রাজা সীতারাম রায় বাংলার একজন স্ব-স্বাসিত রাজা, মুঘল সাম্রাজ্যের একজন সামন্ত, যিনি মুঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে একটি স্বল্পস্থায়ী হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।


তিনি ১৬৫৮ সালে মহাপতিপুর, কাটোয়াতে জন্মগ্রহন করেন। তার পিতার নাম উদয় নারায়ন দাশ ও মাতা দয়াময়ী ঘোষ। তিনি বৈষ্ণব ধর্মানুসারী ছিলেন।



মাগুরার প্রামাণ্য ইতিহাসের নায়ক ভূষণা তথা মহম্মদপুরের রাজা সীতারাম রায়। বাংলার যে সমস্ত খ্যাতনামা জমিদার দেশের স্বাধীনতা রক্ষার্থে ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তৎমধ্যে মহম্মদপুরের রাজা সীতারাম  রায় ছিলেন অন্যতম।


সীতারাম রায়ের পূর্ব্বপুরুষগণ জেলা মুর্শিদাবাদের গিধনা গ্রামে বাস করিত। তাহারা চাষী দাস। তাহাদের অবস্থা অতি মন্দ ছিল। তাহারা পরিচর্যা, মজুরী এবং কৃষিকার্য্য করিয়া কষ্টে জীবিকানির্ব্বাহ করিত। সীতা- রামের পিতামহ হিমা দাস লেখা পড়া শিখিয়া এক জমিদারের পক্ষে 'খাস-বিশ্বাস' পদে নবাব দর্বারে নিযুক্ত হইয়াছিল। পূর্ব্বে সঙ্গতিপন্ন তালুকদার ও মহাজনেরা আপনাদের বিশ্বাসী কোন ব্যক্তিকে প্রতিনিধিরূপে রাজা জমিদারদিগের দরবারে রাখিত। তাহাকে বিশ্বাস বা মুক্তার বলিত। তেমনি আবার জমিদার ও রাজারা নবাব দরবারে নিজ নিজ প্রতিনিধি রাখিতেন তাহাদিগকে খাস-বিশ্বাস বা সদর নায়েব বা সদর মুক্তার বলিত। কখন বা একাধিক ব্যক্তির পক্ষে একজন মাত্র বিশ্বাস বা খাস-বিশ্বাস থাকিত। আবার কখন কখন একই ব্যক্তির পক্ষে একাধিক খাস-বিশ্বাস নিযুক্ত হইত। সেই বিশ্বাসেরা নিজ নিযোক্তাদিগের পক্ষে সদরে প্রয়োজনীয় কাৰ্য্য সকল সম্পাদন করিত এবং দরবারের নূতন পরিবর্তনাদি নিযোক্তাদিগকে জানাইত। বিশ্বাসেরা অন্ন বেতন পাইত। তদ্ভিন্ন তাহারা যে কাজে যত টাকা খরচ করিত তদপেক্ষা অনেক বেশী খরচ লিখিয়া নিযোক্তাগণের নিকট আদায় করিত। ইহাই তাহাদের উপরিপ্রাপ্তি ছিল। বিশ্বাসগণ সুবিধা পাইলে অন্যান্য চাকরী বা ব্যবসায়ও করিতে পারিত। বিশ্বাসদিগের পারসী জানা নিতান্ত আবশ্যক ছিল। পূর্ব্বে যে কোন জাতীয় শূদ্র হউক লেখা পড়া শিখিলেই সে কায়স্থ বলিয়া পরিচিত হইতে চেষ্টা করিত। সে কিছু অর্থব্যয় করিয়া প্রসিদ্ধ কায়স্থ বংশে দুই চারিটি বিবাহ আদান প্রদান করিলেই কায়স্থ বলিয়া গণ্য হইত। এখন যে সকল লোক মৌলিক কায়স্থ বলিয়া পরিচিত তাহাদের অধিকাংশই এইরূপ কৃত্রিম কায়স্থ। অধিকাংশ ধনবান্ ও গুণবান্ শূদ্র কায়স্থ-জাতিতে প্রবিষ্ট হওয়ায় কায়স্থ জাতির ধনবল, জনবল, এবং বিদ্যাবল অন্যান্য শূদ্র অপেক্ষা সমধিক হইয়াছে। হিমা দাস লেখা পড়া শিখিয়া খাস-বিশ্বাস হইয়াছিল। ঐ কর্ম্মে থাকিয়া ধনবান হইলেই সে কায়স্থ হইয়া উঠিল। তখন তাহার নাম "হিমাকর বিশ্বাস" হইল। ঘটকদিগকে কিছু মোটা হাতে অর্থ দিবামাত্র হিমাকরের পূর্ব্ব পুরুষদিগের নাম এবং সংকীর্ত্তি সমূহ কল্পিত হইল। সুতরাং বিদ্যা ও সম্পত্তি লাভ হইবামাত্র হিমা দাস মান্য গণ্য কায়স্থ হইলেন। হিমার পুত্র ভীমা দাসও তদবধি "উদয়রাম বিশ্বাস"। নামে আখ্যাত হইলেন। তাঁহারা হইলেন উত্তর রাঢ়ী কায়স্থ। কোন কৃত্রিম কায়স্থকে কুলীন কায়স্থ হইতে দেখা যায়।


