শিতাংশু গুহ, ৩১শে আগষ্ট ২০২০, নিউইয়র্ক।। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখার্জী চলে গেলেন। বাংলাদেশের অকৃত্তিম বন্ধু ছিলেন তিনি। তাঁর শোকে বাঙ্গালী শোকাভিভূত। তিনি নড়াইলের জামাই, ভারতের রাষ্ট্রপতি হলে নড়াইলের মানুষ আনন্দে মিষ্টি বিতরণ করেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র সাথে তাঁর ছিলো পিতা-পুত্রী সম্পর্ক। জননেত্রী শেখ হাসিনা'র জন্যে তিনি ছিলেন আশীর্ব্বাদ। শেখ হাসিনা এই সম্পর্কটি সুন্দর, সফলভাবে কাজে লাগিয়েছেন। ভারতে প্রথমবার বিজেপি ক্ষমতায় এলে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক নিয়ে অনেকে চিন্তিত ছিলেন, প্রণব মুখার্জি’র এ সম্পর্ক অটুট রাখতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখেন।
হয়তো বাঙ্গালী বলে এই সজ্জ্বন ভদ্রলোকের সাথে আমার একটি চমৎকার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো। গত দুই দশক তাঁর সাথে বহুবার দেখা করার সুযোগ হয়েছিলো। বাংলাদেশের বেশ কিছু নেতাকেও তাঁর সাথে ঘনিষ্ট হতে সাহায্য করেছিলাম। প্রয়াতঃ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত’র মন্ত্রী হবার পেছনে প্রণব মুখার্জির আশীর্ব্বাদ ছিলো। সজীব ওয়াজেদ জয় আমাদের সাথে ছোট্ট একটি বৈঠকে বলেছিলেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মন্ত্রী হবেন না! এরপর জয়-কে রাজি করাতে পারতেন দু’জন লোক, এর একজন প্রণব মুখার্জি। ২০০৮ সালে ২৭জুলাই সজীব ওয়াজেদ জয়ের ভার্জিনিয়ার বাসায় জননেত্রী শেখ হাসিনা আমায় বলেছিলেন, দাদা’র সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখতে। আমৃত্যু তা রেখেছিলাম।
দাদার সাথে প্রথম ও শেষ দেখার কথা আমার মনে আছে। প্রথম দেখা সুখকর হলেও শেষ দেখাটি তা ছিলোনা। গতবছর অর্থাৎ ২০১৯’র ২৮ নভেম্বর দিল্লিতে দাদার সাথে আমাদের দেখা হয়। তদীয় পুত্র অভিজিৎ মুখার্জী কলকাতা থেকে দিল্লিতে মিটিংয়ের ব্যবস্থা করে দেন। ২০১৪’র এপ্রিলে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর সাথে সাক্ষাতের পর ২০১৯’র শেষ বৈঠক। ২০১৭-তে আমি ৪দিনের জন্যে দিল্লি গেলেও দাদা’র সাথে দেখা হয়নি, বা দেখা করার জন্যে এপয়েন্টমেন্ট চাইনি, কারণ আমি তখন দাদার প্রতি কিছুটা অভিমান, ক্ষোভ, যে দাদা আমাদের, মানে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের জন্যে কিছু করেননি।
দাদা, ছোট-বড় সবার দাদা। তিনি বিদেশমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী বা প্রতিরক্ষামন্ত্রী থাকাকালে যতবার নিউইয়র্কে এসেছেন বা আমি দিল্লি গেছি, প্রায় প্রত্যেকবার দাদার সাক্ষাৎ পেয়েছি। নিউইয়র্কে একবার দাদার সাথে দেখা করার জন্যে এপয়েন্টমেন্ট চাইলাম, তখন তিনি বিদেশমন্ত্রী। মন্ত্রীর অফিস জানালো মাত্র ৩জন? আমরা গেলাম ৮জন। অফিস ৩জনের বেশি দেবেনা। বললাম, দাদাকে বলুন, আমরা সবাই আসবো। অফিসার গেলেন, ফিরে এসে জানালেন দাদা অনুমতি দেননি, একটু পর হেসে বলেন, আপনি প্রথা ভেঙ্গে দিয়েছেন, স্যার সবাইকে যেতে বলেছেন, আমরা গেলাম।
