সরকার এমন পদক্ষেপ চালু করতে পারে না যেখানে কৃষকদের আলাদা সমস্যাগুলোর মধ্যে সমন্বয় না করে আলাদা আলাদাভাবে সেগুলো মোকাবেলার চেষ্টা রয়েছে।

ভারতে কৃষি সংস্কার বিষয়ক বিতর্কিত তিনটি বিল পার্লামেন্টে পাস হওয়ার পর এবং প্রেসিডেন্টের অনুমোদন পাওয়ার পর আইনে পরিণত হয়েছে। বিল তিনটি হলো ফার্মার্স প্রডিউস ট্রেড অ্যাণ্ড কমার্স (প্রমোশান অ্যাণ্ড ফ্যাসিলিটেশান), ফার্মার্স (এমপাওয়ারমেন্ট অ্যাণ্ড প্রটেকশান) এগ্রিমেন্ট অব প্রাইস অ্যাশিউরেন্স এবং ফার্ম সার্ভিসেস অ্যাণ্ড দ্য ইসেনশিয়াল কমোডিটিজ (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট। স্বাভাবিকভাবেই এই বিলগুলোর পেছনে সরকারের যুক্তি হলো গ্রামীন অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি আর উন্নয়নকে এগিয়ে নেয়া। এই বিলগুলোর মাধ্যমে কৃষি উৎপাদনের জন্য অবকাঠামো নির্মাণ এবং সরবরাহ চেইন গড়ে তোলার জন্য প্রাইভেট খাত থেকে বিনিয়োগের আশা করা হয়েছে।

এই বিলের কারণে কৃষকরা এগ্রিকালচারাল প্রডিউস মার্কেট কমিটির (এপিএমসি) বাইরে নিজের পছন্দের পক্ষের কাছে পণ্য বিক্রি করতে পারবে। যুক্তি দেখানো হয়েছে যে, এর ফলে কৃষকরা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্যের উপযুক্ত মূল্য পাবে এবং তাদের পরিবহন খরচও বাঁচবে। চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদ আইনের কারণে আশা করা হচ্ছে কৃষক আর কৃষি-ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো চাষের আগেই পণ্যের ব্যাপারে আগে থেকেই একটা চুক্তিতে পৌঁছাবে। ইসেনশিয়াল কমোডিটিজ (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্টের অধীনে ভোজ্য তেল, পেঁয়াজ ও আলুর মতো পণ্যগুলোকে দরকারী পণ্যের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে এগুলো মজুদ রাখার উপর নিষেধাজ্ঞা সরিয়ে নেয়া হবে।

কৃষি বাজারের উপর এই বিল পাস হওয়ার আগে এপিএমসিগুলোতে ব্যবসায়ী আর কমিশন এজেন্টদের দৌরাত্মের কারণে কৃষকরা দর কষাকষির জায়গায় দুর্বল অবস্থানে ছিল। গবেষণায় দেখা গেছে স্বচ্ছ মূল্যের অভাব, মজুদদারি, মধ্যসত্ত্বভোগী ইত্যাদি কারণে বাজার চাঙ্গা হতে পারেনি। এপিসিএম অ্যাক্ট বিভিন্ন জায়গায় যেভাবে ভিন্ন ভিন্নভাবে কার্যকর করা হয়েছে, সেটার কারণে কখনও একটা সম্মিলিত জাতীয় বাজার গড়ে উঠতে পারেনি। এই বিল স্বাভাবিকভাবেই ‘এপিএমসি বাইপাস বিল’ নামেও পরিচিত হয়ে উঠেছে কারণ এর মাধ্যমে আগের বিলের সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে উঠে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে, যেখানে কৃষক আর ব্যবসায়ীরা তাদের পছন্দের স্বাধীনতা চর্চা করতে পারবে এবং ইলেকট্রনিক বাণিজ্যের একটা ফ্রেমওয়ার্ক গড়ে উঠবে”।

ইসেনশিয়াল কমোডিটিজ অ্যাক্ট সংশোধনের আগে দরকারী পণ্যের মজুদের উপর যখন তখন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতো এবং এতে চাষাবাদ পরবর্তী মজুদ, গুদামজাতকরণ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে প্রাইভেট বিনিয়োগ মাঝে মাঝেই ব্যাহত হয়েছে। ইসেনশিয়াল কমোডিটিজ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল ২০২০ এর মাধ্যমে এই অনিশ্চয়তা দূর করার চেষ্টা করা হয়েছে, যাতে মজুদের পরিমাণের উপর বিধিনিষেধ না থাকে।

ফার্মার্স (এমপাওয়ারমেন্ট অ্যাণ্ড প্রটেকশান) এগ্রিমেন্ট অব প্রাইস অ্যাশিউরেন্স অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিসেস বিল ২০২০ বা কন্ট্রাক্ট ফার্মিং বিল কৃষক আর স্পন্সর ব্যবসায়ীর মধ্যে একটা লিখিত চুক্তির সুযোগ রেখেছে, তবে সেটাকে বাধ্যতামূলক করা হয়নি।

