'জ্ঞানবাপী' অত্যন্ত পবিত্র একটি তীর্থ। এর বর্ণনা স্কন্দপুরাণের কাশীখণ্ডের পূর্বাদ্ধে সুস্পষ্টভাবে রয়েছে। সেখানে জ্ঞানবাপীর উৎপত্তির সাথে সাথে এর নামকরণের ইতিহাসও বর্ণিত হয়েছে। জ্ঞানবাপী দিঘির  জ্ঞানবাপী নামটি ভগবান শিব রাখেন। অগস্ত্য মুনি ভগবান কার্তিকের কাছে এই দিঘির  মাহাত্ম্য জানতে চান। তিনি ভগবান কার্তিককে জিজ্ঞাসা করেন যে,  জ্ঞানবাপী দিঘি কেন এত মাহাত্ম্যপূর্ণ যে এর প্রশংসা স্বর্গবাসী দেবতারাও করেন?


অগস্ত্য মুনির এ প্রশ্নের উত্তরে জ্ঞানোদ তীর্থের মহিমা বর্ণনা করে ভগবান কার্তিক। তিনি বলেন:


 আমি জীবের সকল কলুষনাশিনী জ্ঞানবাপী দিঘির  উৎপত্তি এবং মাহাত্ম্যকথা বর্ণনা করছি। আপনি শ্রবণ করুন।হে মুনে! বহুপূর্বে  দেবযুগে এই আবহমান সংসারে মেঘ বৃষ্টিপাত করত না; নদীর  উৎপত্তি হয়নি; স্নান-দানাদি কাৰ্য্যে কেউ জল ধর চাইত না; লবণ ও ক্ষীরসমুদ্রেই কেবল জল বৃষ্টি দেখা যেত। পৃথিবীর সর্বত্র মনুষ্যবসতি ছিল না। কদাচিৎ কোথাও কোথাও মনুষ্য বসবাস করত। এমন সময়ে দিকপাল ঈশান মনের ইচ্ছায় ইতস্তত  বিচরণ করতে করতে  সমস্ত কর্মবীজের উষয়ক্ষেত্রে মহানিদ্রায় নিদ্রিত জীবগণের প্রতিবোধক, সংসারসমুদ্রাবর্তে পতিত জন্তুর অবলম্বনতরণী, যাতায়াতে খিন্নজীবের বিশ্রামভবন, বহুজন্মসঞ্চিত কৰ্ম্মসূত্রের ছেদনশস্ত্র, নির্বাণলক্ষ্মীধাম, সচ্চিদানন্দনিলয়, পরব্রহ্মরসায়ন, সুখসন্তানজনক, মোক্ষসাধন-সিদ্ধিপ্রদ মহাশ্মশান শ্রীআনন্দকাননে উপস্থিত হলেন। অর্থাৎ সিদ্ধিপ্রদ মহাশ্মশান সমন্বিত কাশীক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন।  জটিল ঈশান কাশীক্ষেত্রে প্রবেশ করে দেখতে পেলেন,  ভগবান শিবের  ত্রিশূলের জ্যোতি সূর্যের ন্যায় দশদিক আলোকিত করে আছে। সেই ত্রিশুলের  বিমল রশ্মিজালে আকুল হয়ে তিনি জ্যোতির্মালামণ্ডিত ভগবান শিবের জ্যোতির্লিঙ্গ দর্শন করলেন। এ জ্যোতির্লিঙ্গ দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের প্রধানতম।অমর দেবতাগণ, সিদ্ধ, যোগী, ঋষি ও প্রমথগণ নিরন্তর ভগবান শিবের সেই লিঙ্গমূর্তির অর্চ্চনা করছে। গন্ধর্বরা বিবিধ বাদ্যাদি সহযোগে সংগীত করছে।  চারণগণ শিব স্তব করছে; অপ্সরাগণ নৃত্য করছে; নাগকন্যাগণ হাতে মণিময় প্রদীপ নিয়ে আরতি করছে; বিদ্যাধরবধূ ও কিন্নরীগণ ত্রিকালীন মঙ্গল প্রার্থনা করছে। দেবনারীগণ ইতস্ততঃ চামরব্যজন করছে। মুক্তিক্ষেত্র কাশীতে ভগবান শিবের জ্যোতির্ময় লিঙ্গ দেখে  ঈশানের ইচ্ছা হল যে, তিনি কলশীতে শীতল জল এনে সেই জল দ্বারা ভগবান শিবের  মহালিঙ্গকে স্নান  অভিষেক করাবেন।


