শিল্প-বাণিজ্যের জগতে ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম গ্রুপ। দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে সুনামের সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে এই প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৫৬ সালে এএমএল কনস্ট্রাকশন দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন আবদুল মোনেম। সে সময় মাত্র ২০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে তিনি নিজের নামে গড়ে তোলেন ‘আবদুল মোনেম লিমিটেড।’ তারপর থেকে একে একে প্রতিষ্ঠা করেন বিভিন্ন শিল্প কারখানা।
ব্যবসায়িক সুনাম আর সাফল্যের পথ ধরে বর্তমানে দেশের শীর্ষস্থানীয় গ্রুপে পরিণত হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি। সরকারি-বেসরকারি বড় অবকাঠামোর বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখছে মোনেম গ্রুপ। নির্মাণ খাত দিয়ে শুরু করলেও সময়ের ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসা প্রসারিত হয়েছে নানা খাতে।
গত ৩১ মে মোনেম গ্রুপের মূল উদ্যোক্তা বিশিষ্ট শিল্পপতি ও গ্রুপের চেয়ারম্যান এম আবদুল মোনেম মারা যান। এরপর প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব বর্তায় মোনেমের দুই ছেলে এএসএম মাঈনুদ্দিন মোনেম ও এএসএম মহিউদ্দিন মোনেমের ওপরে। যদিও আবদুল মোনেম জীবিত থাকা অবস্থায়ই তার ছেলে মাঈনুদ্দিন মোনেম ও মহিউদ্দিন মোনেম দীর্ঘদিন গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভাগাভাগি করে দেখাশোনা করে আসছিলেন।
বাবার মৃত্যুর পর তারা তাদের মাকে বসিয়েছেন মোনেম লিমিটেডের চেয়ারম্যান পদে। তবে প্রতিষ্ঠানটির এমডি পদ এখনও খালি রয়েছে। বর্তমানে প্রয়াত আবদুল মোনেমের বড় ছেলে মাঈনুদ্দিন মোনেম ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর-১ এবং ছোট ছেলে মহিউদ্দিন মোনেম ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর-২ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। জানা গেছে, মায়ের পরামর্শ আর বাবার তৈরি করা নিয়মেই মোনেম গ্রুপ পরিচালনা করছেন দুই ভাই।
এ প্রসঙ্গে মাঈনুদ্দিন মোনেম বলেন, ‘বাবার হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের অর্থনীতিতে তথা পণ্য উৎপাদন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে চলেছে।’ প্রসঙ্গত, মোনেম গ্রুপের অধীনে রয়েছে ডজনেরও বেশি প্রতিষ্ঠান। জানা যায়, অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে একজন ঠিকাদার হিসেবে আবদুল মোনেম ১৯৫৬ সালে মাত্র ২০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম লিমিটেড গড়ে তোলেন।
এরপর ধীরে ধীরে তিনি এই কোম্পানিকে বাংলাদেশের অবকাঠামো নির্মাণ শিল্পের সামনের কাতারে নিয়ে আসেন। তার নিজের নামে গড়া এএমএল কন্সট্রাকশনস লিমিটেড হয়ে ওঠে দেশের অন্যতম শীর্ষ কন্সট্রাকশনস ফার্ম। শুধু তা-ই নয়, এএমএল কনস্ট্রাকশন গত ৫৫ বছরে বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এবং ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের মতো বড় সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে।
