নেত্রকোনাঃ দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী, সাম্যবাদী তাত্ত্বিক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক, স্বাধীনতা পুরষ্কার ও বাংলা একাডেমি পদক প্রাপ্ত অধ্যাপক যতীন সরকার পরলোকগমন করেছেন।
বুধবার(১৩ আগস্ট) বেলা পৌনে তিনটার দিকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার পরিবার গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
দীর্ঘদিন ধরে কিডনিসংক্রান্ত জটিলতাসহ বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন যতীন সরকার। গত জুন মাসে ঢাকার একটি হাসপাতালে তার অস্ত্রোপচার হয়। এরপর থেকে বেশির ভাগ সময় তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। দিন কয়েক আগে তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ময়মনসিংহ জেলা সাধারণ সম্পাদক শেখ বাহার মজুমদার জানান, হাসপাতাল থেকে মরদেহ জেলা উদীচী কার্যালয়ে নেওয়া হবে, যেখানে সর্বসাধারণ তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। পরে মরদেহ নিজ জেলা নেত্রকোনায় নিয়ে যাওয়া হবে এবং সেখানেই তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে।
১৯৩৬ সালের ১৮ আগস্ট নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার চন্দপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন যতীন সরকার। ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক এই শিক্ষক সুদীর্ঘকাল ধরে মননশীল সাহিত্যচর্চা, বামপন্থী রাজনীতি ও প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি দুই মেয়াদে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা ছিল অনন্য।
লেখালেখির পাশাপাশি তিনি বহু পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন। ২০১০ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার, ২০০৭ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ২০০৫ সালে ‘পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন’ গ্রন্থের জন্য প্রথম আলো বর্ষসেরা গ্রন্থ পুরস্কারসহ ড. এনামুল হক স্বর্ণপদক, খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার, মনিরুদ্দীন ইউসুফ সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।
দীর্ঘ ৪২ বছরের শিক্ষকতা জীবনের পর ২০০২ সালে অবসর নিয়ে স্ত্রী কানন সরকারকে নিয়ে নেত্রকোনায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তিনি শহরের সাতপাই এলাকায় নিজ বাসভবনে থাকতেন। মৃত্যুকালে তিনি এক ছেলে সুমন সরকার, এক মেয়ে সুদীপ্তা সরকারসহ অসংখ্য স্বজন, গুণগ্রাহী ও ভক্ত রেখে গেছেন।
ছাত্রজীবনেই লেখালেখি শুরু করলেও তার প্রথম গ্রন্থ ‘সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে। এরপর প্রকাশিত হয় ‘বাংলাদেশের কবি গান’, ‘বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য’, ‘সংস্কৃতির সংগ্রাম’, ‘গল্পে গল্পে ব্যাকরণ’, ‘মানবমন মানব ধর্ম ও সমাজ বিপ্লব’, ‘পাকিস্তানের ভূত দর্শন’, ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব নিয়তিবাদ ও বিজ্ঞান চেতনা’, ‘ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের ভূতভবিষ্যৎ’, ‘বিনষ্ট রাজনীতি ও সংস্কৃতি’, ‘প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন’, ‘ভাবনার মুক্তবাতায়ন’সহ অর্ধশতাধিক গ্রন্থ। তিনি ‘সমাজ অর্থনীতি ও রাষ্ট্র’ নামে তত্ত্বমূলক ত্রৈমাসিক পত্রিকারও সম্পাদক ছিলেন।
তার মৃত্যুতে নেত্রকোনা উদীচী, জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ জেলা শাখা, নেত্রকোনা সাহিত্য সমাজসহ নানা সাংস্কৃতিক সংগঠন গভীর শোক প্রকাশ করেছে।
নেত্রকোনা প্রতিনিধি
বাংলাদেশদর্পন.কম