উদয় নারায়ণ যখন বাংলা রাজধানী রাজমহলে কর্মরত তখন তিনি দয়াময়ী দেবী কে বিয়ে করেন ।দয়াময়ী ছিলেন কাটোয়ার খাস্তা ঘোষ পরিবারের কন্যা। আওরঙ্গজেবের দিল্লির মসনদে বসার কিছু সময় পূর্বে ১৬৫৮ সালে সীতারাম মহীপতিপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন দয়াময়ী এবং উদয়নারায়ন এর প্রথম সন্তান। সীতা রামের মা অত্যন্ত সাহসী ছিলেন। শৈশবে তিনি একদল ডাকাত এর মোকাবেলা করেছিলেন। মাতা দয়াময়ীর নাম অনুসারে মহম্মদপুরে ‘দয়াময়ী তলা’ নামে একটি গ্রাম আছে। কাটোয়ার অন্তর্গত মহিপতি গ্রামে ছিল সীতারামের মাতুলদের নিবাস।পিতা, পিতামহ ও প্রপিতামহ সকলেই ছিলেন মোগল রাজ কর্মচারী। পিতা উদয়নারায়ণ মোগল শাসনাধীনে ভূষণার রাজস্ব সংক্রান্ত উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন।


১৬৬০ সালে মীর জুমলা তার রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তর করেন। উদয়নারায়ন সে সময় ঢাকা চলে আসেন। তখন উদয়নারায়ন তার পরিবারকে সাথে আনেননি। ১৬৬৪ সালে শায়েস্তা খান বাংলার গভর্নর নিযুক্ত হন। এরপর উদয়নারায়ণ তহশীলদার পদে পদোন্নতি পরবর্তীকালে একটি তালুকের মালিক হন।বর্তমান ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলাধীন গুণবহা ইউনিয়নভূক্ত হরিহরনগরে তার বাসস্থান ছিল। কয়েক বছর পরে হরিহর নগরে মধুমতি নদীর তীরে তিনি তার বাসভবন নির্মাণ করেন এবং পরিবারকে তার কাছে নিয়ে আসেন। সীতারামের শৈশব কাটে কাটোয়ায় তার মাতুলালয়। সুজন পাঠশালায় সংস্কৃত শিখেছিলেন। বাংলা তখন চতুষ্পদী তে শেখানো হতো না। তাই নিজ গৃহে তিনি বাংলা শেখেন। তিনি চন্ডীদাস এবং জয়দেব পড়তে পারতেন। তার হাতের লেখা ছিল খুব সুন্দর। একটু বড় হলে তিনি ফারসি ভাষা শেখেন। তখন মুঘলদের সরকারি ভাষা ছিল ফারসি। ভূষণে আসার পর মুসলমানদের সংস্পর্শে এসে তিনি উর্দু ভাষা শেখেন। তিনি লাঠি খেলা, অস্ত্র চালনা, এবং অশ্বারোহণে পারদর্শী ছিলেন।


সীতারাম কীভাবে ভূষণার কর্তৃত্ব লাভ করেন তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। কেউ কেউ দস্যু সর্দার হিসেবে এলাকা দখলের কথা বলে থাকেন। তবে উত্তরাধীকারী সূত্রে তিনি ভূষণার জমিদারী লাভ করেন বলেই ধারণা করা হয়। চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি জমিদারী শুরু করেন। তরুণ বয়সে সীতারাম ঘন ঘন রাজধানী ঢাকায় আসতেন। সুবাদার শায়েস্তা খান তার সাহস এবং কর্মে মুগ্ধ ছিলেন। সে সময় পাঠান বিদ্রোহী করিম খান সাতারা পরগনায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। মুঘল ফোজদার বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হলে সীতারাম কয়েক হাজার পদাতিক এবং অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে এই বিদ্রোহ দমনে অভিযান শুরু করেন। তিনি বিদ্রোহ দমনে সফল হন। করিম খান যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। শায়েস্তা খান অত্যন্ত খুশি হয়ে তাকে নলদী পরগনার জায়গীর দান করেন।


