বীরেন্দ্র নাথ অধিকারী ||
প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে পৌরাণিক ভারতবর্ষে বিভিন্ন সময়কালে নৃতাত্ত্বিক বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ-জাতিসত্তার উদ্ভব ঘটে। তবে জাতিগতভাবে এ ভূঅঞ্চলের প্রথম জনগোষ্ঠী ‘হিন্দু’ বলে পরিচিত ছিল। বৈদিক ও প্রস্তর যুগে সিন্ধু নদের অববাহিকায় এই জনগোষ্ঠীর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল বলে হিন্দুদের জীবনাচার, সংস্কৃতি, কৃষ্টি এবং ঈশ্বরীয় বিশ্বাস ও তা লালন-পালন থেকে ‘হিন্দু’ধর্মের আবির্ভাব ঘটে।
খৃষ্টপূর্ব ৫২৮ সালে ‘বৌদ্ধ’ধর্মের আর্বিভাবের পূর্বে ভারতবর্ষে হিন্দুধর্মের একছত্র আধিপত্য বিরাজ করে। এরপর হিন্দুদের ব্যাপক এক জনগোষ্ঠী বৌদ্ধধর্মে ধর্মান্তরিত হয়। আবার ৭১২ খৃষ্টাব্দে মুসলমানদের আগমনের পর থেকে ভারতবর্ষের হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয় ধর্মেরই বিপুলসখংখ্যক জনগোষ্ঠী ‘ইসলাম’ ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে সংখ্যায় কম হলেও ভারতবর্ষে শিখ, জৈন, পার্সী প্রভৃতি ধর্মের জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। আর মুঘল শাসনের অবসানের পর ইউরোপীয় বণিক ও শাসকদের প্রভাবে খ্রীষ্টধর্মেও কিছু ভারতীয় ধর্মান্তরিত হয়। এভাবে বিংশ শতাব্দীতে এসে ভারতবর্ষে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, শিখ, জৈন, পার্সী প্রভৃতি সব ধর্মের কমবেশি জনগোষ্ঠী’র সহাবস্থান বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন সময় ধর্মেধর্মে সংঘাতও দেখা যায়। তবে তারও পূর্বে প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ এবং জ্ঞান, কর্ম ও পেশার ভিত্তিতে ভারতবর্ষে নানান জাত-পাতের সৃষ্টি হয়। এভাবে বহুধা বিভক্ত ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় ধর্মীয়, সাম্প্রদায়িক এবং গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটে।
১৮৩৫ সালে ভারতবর্ষে ইংরেজিসহ আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলন হলে ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাষ্ট্রনীতি, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে ভারতীয়দের জ্ঞানের দুয়ার খুলে যায়। ফলে ক্রমান্বয়ে তাদের মধ্যে স্বাধীনতার বাসনা জাগ্রত হতে থাকে। তাছাড়া, ১৮৫৭ সালে ঐতিহাসিক ‘সিপাহী বিপ্লব’ সংঘটিত হলে ইংরেজরা সেই বিপ্লব দমনে সফল হলেও এতে ভারতীয়দের মনে তীব্র রেখাপাতের সৃষ্টি করে এবং ক্রমান্বয়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠিত ও কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে থাকে। এসব কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য তখনো সর্বভারতীয় কোনো রাজনৈকিত দল ছিল না। ১৮৮৫ সালের ডিসেম্বরে মুম্বাইয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ নামে রাজনৈতিক দল গঠনের মধ্য দিয়ে এই শূন্যতা পূরণ হয়। মূলত হিন্দুদের উদ্যোগে কংগ্রেস গঠিত হলেও প্রাথমিকভাবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী হিন্দু ও মুসলমান সকলেই এই দলের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তবে কিছুদিনের মধেই মুসলমান নেতৃবৃন্দ একটি আলাদা রাজনৈতিক দল গঠনের তাগিদ অনুভব করেন। ফলে ১৯০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় সর্বভারতীয় মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এভাবে ভারতবর্ষে হিন্দুদের কর্তৃক মূল নেতৃত্ব দেয়া ‘কংগ্রেস’ এবং মুসলমানদের নিজস্ব সংগঠন ‘মুসলিম লীগ’ নামক ভিন্ন ধারার দু’টি রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড শুরু হয়।
ইত্যবসরে ইংরেজ শাসকরা বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে বঙ্গভঙ্গ কর্মসূচি কার্যকর করে। ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ প্রদেশের জাতিক, ভাষিক ও সামাজিক বৈশিষ্ট্যাবলী নির্দিষ্ট থাকবে বলে বৃটিশ সরকারের ঘোষণা সত্ত্বেও বঙ্গভঙ্গোত্তর নবগঠিত এই প্রদেশের ধর্মভিত্তিক জনসংখ্যাতত্ত্বে বিশাল পরিবর্তন সুস্পষ্ট লক্ষণীয়। নবগঠিত এই প্রদেশের মোট জনসংখ্যা ৩ কোটি ১ লক্ষের মধ্যে ১ কোটি ৮০ লক্ষ মুসলমান, ১ কোটি ২০ লক্ষ হিন্দু এবং ১ লক্ষ অন্যান্য ধর্ম ও জাতিভুক্ত ছিল। এতে শতকরা হিসেবে দেখা যাচ্ছে- ঐ সময় এখানে মোট জনসংখ্যার ৫৯.৫% মুসলমান এবং ৩৯.৫% হিন্দু ধর্মাবলম্বী অধিবাসী ছিল। মূলত বঙ্গভঙ্গের কারণেই জনসংখ্যার হিসাবে এখানে হিন্দুরা সংখ্যাঘলুতে পরিণত হয়ে যায়। উল্লেখ্য, অভিক্ত বঙ্গে বরাবরই হিন্দুসংখ্যাধিক্য বিরাজমান ছিল।