রাষ্ট্রপতি থাকাকালে বৈঠকের কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। অনেক কষ্ট করে অতীত বহু মিটিংয়ের প্রসঙ্গ টানার পর সাক্ষাতের অনুমতি পাই। আমরা প্রায় এক ডজন দেশের এক কুড়ি নেতাদের নিয়ে যাই। বিশাল ব্যবস্থা, বৈঠকের শুরু ও শেষে আপ্যায়নের সু-ব্যবস্থা। ভারতের সুবিশাল রাষ্ট্রপতি ভবনে ঢোকার সুযোগ হলো। শুরুতে রাষ্ট্রপতির সেক্রেটারী আমায় ডাকলেন। বললেন, পা-ধরে প্রণাম করা যাবেনা। সময় বিশ মিনিট। বললাম, ঠিক আছে। আমরা সবাই অপেক্ষমান, দাদা মিটিং ঘরে ঢুকলেন, সবাই দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে দাদাকে নমস্কার জানালেন। দাদা প্রত্যুত্তরে একই কায়দায় সবাইকে নমস্কার জানান।
দাদা বসলেন। প্রেসিডেন্টের ফটোগ্রাফার ছবি তুললেন। আমাদের সাথে ৪/৫জন মহিলা ছিলেন। তাঁরা অত্যন্ত আবেগ দিয়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কথা জানালেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি স্বয়ং আবেগে আপ্লুত হলেন। তিনি সবার কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। বললেন, আমি দেখছি কি করা যায়। কেউ কেউ তারসাথে দাঁড়িয়ে ছবি তুললেন। মিটিং চললো ৪৫মিনিট। দাদা চলে গেলেন। আমরা তখন আবার স্ন্যাক্স খেতে শুরু করলাম। সবাই খুশি। খানিক পর একজন এসে প্রশ্ন করলেন, ‘হু ইজ শিতাংশু’। বললাম, আমি। জানালেন, প্রেসিডেন্ট আপনাকে ডেকেছেন।
ভারতের রাষ্ট্রপতি আমায় ডেকেছেন, আমি খুশি, সম্মানিত। ভারতের প্রেসিডেন্টের সাথে একান্ত বৈঠক। আমার মত সাধারণ মানুষের সাথে, অভাবনীয়। তবে আমি অপ্রস্তুত ছিলাম না, দাদার সাথে আগেও আমি একা কথা বলেছি। প্রেসিডেন্টের অফিসে ঢুকলাম। দাদা সোফাতে বসা, আমায় পাশের আর একটি সোফায় বসতে বললেন, বসলাম। দাদা ডেকেছেন তাই প্রথম কথা তিনিই বললেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি ব্যাখ্যা দিলেন কেন আমাদের পা ধরে প্রণাম করতে নিষেধ করা হয়েছে। জানালেন, গণতন্ত্রে ‘পা-ধরাটা’ অশোভন। বুঝলাম। রাষ্ট্রপতির সাথে একা অন্তরঙ্গ মুহূর্তে। বোঝা গেলো তিনি বৈঠক নিয়ে সন্তুষ্ট।
বললাম, দাদা, আপনি রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় আমাদের জন্যে কিছু একটা করে যান, বাংলাদেশের হিন্দু ও সংখ্যালঘুরা আপনাকে আজীবন মনে রাখবে। সামনের টেবিলে অনেক রঙ্গের ফোন। সুযোগ পেয়ে বলেই ফেললাম, দাদা, নেত্রীকে একটি ফোন দিয়ে অন্তত: আমাদের জন্যে একটি কাজ করতে বলুন। তিনি আপনার কথা ফেলতে পারবেন না। দাদা, একটু চোখ বন্ধ করে চিন্তা করলেন। ইতিমধ্যে ৮/৯ মিনিট পার হয়ে গেছে। দাদা, মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, ঠিক আছে আমি দেখছি। এই সংক্ষিপ্ত স্বল্প সময়ের বৈঠকের কথা আমার সারাজীবন মনে থাকবে।
দাদা আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেছিলেন কিনা জানিনা, তবে আমাদের ফাইলটি তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে চিঠি দিয়ে আমাদের সেই কথা জানানো হয়েছিলো। আমাদের বৈঠকের সংবাদ ও ছবি সেদিন ভারতের টিভিতে এসেছিলো। সরকারিভাবে আমাদের কাছে ছবি পাঠানো হয়েছিলো। বাংলাদেশে সরকার বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি। তাঁরা কেন্দ্রীয় ঐক্য পরিষদের সাথে যোগাযোগ করে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চান? যদিও আমাদের চাওয়া ছিলো দাদাকে দিয়ে অন্তত: একটি দাবি আদায় করা, আমরা পারিনি।