জায়গিরদারি লাভ করার পরে তিনি একটি নিজস্ব সৈন্য বাহিনী গঠনে সচেষ্ট হন। সীতারামের সৈন্যদলে বহু মুসলমান সৈনিক ছিলেন। শোনা যায়, তিনি মুসলমান সেনাপতিদিগকে ভাই বলিয়া ডাকিতেন এবং হিন্দু মুসলমানের মিলনের জন্য সততা চেষ্টিত ছিলেন। বাগের হাটের খাঁন জাহান আলী মতো সীতারামেরও একদল বেলদার সৈন্য ছিল। ঢাকায় তার সাথে একজন ভাড়াটে সৈনিক রামরূপ ঘোষের পরিচয় হয়েছিল। করিম খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি তার সহযোগী ছিলেন। রামরুপ কুস্তিতে পারদর্শী ছিলেন। তিনি মেনা হাতি নামে পরিচিত ছিলেন। কারণে কোন এক সময় তিনি খালি হাতে একটি ছোট হাতি হত্যা করেছিলেন। রামরূপ সীতারামের সামরিক বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন। সীতারাম ভূষণার কর্তৃত্ব লাভ করার পর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকদেরকে নিয়ে বাহিনী গঠন করেন। মেনাহাতী, রূপচাঁদ ঢালী, বকতিয়ার খান, মৃতরা সিংহ, গোবর দলন প্রমুখ বিখ্যাত সেনাপতিরা সীতারামের সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করেছিলেন। মাগুরা ও ফরিদপুর জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় আজও যার বীরত্ব গাথা লোকমুখে ফেরে- তিনি হলেন সীতারামের প্রধান সেনাপতি মেনাহাতী। মেনাহতীর প্রকৃত নাম রূপনারায়ণ বা রামরূপ ঘোষ। কেউ কেউ বলেন মৃন্ময় ঘোষ। মেনাহাতী নড়াইল জেলার অন্তর্গত রায় গ্রাম নিবাসী ঘোষ বংশের পূর্বপুরুষদের একজন। দৈর্ঘ্যে ৭ হাত, প্রকান্ড মস্তক বিশিষ্ট বিশাল দেহী ছোট খাট হস্তী সদৃশ্য বিধায় মেনাহাতী বলে তার এই খ্যাতি। তবে স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী তিনি পিঁড়ি দিয়ে পিটিয়ে সীতারামের একটি হাতী হত্যা করেন বলে তার নাম হয়েছিল মেনাহাতী। গ্রাম এলাকায় আজও কেউ কেউ তাকে মেলাই হাতী বলে জানে। রূপচাঁদ ঢালী সীতারামের অপর একজন সেনাপতি ছিলেন। রূপচাঁদের বংশধরগণ মহম্মদপুর উপজেলার খলিশাখালী গ্রামে দীর্ঘকাল ধরে বসবাস করেন বলে জানা যায়। রাজা সীতারামের অপর একজন সেনাপতি শিবরাম চক্রবর্তীর নামানুসারে মাগুরা শহরের অদূরে ‘শিবরামপুর’ গ্রাম অবস্থিত। তার বাহিনীর অপর এক সেনাপতি ছিল ফকির মাচ্চকাটা। বক্তিয়ার খান ছিল একজন পাঠান দস্যু । আমল বেগ নামে একজন মুঘল সৈন্য তার বাহিনীতে যোগদান করে। রাজা সীতারাম তার এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় খ্যাতি অর্জন করেন। প্রাচীনকালে মাগুরা অঞ্চল সুন্দরবনের অংশ ছিল। বনাঞ্চলের আধিক্যের কারণে এ এলাকায় দস্যু তস্করদের উপদ্রব হতো। যদুনাথ ভট্টাচার্য তার ‘সীতারাম রায়’ গ্রন্থেরাখা, শ্যামা, রামা, মুম্ভো, বিশে, হরে, নিমে, কালা, দিনে, ভুলো, জগা ও জেদো এই ১২জন কুখ্যাত ডাকাতের উল্লেখ করেছেন। তিনি ভূষণা, হরিহর নগর, মহম্মদপুর, নলদী ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মগ ও ফিরিঙ্গী দস্যুদের কঠোর হস্তে দমন করেন।মুঘল সম্রাট শাহজাহানের মৃত্যুর পর সমগ্র সুবাহ বাংলা জুড়ে এক অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সমগ্র নলদী পরগনা জুড়ে দস্যুদের দৌরাত্ম্য শুরু হয়। এজন্য প্রাচীন কবিতার বলা হয়,


