পূর্ণব্রহ্ম’ বলে বিশ্বাস করেন। আর হরিচাঁদ ঠাকুরের সন্তান ও সমাজ সংস্কারক গুরুচাঁদ ঠাকুরকে ‘ভগবান’ বলে অভিহিত করা হয়। হরিচাঁদ ঠাকুর তার অনুসারীদের হরিমন্দির প্রতিষ্ঠা করার কথা বলেছিলেন। তার শীষ্যরা শ্রীহরি বলতে শ্রীবিষ্ণুকে নয়, হরিচাঁদ ঠাকুরের মন্দির প্রতিষ্ঠা ও পূজা করে থাকেন। সেখানে ‘ভগবান’ গুরুচাঁদ ঠাকুরেরও পূজা হয়।

১১। ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র: বাংলাদেশে প্রচুর হিন্দু আছেন যারা অন্যান্য দেবদেবীর পাশাপাশি তাদের গুরুদেব ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রকে উপাস্য ভগবান হিসেবে পূজা করেন। তাদের মন্দিরেও ইষ্ট দেবতা হিসেবে রয়েছে অনুকূল ঠাকুরের মূর্তি বা চিত্রপট। তারা অনুকূল ঠাকুরকে ‘পুরুষোত্তম’ হিসেবে বিশ্বাস করেন। গীতায় পুরুষোত্তম বলতে শ্রীকৃষ্ণ পরমাত্মা বা পরব্রহ্মকে বুঝিয়েছেন।

১২। লোকনাথ ব্রহ্মচারী: আর দশজন ধর্মগুরুর মতো লোকনাথ ব্রহ্মচারী কোনো ধর্মগুরু ছিলেন না। তিনি ৯০ বছর বয়সে যোগসিদ্ধ হন এবং ১৬০ বছর বয়স বর্যন্ত বাংলাদেশ ভূখণ্ডেই বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন। তার অনেক অনুরাগী ভক্ত তৈরি হয়। দীক্ষিত শিষ্য না হলেও এখনও প্রচুর ভক্ত রয়েছে তার। ভক্তরা তাকে ভগবান বলেই ভক্তি করেন। মন্দিরে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর পূজা করা হয়।

১৩। প্রভু জগদ্বন্ধু: মানবকল্যাণে অনেক ভূমিকা রাখা আরেকজন ধর্মগুরু হলেন প্রভু জগদ্বন্ধু। তাঁর শিষ্য ও ভক্তরা তাকে ভগবান শ্রীহরির অবতার হিসেবে বিশ্বাস করেন। তাদের মন্দিরে জগদ্বন্ধুর পূজা করা হয়।

১৪। রামঠাকুর: রামঠাকুরের শিষ্যরাও তাঁকে ভগবান নারায়ণের অবতার হিসেবে বিশ্বাস করেন। তাদের মন্দিরে রামঠাকুরকে পূজা করা হয়।

এছাড়াও হিন্দুশাস্ত্রে উল্লিখিত দেবতাদের ভগবান বলা হয়। গণেশ, দুর্গা বা কালী, ইন্দ্র, অগ্নি, সূর্য, পবন প্রমুখ সকল দেবতাই ভগবান বা ভগবতী পদবাচ্য। বাংলাদেশের হিন্দুদের কাছে পরিচিত ভগবান মূলত এঁরাই।

এর বাইরে আরও অসংখ্য ধর্মগুরু রয়েছেন। তাঁদের অনেকেই তাদের শিষ্যদের কাছে ভগবান হিসেবে পূজিত হয়ে থাকেন। ফলে ভগবানের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। যদিও ব্রিটিশ আমলের আগে মুসলিম শাসনামলে এত এত ধর্মগুরু ভগবান হয়ে ওঠেননি। কিন্তু মুসলিম শাসন শেষ হতেই ভগবানে ভরে যেতে থাকে উপমহাদেশে, বিশেষত বঙ্গে।

বাংলাদেশের গণ্ডির বাইরে প্রতিবেশী ভারতের শত কোটি হিন্দুদের মধ্যে আরও অগণিত ভগবানকে নানান রূপে ও নামে পাওয়া যাবে। সুতরাং হিন্দুদের ভগবানের সংখ্যা অসংখ্য।

বলা হয়, হিন্দুদের তেত্রিশ কোটি দেবতা। তবে বাস্তবে ৩৩ কোটি বা ৩,৩০০ লক্ষ দেবতার নাম কোনো শাস্ত্রে নেই, জগতেও নেই। মূলত সংস্কৃত শব্দ ‘কোটি’র অর্থ ‘প্রকার’। ৩৩ কোটি মানে ৩,৩০০ লক্ষ নয়। ৩৩ কোটি বলতে যে ৩৩ প্রকার দেবতার কথা বলা হয়েছে, এটাও জানেন না অধিকাংশ হিন্দুগণ। দেবতাদেরও ভগবান বলে অভিহিত করা হয়। 

এত এত ভগবানসমৃদ্ধ হিন্দুধর্মকে একেশ্বরবাদী বলা কতটা যৌক্তিক তা সত্যিই প্রশ্নের সম্মুখীন করে। তবে এই জটিল সংকটের সহজ সমাধান আমরা পাই বেদে। বেদ খুব সহজেই এই দ্বন্দ্বের নিরসন করে একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠা করেছে, ঘোষণা করেছে ঈশ্বর ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’।

চলবে...

লেখক: মাণিক রক্ষিত, সাংবাদিক, যোগ প্রশিক্ষক ও ধর্মগবেষক