অগ্নিযুগের বিপ্লবী, স্বদেশি আন্দোলনের নেত্রী, নারী সংগঠক, সমাজসেবক মনোরমা বসু মাসিমার আজ ১২৩তম জন্মবার্ষিকী। ১৮৯৭ সালের ১৮ নভেম্বর তিনি বরিশালের বানারীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

দিবসটি পালন উপলক্ষে বরিশাল বিভিন্ন সংগঠন নানা  কর্মসূচি পালন করবে। এর মধ্যে মনোরমা মাসিমা প্রতিষ্ঠিত মুকুল মিলন খেলাঘর আসর ও স্বেচ্চাসেবী প্রতিষ্ঠান শালিন্য'র আয়োজনে সকালে মাসিমার জীবনীগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন, আলোচনাসভা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং বিকেলে মাসিমা স্ট্রাস্টের আয়োজনে আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হবে।

মাত্র ১১ বছর বয়সে ক্ষুদিরামের আত্মত্যাগে অনুপ্রাণিত হয়ে রাজনীতিতে আগ্রহী হন মাসিমা। ১৪ বছর বয়সে বরিশালের জমিদার চিন্তাহরণ বসুর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। স্বামীর সমর্থন পেয়ে তিনি স্বদেশি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।

কংগ্রেসের কর্মী হিসেবে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে জেলে গিয়েছিলেন। নারী অধিকার রক্ষায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত সরোজ নলিনী মহিলা সমিতি। এ ছাড়া তিনি বিধবা ও কুমারীদের সাহায্যের জন্য 'মাতৃমন্দির আশ্রম' প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি। এছাড়া বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ'র বরিশাল শাখা তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর হতে গড়ে উঠেছিল আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়, পল্লীকল্যাণ অমৃত পাঠাগার, মুকুল মিলন খেলাঘরসহ নানা সংগঠন। 

ধীরে ধীরে তিনি যুক্ত হয়ে পড়েন নারী সমাজকে সচেতন করে গড়ে তোলার কাজে। তখন থেকে তিনি কংগ্রেসের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। ১৯৩০ সালে সারা ভারতজুড়ে চলছিল আইন অমান্য আন্দোলন। এই আন্দোলনে মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ পুলিশ মনোরমা বসুকে গ্রেপ্তার করে। ছয় মাস জেল ও ১৫০ টাকা জরিমানা দিয়ে জেল থেকে বের হন তিনি। পরে পুরো উদ্যোমে শুরু করেন নারীদের সংগঠিত করার কাজে। পাশাপাশি চালু করেন মেয়েদের বিদ্যালয়।

কালক্রমে এই বিদ্যালয় বিখ্যাত 'মাতৃমন্দির' নামে পরিচিতি পায়। মূলত হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে শত শত কুমারী মা এবং স্বামী পরিত্যক্ত নারী যাদেরকে তিনি আদর-স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন, তারাই তাঁকে মায়ের মতো আপন ভেবে 'মাসিমা' বলে ডাকতেন। ক্রমে সমগ্র পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন মাসীমা নামে।

১৯৪৪ সালে মন্বন্তরের সময় বরিশাল জুড়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজে নারীদের নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ান। ১৯৪৭ দেশভাগের পর যখন দলে দলে হিন্দুরা ভারতে চলে যায় তখনো তিনি নিজের মা-মাটিকে আঁকড়ে ধরে দেশেই থেকে যান। ১৯৪৮ সালে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে সামিল হন সরকারবিরোধী আন্দোলনে। পাকিস্তান পুলিশ তাঁকে  নির্যাতনের পর গ্রেপ্তার করে, ভেঙে দেয় তাঁর প্রতিষ্ঠিত  মাতৃমন্দির। চার বছর জেলে থাকার পর ১৯৫২ সালে মুক্তি পান মাসিমা। জেলে তাঁর সঙ্গী ছিলেন তেভাগা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেত্রী ইলা মিত্র, নাচোলের রাণী।

ঢাকায় যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন হলে আবার তাঁর ওপর জারি হয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে দীর্ঘদিন তিনি আত্মগোপনে থাকেন। সেই অবস্থাতেও বরিশালের বিভিন্ন জায়গায় দলীয় কাজে নিজেকে নিয়েজিত করেন।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে তাঁর ওপর থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা উঠে যায়। নতুন করে গড়ে তোলেন মাতৃমন্দির ছাড়াও আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়, পল্লীকল্যাণ অমৃত পাঠাগার ও মুকুল মিলন খেলাঘর।

১৯৬৪ সালের দাঙ্গাবিরোধী কর্মকাণ্ডে মাসিমা সাহসের সঙ্গে  দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে তাঁর ভূমিকা চিরস্মরণীয়। গোটা বরিশালজুড়ে ওইসময় তিনি আন্দোলন সংগঠিত করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মনোরমা বসু প্রথমে দেশেই আত্মগোপন করে থাকেন। পরে জুন মাসে চলে যান ভারতে। সেখানে গিয়েও তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে প্রচারণা, অর্থসংগ্রহ ইত্যাদি কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। দেশ স্বাধীন হলে জানুয়ারি মাসেই তিনি ফিরে আসেন। মহিলা পরিষদের উদ্যোগে বয়স্কা নারীদের জন্য কালীবাড়ি রোডের চণ্ডীসদনে স্থাপন করেন বৈকালিক স্কুল।

১৯৭৪ সালে তিনি সোভিয়েত নারী কমিটির আমন্ত্রণে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিনিধি হয়ে রাশিয়া ভ্রমণ করেন। ১৯৮৩ সাল থেকেই তিনি বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগতে থাকেন। অবশেষে এই মহিয়সী নারী ১৯৮৬ সালের অক্টোবর  মৃত্যুবরণ করেন তাঁরই প্রতিষ্ঠিত মাতৃমন্দিরে।

মনোরমা বসুর মৃত্যুর পর বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি তাঁকে ১৯৯২ সালে মরণোত্তর সম্মাননা প্রদান করে। ১৯৯৭ সালে শের এ বাংলা পদক, ১৯৯৮ সালে মহিলা পরিষদ কর্তৃক সম্মাননা, ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বেগম রোকেয়া পুরস্কার প্রদান করা হয়।