“ধন্য রাজা সীতারাম বাংলা বাহাদুর 

যার বলেতে চুরি ডাকাতি হয়ে গেল দূর। 

এখন বাঘ মানুষে একই ঘাটে সুখে জল খাবে 

এখন রামী শ্যামী পোঁটলা বেঁধে গঙ্গা স্নানে যাবে॥” 


অধিকান্ত তিনি বাংলার উপকূল অঞ্চলেও মগ ও ফিরিঙ্গীদের উপদ্রব বন্ধের জন্য চেষ্টা করেন। ১৬৮৪ সালে তার পিতা ও মাতা খুব স্বল্প সময়ের ব্যবধানে মারা যান। তাদের শ্রাদ্ধের পর তিনি তীর্থ করতে গয়ায় যান। তার সচিব মনিরাম রায় এবং প্রধান সহযোগী রামরূপ ঘোষ তার সাথী হন। জায়গীর এর দায়িত্ব তার ছোটভাই লক্ষ্মীনারায়ণের নিকট হস্তান্তর করা হয়। উত্তর ভারতে তীর্থ করে তিনি সম্রাট আত্তরঙ্গজেবের সঙ্গে দেখা করেন এবং এতদ অঞ্চলের নৈরাজ্যের কথা তাকে অবহিত করেন। শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে সীতারামকে সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান পূর্বক সম্রাট ১৬৮৭-৮৮ খ্রীস্টাব্দে তাকে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তার রাজ্যকে আরো দক্ষিণে সুন্দরবন পর্যন্ত বিস্তৃত করার অধিকার দেয়া হয়। দিল্লী হতে ফিরে এসে তিনি সুবাদার মুর্শিদকূলী খানের সনদ ও অনুমতি বলে উপকূল অঞ্চলে দুর্গ নির্মাণ ও সৈন্য মোতায়েন করেন। ফলে এতদঞ্চলে শান্তি ফিরে এসেছিল এবং জনগণও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল।