মোনেম গ্রুপ ইগলু আইসক্রিম ইউনিট প্রতিষ্ঠা ছাড়াও এএম বেভারেজ ইউনিটের অধীন এএমএল কোকা-কোলা ব্র্যান্ডের কোকা-কোলা, ফান্টা ও স্প্রাইট বোতলজাত করে আসছে। সড়ক, সেতু, ফ্লাইওভারসহ দেশের বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণকাজে যুক্ত এএমএল কন্সট্রাকশনস মেট্রো রেল প্রকল্প এবং পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পেও বিভিন্ন কাজে জড়িত রয়েছে।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে নির্মাণে রয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। জীবিতকালে আবদুল মোনেম ব্যবসা সম্প্রসারিত করেছিলেন অনেক ক্ষেত্রে। খাবার, বেভারেজ, ফার্মাসিউটিক্যালসসহ আরও নানা খাতে বিনিয়োগ করেছিলেন তিনি। ১০ হাজারের বেশি মানুষ তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন।
মোনেম গ্রুপের কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে—ইগলু আইসক্রিম, ম্যাংগো পাল্প প্রসেসিং, ইগলু ফুডস, ড্যানিস বাংলা ইমালসন, ইগলু ডেইরি প্রোডাক্টস, সুগার রিফাইনারি, এম এনার্জি লিমিটেড, নোভাস ফার্মাসিউটিক্যালস, এএম আসফল্ট অ্যান্ড রেডিমিক্স লিমিটেড, এএম অটো ব্রিকস, এএম ব্র্যান অয়েল কোম্পানি, সিকিউরিটিজ ও ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড এবং এএম বেভারেজ।
এ গ্রুপের মালিকানাধীন ‘আবদুল মোনেম অর্থনৈতিক অঞ্চল’ যাত্রা শুরু করে ২০১৫ সালে। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় দেশের দ্বিতীয় বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলেন প্রয়াত আবদুল মোনেম। যাত্রা শুরুর পর থেকে বিভিন্ন সময়ে স্থাপন করা হয় আলাদা শিল্প ইউনিট।
এরমধ্যে ১৯৮২ সালে আইসক্রিম ইউনিট, একই বছরে বেভারেজ ইউনিট, ২০০০ সালে ম্যাঙ্গো পাম্প প্রসেসিং, ২০০৪ সালে ইগলু ফুডস, ড্যানিস বাংলা ইমালশন, সিকিউরিটি ও ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, ইগলু ডেইরি প্রোডাক্টস, ২০০৭ সালে সুগার রিফাইনারি ও এম এনার্জি, ২০০৮ সালে নোভাস ফার্মাসিউটিক্যালস, ২০১০ সালে এএম অ্যাসফল্ট অ্যান্ড রেডিমিক্স, ২০১২ সালে এএম অটো ব্রিকস, ২০১৪ সালে এএম ব্র্যান্ড অয়েল কোম্পানি এবং ২০১৫ সালে আবদুল মোনেম ইকোনমিক জোন নামের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়।
আইসক্রিমের পাশাপাশি দুগ্ধজাত ও খাদ্যপণ্যে বাজারের চাহিদা পূরণে গড়ে তোলেন ইগলু ডেইরি ও ইগলু ফুডস লিমিটেড। এই ইগলু ফুডস লিমিটেড হিমায়িত খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও বিতরণ করে আসছে। ড্যানিশ বাংলা ইমালশন লিমিটেড (ডিবিইএল) আবদুল মোনেম ও ডেনমার্কের ইএনএইচ ইঞ্জিনিয়ারিং এ/এসের একটি যৌথ উদ্যোগ।
সড়ক ও বিমান ঘাঁটি পথ নির্মাণে স্বয়ংক্রিয় ও অত্যাধুনিক উপায়ে বিটুমিন ইমালসন উৎপাদন করছে ডিবিইএল। চিনির চাহিদা পূরণে গড়ে তোলা হয়েছে আবদুল মোনেম সুগার রিফাইনারি লিমিটেড (এএমএসআরএল)। এটি দেশের একমাত্র সুগার রিফাইনারি, যা আইএসও ২২০০০-২০০৫ সনদ পেয়েছে। এছাড়া এএম অটো ব্রিকস অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে পরিবেশবান্ধব ইট তৈরি করছে। তথ্যসূত্র: বাংলা ট্রিবিউন।