কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার আচমিতা ইউনিয়নের ভোগবেতালে অবস্থিত ঐতিহাসিক শ্রীশ্রীগোপীনাথ মন্দির। প্রাচীন বাংলার ঐতিহাসিক এই মন্দিরটি এই অঞ্চলের সনাতন ধর্মালম্বীদের এক জনপ্রিয় তীর্থস্থান। স্থানীয়দের নিকট এ মন্দিরটি ‘গোপীনাথ বাড়ি’ নামেই বহুল পরিচিত।
সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় স্বপ্নাদৃষ্ট হয়ে ১৫৮৫ খ্রীষ্টাব্দে এই মন্দির নির্মাণ করেন। কিংবদন্তী আছে, ‘ঊড়িষ্যার শ্রীশ্রীজগন্নাথ, বঙ্গের শ্রীশ্রীগোপীনাথ’। মন্দিরে প্রায় ষোড়শ শতাব্দী থেকে শ্রীশ্রীগোপীনাথ, ভ্রাতা শ্রীশ্রীবলরাম ও ভগ্নী শ্রীশ্রীসুভদ্রার সেবা-পূজা আজও চলে আসছে।
জনশ্রুতিতে আছে, ষোড়শ শতকের বাংলার বার ভূঁইয়ার অন্যতম এবং প্রধান ভাটি রাজ্যের অধিপতি ঈশা খাঁ তাঁর এগারসিন্দুর দূর্গ হতে মন্দির সংলগ্ন রাস্তা দিয়ে জঙ্গলবাড়ি যাওয়ার পথে থেকে মন্দিরের ভোগ আরতির ভোগের সুঘ্রাণে মুগ্ধ হয়ে যাত্রা বিরতি করেন এবং এই মন্দিরের আতিথেয়তা গ্রহণ করেন।
আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে জঙ্গলবাড়ীর দেওয়ান বীর ঈশা খাঁ মন্দিরের জন্য লাখেরাজ জমি দান করেছিলেন। আর তখন থেকেই এলাকার নামকরণ করা হয় ভোগবেতাল।
১৫৯৫ সালে এগারসিন্দুর দূর্গে ঈশা খাঁ সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহ কর্তৃক এগারসিন্দুর দূর্গে অবরুদ্ধ হন। আকবরের বিজয়ী সৈন্যরা বিজয় উল্লাস করেন বর্তমান রথমেলার প্রশস্থ রাস্তায়। ১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দে এক প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে মূল মন্দিরটির তৎকালীন পঞ্চরত্নসহ বিধ্বস্ত হয়।
ষোড়শ শতকের দিকে কিশোরগঞ্জের কবি নিত্যানন্দ দাসের প্রেমবিলাস গ্রন্থে পাওয়া যায়, সনাতন ধর্ম সংস্কারক মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব পাকুন্দিয়ার এগারসিন্দুর হয়ে আচমিতার বৈষ্ণব লক্ষ্মীনাথ লাহিড়ীর আতিথ্য গ্রহণ করেন। ৩/৪ দিন ভোগবেতাল মন্দিরে নাম সংকীর্তন পরিবেশন করেছিলেন। ১২১৭ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত বাংলা পত্রিকা ‘উদ্বোধন’ -এ বিশ্বেশ্বর দাশগুপ্তের লেখা প্রতিবেদনেও তৎকালীন গোপীনাথ বাড়ী সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য ধারণা করা যায়।
জানা যায়, প্রায় ৪২০ বছর পূর্বে শ্রীশ্রীগোপীনাথ মন্দিরের কাছে বাউল সাগর নামক নদীতে বিভিন্ন জায়গা থেকে বজরা এবং নৌকার বহর আসত। এককালে মন্দিরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হতো এই বাউল সাগর নদী।
জনশ্রুতিতে রয়েছে, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের সমসাময়িক তাঁরই এক জগন্নাথদেব নামক পুরীনিবাসী ভক্ত এক রাতে স্বপ্ন দেখেন তার স্বগৃহে প্রতিষ্ঠিত গোপীনাথ বিগ্রহ তাকে বলছে, 'জগন্নাথ, তুমি আমাকে নিয়ে তুমি দক্ষিণ দেশে যাও এবং প্রেম ধর্ম প্রচার কর’।
জগন্নাথ পরদিনই কালো কাঠ খোদাই ছোট বিগ্রহটি কাপড়ে জড়িয়ে দক্ষিণ দেশে রওনা হন। প্রায় মাসাধিককাল পথ চলার পর একরাতে জগন্নাথ আবার স্বপ্ন দেখেন, গোপীনাথ বলছে, জগন্নাথ আর যেও না, এখানে আমাকে প্রতিষ্ঠা করে প্রেমধর্ম প্রচার কর। ঘুম থেকে জেগে জগন্নাথ চিন্তায় পড়েন। এই গভীর অরণ্যে তিনি কী করে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করবেন!
এই স্থানটি গভীর বনে আচ্ছাদিত থাকলেও অতি নিকটেই এ অঞ্চলের সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায়ের প্রাসাদ বাড়ি। জগন্নাথ রাজা নবরঙ্গ রায়ের প্রাসাদ বাড়িতে গমন করেন এবং বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার জন্য রাজার সহযোগিতা চান। রাজা নবরঙ্গ রায় বিগ্রহ মন্দিরসহ বেশ কয়েকটি ভবন নির্মাণ করে দেন।
কিশোরগঞ্জের গোপীনাথ বাড়ির ভূমির পরিমাণ ২৫ একর ৮ শতাংশ। ৪২০ বৎসর পূর্বে পূর্ববঙ্গে সর্বপ্রথম ও সর্ববৃহৎ রথযাত্রা শুরু হয়। ১০৫ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন ৩২ চাকার রথ ১ কি.মি. দীর্ঘ নিজস্ব সড়কে গুন্ডিচাবাড়িতে (শ্বশুরবাড়ি) মন্দির থেকে গোপীনাথ মন্দির পর্যন্ত ভক্তবৃন্দ আনা-নেয়া করতেন।
তিনটি রথের একটি পিতলের অন্য দুটি কাঠের তৈরি। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মধ্যে এটিই একমাত্র দূরপাল্লার রথযাত্রা।
কালক্রমে ২৪, ১৬ এবং বর্তমানে ৯ চাকার রথটি তৈরি হয়েছে। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত হতে অসংখ্য দর্শনার্থী ও পূণ্যার্থী এই ঐতিহাসিক নিদর্শন পরিদর্শনে আসেন। এখানে বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন ধরণের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
এখানে প্রতিবছর মহাসমারোহে রথযাত্রা উৎসবসহ দোলযাত্রা, রাসযাত্রা, জন্মাষ্টমী, শিবরাত্রি, ঝুলনযাত্রা ও বাসন্তীপূজাসহ নিত্য পূজাপার্বণ অনুষ্ঠিত হয়।
এখনো অতীত কারুকার্যের স্মৃতি আর বিভিন্ন দালান নিয়ে কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শ্রীশ্রীগোপীনাথ মন্দিরটি লোক ঐতিহ্য আর কালের সাক্ষী হয়ে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। সরকারের আরো সুদৃষ্টি হলে এ ঐতিহাসিক মন্দিরটি দেশের অন্যতম ধর্মীয় ও দর্শনীয় স্থানে পরিণত হবে। তবে ইদানীং এলাকার কিছু ভূমিদস্যুর দ্বারা বাংলার প্রাচীন এই ঐতিহাসিক পুণ্যভূমির বহু জমি বেদখল হয়ে গেছে।
অর্জুন কর্মকার, কিশোরগঞ্জ