অস্যেশানস্য তল্লিঙ্গং দৃষ্ট্বেচ্ছেত্যভবত্তদা।

স্নপয়ামি মহল্লিঙ্গং কলশৈঃ শীতলৈর্জলেঃ।।

চখান চ ত্রিশুলেন দক্ষিণাংশোপকণ্ঠতঃ।

কুণ্ডং প্রচণ্ডবেগেন রুদ্রো রুদ্রবপূর্দ্ধরঃ।।

(স্কন্দপুরাণ: কাশীখণ্ড, পূর্বাদ্ধখণ্ড, ৩৩.১৬-১৭)


তখন শিবের অংশভূত রুদ্রমূর্তি ঈশান ত্রিশূল দ্বারা বিশ্বনাথ শিবের মন্দিরের দক্ষিণ ভাগের অনতিদূরে এক কুণ্ড বা কুপ খনন করলেন। সেই কুণ্ড হলে অজস্রধারায় সুপেয় জলরাশি এই ভূমণ্ডলের বহিরাবরণে নির্গত হল।সেই ঈশান তখন সেই জলদ্বারা শিবকে স্নান করালেন। সেই কুণ্ডের জলের বৈশিষ্ট্য হল :


সকলের এই জল স্পর্শ করার সৌভাগ্য হয় না; সজ্জনচিত্তের স্থায় স্বচ্ছ; এই জল সকলের ঊর্ধ্বে, তাই আকাশমার্গের ন্যায় অত্যুচ্চ;  জ্যোৎস্নার ন্যায় উজ্জ্বল এবং শ্বেতকায়; শিবনামের ন্যায় মহাপবিত্র; অমৃতবৎ পরম সুস্বাদু ; বৃষাঙ্গের ন্যায় সুখস্পর্শ;  নিষ্পাপজনের স্থায় ধীর এবং গম্ভীয়; পাপিগণের মত চঞ্চল; পদ্মগন্ধ যুক্ত; লাল পারুল ফুলের সুগন্ধীযুক্ত;  সকালের দর্শনমাত্রই নয়নমনোহারী; অজ্ঞানতাপতপ্ত জীবের স্নিগ্ধতা প্রদানকারী;  পঞ্চামৃত স্নানের অপেক্ষা অতি ফলদায়ী;  শ্রদ্ধাপূর্বক স্পর্শ করলে হৃদয়ে লিঙ্গত্রিতয়েয় জনক; অজ্ঞানতিমিরের জ্যোতির্ময় সূর্যতুল্য; জ্ঞানদানের নিদান; উমাস্পর্শ অপেক্ষা বিশ্বেশ্বরের অতি সুখকারী; অবভৃত স্নান হতেও শুদ্ধিবিধায়ক; অত্যন্ত সুশীতল; মূর্খতা বিনাশকারী সেই পবিত্র জল দ্বারা সহস্ৰধারায় কলসে করে হৃষ্টচিত্তে সহস্রবার সেই লিঙ্গমূর্তিকে স্নান করালেন।সেই পবিত্র কুণ্ডের জলে অভিষিক্ত হয়ে বিশ্বলোচন বিশ্বাত্মা  রুদ্রমূর্তিধারী ভগবান শিব ঈশানের সম্মুখে আবির্ভূত হলেন। তিনি অত্যন্ত প্রসন্নহৃদয়ে ঈশানকে বললেন:


"হে সুব্রত ঈশান! অতি প্রীতিকর, অনন্যকৃতপূর্ব গুরুতর তোমার এই মঙ্গলময় কর্মে আমি অত্যন্ত প্রসন্ন হয়েছি। তোমায় কি বর প্রদান করতে হবে বল, তোমাকে আমার অদেয় কিছু নেই।" ভগবান শিবের আবির্ভাব এবং বরদানের প্রতিশ্রুতিতে ঈশান অভিভূত হয়ে যায়। সে তখন বলেন :


 "হে দেবেশ ! যদি প্রসন্ন হয়ে থাকেন ও আমি যদি আপনার বরলাভের যোগ্যপাত্রমধ্যে গণ্য হই, তবে হে শঙ্কর! এই তীর্থ অতুলনীয় হয়ে আপনার নামে প্রসিদ্ধ হোক এই আমার ক্ষুদ্র চাওয়া।" ঈশানের বাক্যে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান বিশ্বেশ্বর বললেন: 


ত্রিলোক্যাং যানি তীর্থানি ভূভুবঃস্বঃস্থিতান্যপি।

তেভ্যোঽখিলেভ্যস্তীর্থেভ্যঃ শিবতীর্থমিদং পরম্।।

শিবং জ্ঞানমিতি ব্রূয়ুঃ শিবশব্দার্থচিন্তকাঃ।

তচ্চ জ্ঞানং দ্রবীভূতমিহ মে মহিমোদয়াৎ।।

অতো জ্ঞানোদনামৈতীর্থং তৈলোক্যবিশ্রুতম্।

অস্য স্পর্শমাত্রেণ সর্বপাপৈঃ প্রমুচ্যতে।।

জ্ঞানোদতীর্থসংস্পর্শাদশ্বমেধফলং লভেৎ।

স্পর্শনাচমনাভ্যাঞ্চ রাজসূয়াশ্বমেধয়োঃ।।

(স্কন্দপুরাণ: কাশীখণ্ড, পূর্বাদ্ধখণ্ড, ৩৩.৩১-৩৪)