একই বছর সীতারাম নালদি, সাঁতার এবং ভাটি অঞ্চলের রাজা হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। রাজা সীতারাম রায় তার পৈতৃক নিবাস মধুমতি নদীর তীরবর্তী হরিহর নগর নামে একটি শহর প্রতিষ্ঠা করেন। এ শহরটিতে বেশ কিছু সুরম্য ইমারত ও মন্দির নির্মাণ করেন। জনগণের পানীয় জলের কষ্ট লাঘবের জন্য খনন করেন কয়েকটি দীঘি। সে আমলে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র রূপে গড়ে উঠে এই হরিহর নগর। এখনও এখানে এসবের কিছু ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। রাজা হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করলেও তার কোন রাজধানী ছিল না। তাই তিনি বর্তমান মাগুরার মহম্মদপুরে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। রাজা সীতারাম ১৬৯৭-৯৮ খ্রীস্টাব্দে মহম্মদপুরে রাজধানী স্থাপন করেন।মহম্মদপুরে তিনদিকে বিল এবং একদিকে মধুমতি নদী দ্বারা বেষ্টিত ছিল। দুর্গটি চতুর্ভুজ আকারে তৈরি করা হয়েছিল। যার এক একটি বাহুর পরিমাপ ১৩০০ ফিট বা ৪০০ মিটার এর কম ছিল না। দুর্গটির চারিদিকে প্রসস্থ পরিখা ছিল। দুর্গটির উত্তরায় ও পূর্বে ছিল কালিগঙ্গা নদী। দুর্গের ভিতরে সেনা ছাউনি, মন্দির এবং জলাধার ছিল। মহম্মদপুরকে রাজধানীর স্থান হিসেবে নির্ধারণ করার ব্যাপারে একটি প্রবাদ আছে। আর তা হ’ল, একদিন সীতারাম ঘোড়ায় চড়ে এই পথ দিয়ে যান। পথিমধ্যে হঠাৎ তার ঘোড়ার পা মৃত্তিকা গর্ভে আটকে যায়। শত চেষ্টা সত্ত্বেও ঘোড়ার পা মৃত্তিকা থেকে উঠাতে পারেন না। পরে লোকজন দিয়ে স্থানটি খনন করে ঘোড়ার পা উদ্ধার করেন। খননকালে এখানে একটি মন্দির আবিষ্কৃত হয়। আর মন্দিরে তিনি পান লক্ষীনারায়ণের মুর্তি। লক্ষীনারায়ণ সৌভাগ্যের প্রতীক। তাই স্থানটিকে শুভ মনে করে সীতারাম প্রথমত এখানে নিজের বাসভবন নির্মাণ ও পরে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। রাজধানীর নামকরণের ব্যাপারে একাধিক মত আছে। কেউ মনে করে স্থানীয় মুসলিম ফকির মোহাম্মদ শাহের নামানুসারে তার রাজধানীর পুরাতন নাম বাগজান এর স্থলে মহম্মদপুর নামকরণ করেন।আবার কেউ মনে করেন সূফীসাধক মুহম্মদ আলী শাহ এর নামানুসারে সীতারাম রায় রাজধানীর নাম মহম্মদপুর রাখেন। অবশ্য মহম্মদপুর থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে বড়রিয়া গ্রামে আলী মাওলার দরগাহ ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হিসেবে অদ্যাবধি বিদ্যমান। আবার কেউ কেউ মনে করেন ইসলাম ধর্মের শ্রেষ্ঠ প্রচারক মহানবী হযরত মুহম্মদ এর নামানুসারেই সীতারাম তার মুসলমান প্রজাদের মনোরঞ্জনের জন্য রাজধানীর নাম ‘মহম্মদপুর’ রাখেন। মহাম্মদপুর সীতারামের রাজধানী হিসেবে বাংলাদেশের অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ নগরীতে পরিণত হয়। এখানে এক সময় গৌড় বঙ্গের একটি টাঁকশাল ছিল বলে জানা যায়। ব্যবসায়ীগণকে সব সময় মহম্মদপুরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠার জন্য উৎসাহিত করতেন। ক্রমেই মহম্মদপুরে এই অঞ্চলের একটি উঠতি ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। সীতারাম তার সেনাবাহিনীতে নতুন সৈন্য ভর্তি করেন এবং গোলন্দাজ ডিভিশন চালু করেন। তার দুটি বিখ্যাত কামান কালে খান এবং ঝুমঝুম খান এই সময় বাহিনীতে সংযোগ করা হয়। মহম্মদপুরে সমৃদ্ধির সময়ে মধুমতি নদী এই স্থানের প্রান্ত দিয়া প্রবাহিত ছিল একসময়। 


প্রধান সেনাপতি মেনাহাতীর মৃত্যুর পরও সীতারাম প্রাণপণে মোগল বাহিনীর সঙ্গে লড়াই অব্যাহত রাখেন। সীতারাম শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দী হয়ে মুর্শিদাবাদে প্রেরিত হন। কথিত আছে যে তাকে লোহার খাঁচায় বন্দী করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যাওয়া হয়। নাটোর রাজ্যের সেনাপতি দয়ারাম রায় তাকে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যান। দিঘাপতিয়ায় যাবারকালে পথিমধ্যে নাটোর রাজবাড়ীর কারাগারে বন্দী রাখা হয়। রাজা সীতারামকে যে কক্ষে বন্দী রাখা হয় তা আজও বিদ্যমান। মুর্শিদাবাদে কয়েকমাস বন্দী অবস্থায় থাকার পর নবাব তাকে মৃত্যুদন্ডে দণ্ডিত করেন।

