মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা গত বিশ দিনে বিশটা শাড়ি পরে ফ্যাশন শো করতে মিডিয়ার সামনে আসছেন! ঘোমটাহীন শরীর আর শাড়ির সংখ্যা মানুষকে দেখানোই তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য! এমন মহিলা করোনা ভাইরাসের কী মোকাবেলা করবে? করোনা আক্রান্ত মানুষদের নিয়ে তাঁর কোনো চিন্তা-ভাবনা করার সময় আছে না কি? সে আছে তার মেকআপ আর সাজগোজ নিয়ে!

সামাজিক মাধ্যমে এমন মন্তব্যসহ কয়েকদিনে পরা কয়েকটি শাড়ির ছবি একসাথে একটি ছবিতে রীতিমত ভাইরাল। জাতি যখন করোনাভীতিতে ম্রিয়মাণ, তখনও আমাদের এসব নিয়ে পড়ে থাকতে হয়। আসলে আমাদের লজ্জা নেই, আমাদের লজ্জা থাকতে নেই। মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা আইইডিসিআর বা রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর পরিচালক। তিনি একজন রোগতত্ত্ববিদ এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। এছাড়াও তাঁর আরও পরিচয় রয়েছে। তাকে দেখা গেছে চিকুনগুনিয়ার সময়, জিকা ভাইরাসের আক্রমণের সময়টাতেও সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে। এবার যখন বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের মহামারি ধীরে ধীরে বাড়ছে, এবারও ফ্রন্টলাইনে এসে দাঁড়িয়েছেন সেব্রিনা ফ্লোরা। এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে ব্যস্ত মানুষদের একজন তিনি, সারাক্ষণই খোঁজখবর রাখতে হচ্ছে তাকে, আপডেট দিতে হচ্ছে মিডিয়াকে। নতুন করে কারো মধ্যে করোনার সংক্রমণ দেখা দিলেই সেটা জানাচ্ছেন তিনি, সবকিছু সামলাচ্ছেন দক্ষতার সঙ্গে চমৎকারভাবে।

করোনা পরিস্থিতি নিয়ে নিয়মিত ব্রিফ শুরু করার দিন থেকে নিত্যনতুন শাড়ি পরা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেব্রিনা ফ্লোরাকে নিয়ে অনেকে অনেক মন্তব্য করছেন। একজন মানুষ প্রতিদিন নতুন শাড়ি পরে মিডিয়ার সামনে আসেন। এতে আমাদের সমস্যা থাকার কথা না। তিনি নতুন শাড়ি পড়তেই পারেন। এটা নিয়ে আমরা কথা বলতে পারি না। আমরা তো এটা ভাবছি না, তিনি কতটা ব্যস্ত। এই সংক্রামক ভাইরাসের সময়ে একই শাড়ি প্রতিদিন পরা অবশ্যই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। তিনি কতটা ব্যস্ত থাকে তা আমরা জানি, এই ব্যস্ততার মধ্যে তিনি শাড়ি ধোয়ার সময় পাবেন কখন? তার মতো একজন সম্ভ্রান্ত-বয়স্ক মহিলার আলমারি ভরা শাড়ি থাকতেই পারে। নিজের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে প্রতিদিন নতুন শাড়ি তিনি পরতেই পারেন। এমনটা তো আমরা ভাবছি না। তাছাড়া আমাদের চর্চা করার মতো আরও অনেক কিছু আছে। অন্তত একজন মানুষের প্রতিদিন আলাদা আলাদা শাড়ি পরার কারণে সমালোচনা করতে আমাদের বিবেকে বাধা উচিত। দেশে অসঙ্গতিপূর্ণ অনেক কিছু ঘটে চলেছে। মানুষ হয়ে মানুষকে নির্যাতন করছে। কত দুঃখী মানুষ খেতে পাচ্ছে না-- রোগে-শোকে, অবহেলায় মৃত্যুবরণ করছে। খুন হচ্ছে, ধর্ষণের মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনাও ঘটছে। সেদিন পত্রিকায় দেখলাম, কোনো এক মসজিদের ইমাম ধর্ষণের পর খুন করে মসজিদে আজান দিয়েছে। কই, এমন পাশবিক ঘটনার শাস্তি চেয়ে আমরা কথা বললাম না তো! করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবার জন্য নতুন হাসপাতাল বানাতে দিলাম না আমরা। কই, সেটা নিয়ে ফেসবুক গরম হতে দেখলাম না তো! নাকি এগুলো আমরা মনে মনে সমর্থন করি?

যা নিয়ে কথা বলা উচিত তা নিয়ে কথা বলছি না। যেসব নিয়ে কথা বলা সমীচীন নয়, সেসব নিয়ে ফেসবুক মাতাচ্ছি। এমন অসঙ্গতিপূর্ণ ব্যবহার আমাদের ভবিষ্যতের জন্য মোটেও ভালো নয়। আমাদের এব্যাপারে এখনই সচেতন হওয়া উচিত। মানুষকে সম্মান দেওয়া উচিত। মানুষকে সম্মান দিলে আমাদের সম্মান বাড়ে ছাড়া কমে না। মনিরামপুরের বয়স্ক ব্যক্তিদের সম্মানের কথা ভেবেছি আমরা। সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনার ঝড়ে ভূমি কমিশনারকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরার সম্মান রাখার দায়িত্বও আমাদের। অতিপুরুষতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে তাঁকে মানুষ হিসেবে সম্মান করা প্রতিটি সভ্য মানুষের কর্তব্য। দেশের এই ক্রান্তিকালে, মহাসংকটকালে মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরাদের মত মানুষেরাই তো আমাদের আইকন, সত্যিকারের আয়রন লেডি।

তাঁদের নিয়ে এভাবে মন্তব্য করে নিজেদেরকে আর লজ্জিত না করি। আমাদের এহেন ব্যবহারে, আমাদের আসল পরিচয় বেরিয়ে আসছে। আমাদের ভেতরের কলুষ হৃদয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অন্তত তাঁর নিত্যনতুন শাড়ি পরা নিয়ে মন্তব্য করে নিজের পরিচয়কে আর কলুষিত না করি।

মিন্টু ভদ্র, বিশেষ প্রতিবেদক, বাংলাদেশ দর্পণ