ত্রিভুবন বা ভূলোক, অন্তরিক্ষলোক এবং স্বর্গলোক মধ্যে যত তীর্থ আছে, সেই সকল তীর্থ হতে প্রধান এই তীর্থ  শিবতীর্থ নামে  নামে খ্যাত হবে। শিবশব্দার্থজ্ঞ পণ্ডিতগণ শিব শব্দের অর্থ 'জ্ঞান' বলে অভিহিত করে থাকেন। এই তীর্থে সেই জ্ঞান আমার মহিমাবলে জলের মধ্যে দ্রবীভূত রয়েছে। অতএব এই তীর্থ 'জ্ঞানোদ' নামে ত্রিলোকের মধ্যে বিখ্যাত হবে। এই কুণ্ডতীর্থের দর্শনে সর্বপাপ মোচন হয়ে যায়। স্পর্শনে অশ্বমেধের ফল লাভ হয়। এবং আচমন ও পানে রাজসুয় ও অশ্বমেধের ফলপ্রাপ্তি হবে। ফল্গুতীর্থে স্নান ও পিতৃলোকের তর্পণ করে মনুষ্যের যে ফল লাভ হয়, এই তীর্থে শ্রাদ্ধ করলে, সে সকল ফলই লাভ  হবে। বৃহস্পতিবার  পুষ্যানক্ষত্রযুক্ত শুক্লপক্ষীয় অষ্টমীতে ব্যতীপাতযোগ হলে কেউ এই কুণ্ডতীর্থে শ্রাদ্ধ করে, তবে গয়াশ্রাদ্ধ অপেক্ষা তাঁর কোটিগুণ ফল লাভ হবে। পুষ্করতীর্থে পিতৃতর্পণে যে পুণ্য, এই তীর্থে তিলতর্পণে তা অপেক্ষা কোটিগুণ পুণ্য লাভ হবে। কুরুক্ষেত্রে রামহ্রদে সূর্যগ্রহণকালে পিণ্ডদানে যে ফল হয়, এই তীর্থে প্রতাহ সেই ফল লাভ হবে। যাঁদের পুত্র এই স্থানে পিণ্ডদান করবে, তাঁরা  প্রলয়কাল যাবৎ শিবলোকে বাস করবে। অষ্টমী ও চতুৰ্দ্দশীতে উপবাস করে এই তীর্থে প্রাতঃস্নান ও এর জলপান করলে, মনুষ্যের হৃদয় দ্রুতই  শিবময় হয়ে যাবে । একাদশীতে উপবাস করে এর তিন গণ্ডুষ বা হাতের তিন কোষ জল যে পান করে, নিশ্চিতভাবে তাঁর  হৃদয়ে শিবলিঙ্গত্রয় উৎপন্ন হবে। বিশেষ করে  সোমবারে যে ব্যক্তি এই শিবতীর্থে স্নান এবং ঋষি, দেব ও পিতৃতর্পণ করে যথাসম্ভব দান করে ষোড়শোপচারে বিশ্বেশ্বর শিবের পূজা করে, তাঁর মনোরথ দ্রুতই পূর্ণ হয়। ত্রিসন্ধ্যাকালে সন্ধ্যা না করলে যে পাপ হয়, এ তীর্থে সন্ধ্যোপাসনা করলে, সেই পাপ থেকে তৎক্ষণাৎ মুক্ত হওয়া যায়। এ তীর্থে এসে নিষ্ঠাবান  দ্বিজগণ জ্ঞানলাভ করবে। এর নাম 'শিবতীর্থ', 'জ্ঞানতীর্থ', 'তারকতীর্থ' এবং নিঃসন্দেহে জীবের অত্যন্ত মোক্ষপ্রদ 'মোক্ষতীর্থ'। এ তীর্থকে মনেমনে স্মরণ করলেও জীবের পাপরাশি বিনষ্ট হয়ে যায়। এর দর্শন, স্পর্শন, জলপান ও এতে স্নান করলে মনুষ্য চতুৰ্বর্গ ফল প্রাপ্ত হয়। এর জল দর্শনে ডাকিনী, শাকিনী, ভূত, প্রেত, বেতাল, রাক্ষস, গ্রহ, কুষ্মাণ্ড, খেটিঙ্গ, কালকর্ণী, বালগ্রহ, জ্বর, অপস্মার, বিস্ফোট প্রভৃতি সমূদয় থেকে কোন বিপদের আশঙ্কা থাকে না। যে ব্যক্তি এই তীর্থের জল দ্বারা শিবলিঙ্গকে স্নান করায়, তাঁর সৰ্বতীর্থজল দ্বারা স্নান করানোর পুণ্যফল লাভ হয়। জ্ঞানরূপী হয়ে জ্ঞানমূর্তিতে এই জ্ঞানবাপীতে আমি দ্রবমূর্তি বা জলমূর্তি ধারণ করে জীবের সকল জড়তা বিনাশ করে  জ্ঞান উপদেশ প্রদান করব। ভগবান্ শিব ঈশানকে এমন বর প্রদান করে অন্তর্হিত হয়ে গেলেন। শিবভক্ত ত্রিশুলধারী জটিল নামক ঈশানও শিবদর্শনে নিজেকে কৃতার্থ বোধ করলেন। তিনি পরম পবিত্র জ্ঞানবাপীর পরম পবিত্র  জল পান করে পরমজ্ঞান লাভ করলেন।


কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 

সহকারী অধ্যাপক, 

সংস্কৃত বিভাগ, 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়