অবশ্য সীতারামের মৃত্যু সম্পর্কে বিভিন্ন কথা শোনা যায়। কারো মতে তিনি বিষপানে আত্মহত্যা করেন। জে. ওয়েস্টল্যান্ড সীতারামের মৃত্যু সম্পর্কে বলেন, বন্দী অবস্থায় তাকে ঢাকায় নবাবের কাছে নেওয়া হয়। বন্দীশালায় নবাব তার প্রতি এক নজর তাকান। তাকে অল্প সময় সেখানে অবস্থান করানো হয়। নবাবের একজন অফিসার এসে তাকে বলে, জীবনের আশা নেই। অবশ্যই তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে। প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য রাজা সীতারাম রায় সবসময় বিষযুক্ত আংটি হাতে রাখতেন। অবশেষে তিনি সেই বিষ পান করে আত্মহত্যা করেন। যদুনাথ ভট্টাচার্যের মতে, “কোন শাল বিক্রেতাদিগের সাথে যুদ্ধ করিয়া গঙ্গাতীরে মৃত্যুর কথাই সীতারামের গুরম্নকুল পঞ্জিকায় লিখিত আছে। সীতারামকে কেহ নিহত করেন নাই অথবা তিনি আত্মহত্যা করেন নাই”। সীতারামের মৃত্যু সম্পর্কেও মহম্মদপুর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে প্রচলিত কিংবদন্তি হল, অত্যাচারী রাজা সীতারাম প্রতিশোধের আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রামসাগরে নৌকায় স্বহস্তে কুড়াল মেরে সপরিবারে জ্বলে ডুবে আত্মহুতি দেন। আবার অনেকের মতে, মোগলদের নিকট থেকে রাজ্যের স্বাধীনতা রক্ষা করতে ব্যর্থ রাজা সীতারাম পরিবার পরিজন নিয়ে একখানি মজবুত কাষ্ঠ নির্মিত নৌকায় উঠেন এবং রামসাগরের মধ্যে নিয়ে যান। তার পর নৌকার মধ্যখানে কুঠারাঘাত করেন। ফলে নৌকার মধ্যে হু হু করে পানি উঠে এবং ফলস্বরূপ নৌকা ডুবে যায়। আর এর সঙ্গে রামসাগরের অতল তলে হারিয়ে যায় রাজা সীতারাম ও তার পরিবার পরিজন। সত্যিই স্বাধীনচেতা, পরোপকারী মহম্মদপুরের এই রাজার মৃত্যু আজও রহস্যাবৃত রয়ে গেছে। এমনকি তার মৃত্যু সন তারিখ নিয়েও মতভেদ আছে। তার মৃত্যুর সন ১৭১৪ খ্রি., ১৭১৮ খ্রি., ১৭২২ খ্রি., ১৭২৪ খ্রি. বলে বিভিন্ন বর্ণনায় পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।


রাজা সীতারাম রায়কে নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন উপন্যাস সীতারাম ও উমা ভট্টাচার্য লিখেছেন গল্প রাজা সীতারাম রায়।


মহম্মদপুরের গৌরব রাজা সীতারাম রায় আজ আর নেই, কিন্তু তার অসংখ্যা কীর্তিকালের করাল গ্রাসকে উপেক্ষা করে তার কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। তিনি নির্মাণ করেন মুহম্মদপুর দুর্গ, একাধিক প্রাসাদ, অসংখ্যা মন্দির ও দীঘি। যা মহম্মদপুর সমৃদ্ধির সময়ে মধুমতি নদী এই স্থানের প্রান্ত দিয়া প্রবাহিত ছিল একসময়।  ১৮৩৬ খ্রীষ্টাব্দে  মহামারীর ফলে মহম্মদপুর প্রায় বিরান হয়ে যায়।  কথিত আছে, সীতারামের সৈন্য ছিল ২২০০ এবং যুদ্ধের সময় ছাড়া অন্য সময় তারা জনসাধারনের পানীয় জলের জন্য জলাশয় খনন খনন করতো।উহাদের মধ্যে প্রাচীন দুর্গের ধ্বংসাবশেষ, রাম সাগর, সুখ সাগর ও কৃষ্ণসাগর নামে দীঘি, দোল মঞ্চ ও রাজভবনের ধ্বংসাবশেষ সিংহদরওজা, মালখানা, তোষাখানা, দশভুজা মন্দির, লক্ষ্মী নারায়ণের অষ্টকোন মন্দির, কৃষ্ণজীর মন্দির প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। অতীতে এই দুর্গের চর্তুদ্দিকস্থ খাত দিয়া মধুমতির স্রোত প্রবাহিত হইতো। মাগুরা সদর হতে ২৫ কি.মি. দূরে মহম্মদপুর উপজেলায় রাজবাড়ি নামক স্থানে রাজা সীতারাম রায়ের বাড়িটি অবস্থিত। মহম্মদপুর বাস স্ট্যান্ড হতে আধা কিলোমিটার উত্তরে পাকা রাস্তার পার্শ্বে রাজবাড়ির অবস্থান। রিক্সা, ভ্যান অথবা পায়ে হেটে যাতায়াত করা।