রাজনৈতিক চেতনার দিক থেকে মধ্যপন্থী ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। তিনি তাঁর অনুজ মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতো মুক্তিযুদ্ধের ঘাতক দালালদের বিচার বিষয়ে তেমন সোচ্চার ছিলেন না। কিন্তু তাঁর বিশ্বাস ও ভাবনা কী সেটা তাঁর বাড়ীতে আসা একটি টেলিফোন কলেই বোঝা গিয়েছিল।
হুমায়ূন আহমেদ লিখছেন, কন্যার ব্যগ্রতা ও ছুটোছুটি দেখে তিনি বুঝতে পারছিলেন বিশেষ কেউ ফোন করেছেন। এবং ফোন তুলে তিনি যখন শুনলেন এই মহীয়সী রমণীর কন্ঠ নিজেও আপ্লুত হয়েছিলেন।তিনি ফোন করেছিলেন এই আনন্দ একজন লেখকও তাঁর পরিবারকে এতোটা আপ্লুত করার কারণ অনেক।
এমনই ক্যারিশমা ছিলো এই নারীর!
দেশের জনপ্রিয়তম লেখক থেকে কথা শুনতে ও কথা রাখতে অবাধ্য নেতাদেরও তিনি এক কাতারে এনেছিলেন।
সাধারণ মানুষ যারা ধরে নিয়েছিলেন বাংলাদেশ চলবে ককটেলে। যে ককটেলের কিছু পাকিস্তান কিছু ভারত বাকীটা ধর্ম। এদেশে রাজাকার দালালদের সে নামে ডাকা যাবে না। পাকিস্তানি বাহিনীকে বলতে হবে হানাদার বাহিনী। মুজাহিদ ও নিজামীর গাড়ীতে উড়বে পতাকা ও সা কা চৌধুরীর মুখ থেকে শুনতে হবে অশ্রাব্য সব মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী কথা।
এমন কঠিন সময়ে জাতিকে উজ্জীবিত করা নারীটি এলেন কোথা থেকে? পিতার আনুকূল্যে লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে উচ্চ শিক্ষা শেষ করে ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী গার্লস স্কুলের টিচার। টানা চোখ উন্নত ললাট বাঁশীর মতো নাক। সুচিত্রা সেনের আদলে সুখী নারী। স্বামী সিভিল ইন্জিনিয়ার। নিজে তখন ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী গার্লসের প্রধান।
দুই পুত্র নিয়ে এলিফেন্ট রোডে সোনার সংসার। কিন্তু ইতিহাস যে বসে ছিল কণিকা নামের ঐ বাড়ীতে ঢোকার অপেক্ষায়।
পুত্র রুমী এসে দাঁড়িয়ে ছিলো মায়ের কাছে। অনুমতি চায়, কিসের অনুমতি? রুমীর কথা একটাই। বিদেশ গিয়ে পড়াশোনা করে বিত্ত সুখ সব হবে কিন্তু বিবেক তো শান্তি পাবে না। তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সে যদি তার যৌবন দেশমুক্তির জন্য উৎসর্গ না করে এই পাপ বহন করতে হবে আজীবন। ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড়ানো মা এক মূহুর্তে হয়ে উঠেছিলেন জননী। পুত্র কে কোরবানি দিলেন দেশমাতৃকার জন্য। রুমী হয়ে গেলো ইতিহাস। পুত্র শোকে পিতাও হলেন লোকান্তরিত। পড়ে রইলো কুরুক্ষেত্র বাংলাদেশ পড়ে রইলেন মা।
এই মা-ই আমাদের ভগ্নি প্রীতিলতা। বীরকন্যা বেগম রোকেয়া। তিনিই আমাদের জননী জাহানারা। জাহানারা নামের মতোই ইতিহাসের শোভিত বাগান।
যিনি না হলে পুরুষ নেতৃত্ব মুখে যাই বলুক ইতিহাস শুদ্ধ করতে পারতো না। যুদ্ধাপরাধীর বিচার বা শাস্তিও হতো না এ দেশে।
রাজনীতি কি বলে কেন বলে কখন বলে তার ধার ধারি না।
শুধু জানি শহীদ জননী আপনি আমাদের মা।
প্রয়াণ দিনে প্রণাম ও শ্রদ্ধা।
লেখক: অজয় দাশগুপ্ত, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া থেকে