এই তিনটি বিলই কৃষকদের জন্য সুযোগ তৈরি করবে, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো কৃষকদের যে সামর্থ, সেই জায়গা থেকে তারা কি এই সুবিধাগুলো নিতে পারবে? উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এপিএমসি বাইপাস বিল কৃষকদের জন্য এপিএমসিগুলোর বাইরেও বাণিজ্যিক লেনদেনের সুযোগ সৃষ্টি করবে বলে বলা হচ্ছে। কিন্তু এই স্বাধীনতাকে কাজে লাগানোর জন্য যে সুবিধা দরকার সেটা কি কৃষকদের রয়েছে? এই বিলে বেশ কিছু নতুন বাণিজ্য ক্ষেত্র ও ডিজিটাল জগত সৃষ্টির সুযোগ রাখা হয়েছে, কিন্তু সেগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের কোন মেকানিজম রাখা হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে নতুন বাণিজ্যিক ক্ষেত্র ও ডিজিটাল জগতের সাথে জড়িতরা যদি নিজেদের মধ্যে একটা মধ্যসত্ত্বভোগী চক্র তৈরি করে, তাহলে কি হবে? কৃষক ও ক্ষুদ্র চাষীদেরকে মধ্যসত্ত্বভোগীদের হাত থেকে রক্ষার জন্য কোন নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা না থাকায় এই বিল তার উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হবে।

সবগুলো বিলের উদ্দেশ্য হলো প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান এবং কৃষকদের মধ্যে বিনিময় বাড়ানো। কিন্তু প্রাইভেট বিনিয়োগের ধারা দেখে বোঝা যায় তারা বিশেষ ভৌগলিক এলাকার প্রতি বেশি আসক্ত, যেখানে ভালো অবকাঠামো এবং বেশি উৎপাদনশীল কৃষকেরা রয়েছে, যাতে তাদের ব্যবস্থাপনা ব্যায় কম হয়। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীরা সাধারণত ডিলার আর সরবরাহ চেইনের এক প্রান্তের ব্যক্তিদের সাথে লেনদেন করে এবং মূল ব্যবসায়ীদের সাথে তাদের দেখা হয় না। ছোট আকারের চাষীর সাথে সামান্য লাভে লেনদেন করতে হয় বলে বিপুল সংখ্যক ক্ষুদ্র কৃষকদের সাথে আলাদা আলাদা লেনদেনের কারণে প্রাইভেট ব্যবসায়ীদের জন্য এটা প্রচুর ব্যায়বহুল হয়ে যায়। এ কারণেই সাধারণত তারা মধ্যসত্ত্বভোগীদের দ্বারস্থ হয়, যারা কৃষকদের সাথে লেনদেন করে। এমন সম্ভাবনা খুবই কম যে, এই কৃষকরা ক্রেতাদের বাজার সম্প্রসারণের সুবিধা পাবে এবং প্রাইভেট ব্যবসায়ীদের সাথে চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদের সুযোগ ব্যবহার করতে পারবে। ভারতীয় কৃষকদের ৮৭ শতাংশই ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক পর্যায়ের। এই বাস্তবতার কারণেই প্রশ্ন উঠছে যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষকদের উন্নতিতে এই বিল আদৌ কোন ভূমিকা রাখবে কি না।

এই কৃষি বিলগুলোর বৈশিষ্ট্যই এমন যে, এগুলোর ফল কি হবে, তা নিয়ে অনেক অনিশ্চয়তা রয়েছে। দেশের কৃষিখাতে যে ধারাবাহিক সঙ্কট চলছে, সেখানে এই অনিশ্চয়তা তারা সহ্য করতে পারবে না। কৃষি সঙ্কট মোকাবেলায় আরও উন্নত পদক্ষেপ লাগবে। নীতিগতভাবে কৃষকদের ক্ষমতায়নের জন্য হস্তক্ষেপ করতে হবে। শুধু সুবিধা সৃষ্টি করলেই হস্তক্ষেপের কাজ শেষ হবে না। এই প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করতে হবে যাতে উৎপাদনশীলতা বাড়ে এবং কৃষকদের আয় বাড়ে। এ পর্যন্ত, কৃষিখাতে হস্তক্ষেপের ধরনগুলো কৃষি বিলগুলোর মতো একই রকম ছিল। এর ফল চোখের সামনেই রয়েছে এবং স্বাধীনতার পর থেকেই কৃষি উৎপাদনের মাত্রায় কমতি রয়ে গেছে।

কেউ যখন এই সব মৌলিক নীতিমালাগুলো বিবেচনা করে দেখবে, তখন উপলব্ধি করতে পারবে যে, সরকার এমন কোন পদক্ষেপ নিতে পারে না, যেখানে কৃষি সঙ্কটের বিভিন্ন সঙ্কটগুলোকে আলাদা আলাদাভাবে মোকাবেলার চেষ্টা করা হবে। মওসুমি বৃষ্টিপাতের উপর কৃষকদের নির্ভরতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক পুঁজির অভাবের মতো সমস্যার সমাধান না করে কৃষি বিল বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীদের জন্য এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, যেখানে এই আইন থেকে তাদের সুবিধা পাওয়ার সুযোগ অত্যন্ত সীমিত হয়ে গেছে। সে কারণে এই আইনগুলোর সহায়ক হিসেবে উপরে বর্ণিত বহুমুখী কৌশলগুলো অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। তাছাড়া ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীদের কাছে এর সুবিধা পৌঁছানোর বিষয়টি পুরোপুরি প্রাইভেট ব্যবসায়ীদের হাতেই পুঞ্জিভূত থাকবে, যাদের সাধারণভাবে এই দায়িত্ব পালনের খুব একটা দায় নেই। সাউথ এশিয়ান মনিটর

লিখেছেন: নেনিতা ডি’সুজা