২০০৮ সালের ১লা অক্টবর দাদা নিউইয়র্কে ছিলেন। সম্ভবত: তখন তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আমি তাঁর সাথে দেখা করি। তিনি জানতে চাইলেন, তোমার নেত্রীর খবর কি? বললাম নেত্রীতো ৩/৪ দিন আগে জানালেন যে তিনি নিশ্চিত নন, আওয়ামী লীগ সামনের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসছে কিনা? প্রণব মুখার্জি একটু চিন্তিত হয়ে পড়লেন। কবি সুকান্তের মত গালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষন কি চিন্তা করলেন। তারপর চোখ খুলে বললেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসবে। আমি সজীব ওয়াজেদ জয়কে জানালাম। তিনি বললেন, দাদার সাথে আমার কথা হয়েছে।
নভেম্বর ২০১৯’র মিটিং খুব একটা সুখপ্রদ ছিলোনা। দাদার বয়স হয়েছে। সবাইকে চেনেন না, কানে যন্ত্র থাকলেও কথা খুব কম শুনেন। তাঁর অফিস তিনজনের বেশি ঢুকতে দেবেনা। আমরা ৭জন। প্রথমে ৩জন ঢুকলাম। নমস্কার সেরে বললাম, বাইরে আরো ৪জন আছে, দাদা একবারে সবাইকে ডেকে নিলে ভালো হতো। দাদা রাজি হলেন, সবাই ঢুকলেন, আরো চেয়ার আনতে হলো। এক পর্যায়ে দাদাকে আবার বললাম, দাদা, আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে একটু ফোন দিলে ভালো হতো। তিনি একটু রাগলেন, তাঁকে আগে কখনো রাগতে দেখিনি। বললেন, এখন আমার কোন প্রটোকল নেই! অবশ্য তিনি বলেন, ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসের কাছে তিনি বিষয়টি জানতে চাইবেন।
দাদার সাথে প্রথম মিটিং হয়েছিলো দিল্লিতে, সন তারিখ মনে নেই? তবে তখন বিএনপি ক্ষমতায়। ২০০১-এ সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে বিশ্ব উদ্বিগ্ন। দাদা তখন প্রতিরক্ষামন্ত্রী। মন্ত্রী বাড়ির দরজায় সেনা মোতায়েন ছিলো। ঢুকতেই প্রশ্ন, ‘কিসকো মিলেগা’। বললাম, ‘মাইজিকো’। আসলে আমার এপয়েন্টমেন্ট ছিলো বৌদি’র সাথে। বৌদি বলেছিলেন, আমি দাদাকে বলে দেব, ১০মিনিটি সময় পাবেন। ঠিক আছে। অতিথি কক্ষে ঢুকলাম, মাত্র একজন মানুষ অপেক্ষমান। অবাক হই, এতবড় মন্ত্রী, অথচ বাসায় ভীড় নেই! আমাদের মন্ত্রীদের বাড়ীতে তো ক্যাডারদের জ্বালায় ঢোকার সুযোগ থাকেনা!
একটু পরে ডাক পড়লো। ভেতরে ঢুকলাম। মনটা খুশিতে ভরে গেলো। একজন বাঙ্গালী দিল্লিতে অনেক উঁচুতে। বসতে বললেন, বসলাম। নমস্কার দিলাম। তিনি প্রতি-নমস্কার দিলেন। কথা শুরু করলাম। ঠিক কি বলেছিলাম মনে নেই, তবে বিএনপি-জামাতের অত্যাচার তো ছিলই। তিনি জানতে চাইলেন, শেখ হাসিনা আমাকে চেনেনা কিনা? আমার সাথে ডাঃ টমাস দুলু রায় ছিলেন, তিনি কথা বলেননি। তখন আমেরিকা আফগানিস্তানে ঢুকে গেছে। সাউথ-সুদান, টিমোর বা ইরাক আমাদের আলোচনায় এসেছে। বিএনপি’র পররাষ্ট্রমন্ত্রী গোলাম মোরশেদ এর আগে প্রণব মুখার্জিকে নিয়ে কিছু একটা কটূক্তি করেছিলেন, আলোচনায় তাও এসেছে।
দাদা বেশ উৎসাহের সাথে আমার কথা শুনছিলেন। দশ মিনিটের জায়গায় একঘন্টা প্রায়। আমার আর বলার কিছু নেই, উঠতে পারলে বাঁচি। দাদাকে ধন্যবাদ দিলাম। তিনজন এক সাথে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, "দাদা, আপনি ব্রাহ্মন, তদপুরি প্রাজ্ঞ রাজনীতিক, আপনার পায়ের ধুলি নিতে চাই"। দাদা সানন্দে রাজি হলেন, দাদাকে প্রণাম করলাম। মা-বাবার মৃত্যুর পর আমি কাউকে পা-ছুয়ে প্রনাম করলাম? টমাসদাও প্রণাম করলেন, টুকটাক কথা বললেন। খুশি মনে বেরিয়ে এলাম। দাদা’র পায়ে ধরে প্রণাম দেয়া সেই শুরু, সেটি বন্ধ হয় তিনি যখন প্রেসিডেন্ট। দাদা নেই, তাঁর স্মৃতি থাকবে। দাদাকে শেষ প্রণাম, নমস্কার।