তৎকালীন ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চল বৃটিশদের জন্য রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে সবচেয়ে বিপদসংকুল ছিল। মুখ্যত এ কারণেই তারা কূটবুদ্ধি পাকিয়ে এবং নানা প্রকার তত্ত্ব, তথ্য ও যুক্তি হাজিরপূর্বক দু’টি বৃহত্তর ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে বঙ্গভঙ্গ করে। এ কারণে হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই ধারার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এতে কেবলমাত্র নবগঠিত ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ প্রদেশেরই নয়, গোটা ভারতবর্ষের বাংলা ভাষাভাষী হিন্দুদের মধ্যে প্রচণ্ড বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে নবগঠিত এই প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং ঢাকা সেই প্রদেশের রাজধানী হওয়ার কারণে তাদের মধ্যে অনেকটা আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। হিন্দুরা মূলত বঙ্গভঙ্গ প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করে আসছিল।
বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ার দিন থেকে তৎকালীন সমগ্র পূর্ব ভারতজুড়ে প্রচণ্ড রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। এতে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হয় পশ্চিমবঙ্গবাসী। তারা এই বিভক্তি কোনভাবেই মেনে নিতে পারল না। তাই এ সময় বাঙালি জাতীয়তাবাদী প্রচুর পরিমাণ লেখালেখি প্রকাশ হতে থাকে। বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে বৃহৎ বঙ্গের জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙালির চেতনার জগতে আলোড়ন সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অসংখ্য দেশাত্মবোধক সঙ্গীত রচনা ও মরমী সুরারোপ এবং সেসব চারণ কবিদের মিছিলে-মিছিলে পরিবেশন করেন। উল্লেখ্য, পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ এবং ‘ও আমার দেশের মাটি’সহ তাঁর বিখ্যাত সব দেশাত্মবোধক গানগুলো ঐ সময়েই রচিত। তাছাড়া বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে বৃহত্তর বঙ্গজুড়ে হরতাল, বিদেশি পণ্য বর্জন, রাখিবন্ধন, স্বরাজ, স্বদেশী ইত্যাদি শান্তিপূর্ণ এবং একই সাথে কিছু চরমপন্থী আন্দোলনও পরিচালিত হতে থাকে। এসব প্রতিবাদের ফলশ্রুতিতে ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর বৃটিশরা পুনরায় দুই বঙ্গ একত্রিত করতে বাধ্য হয়।
এভাবে বঙ্গভঙ্গ রদের কারণে হিন্দুদের আত্মতৃপ্তি ঘটলেও, ইতিপূর্বে বঙ্গভঙ্গের মধ্য দিয়ে নতুন প্রদেশ সৃষ্টির ফলে পূর্ববঙ্গের মসুলমানদের মধ্যে শিক্ষা, কর্মসংস্থান ইত্যাদির ক্ষেত্রে সুযোগ বেড়ে যাবে বলে তাদের ধারণায় ভাটা পড়ে। সঙ্গত কারণেই তারা হতাশ এবং ক্রোধান্বিত হয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ, ১৯০৯ সালে আলাদা নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন, ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ ইত্যাদি কারণে এ অঞ্চলের হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভেদরেখা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে থাকে। এই বিভাজনের অগ্নিতে রয়ে-রয়ে ঘৃতবর্ষণের মধ্য দিয়ে ইংরেজ শাসকরা সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দিতে থাকে।
বঙ্গভঙ্গ রদের কারণে সে সময়ে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া মুসলমান জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে তাদের মধ্যে ক্ষোভের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এই ক্ষোভ প্রশমনে ইংরেজ শাসকরা নানা প্রকার কসরত করে ১৯২১ সালের ২১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও ধর্মভিত্তিক সম্প্রদায়গুলোকে বিশেষ বিবেচনায় নেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলোর ধর্মীয় সম্প্রদায়ভিত্তিক আবাসিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের স্বীয় বিবেচনায় পাঠ্য বিষয় এবং ধর্মভিত্তিক সম্প্রদায়ের আলোকে সাধারণত কলা অনুষদ ও আইন বিভাগের অমুসলমান ছাত্রদের জন্য জগন্নাথ হল, শুধু মুসলমান ছাত্রদের জন্য মুসলিম হল এবং ধর্মনির্বিশেষে বিজ্ঞান বিভাগগুলোর ছাত্রদের জন্য ঢাকা হলকে ছাত্রাবাস হিসেবে নির্ধারণ করা হয়।
কেবলমাত্র বঙ্গ প্রদেশেই নয়, হিন্দু এবং মুসলমানদের ভেদাভেদের বিষয়গুলো কমবেশি সারা ভারতবর্ষজুড়েই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে থাকার মধ্য দিয়েই উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন চলতে থাকে। ইতিপূর্বে গঠিত দু’টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে কংগ্রেসে হিন্দুদের আধিপত্য এবং মুসলিম লীগ কেবলমাত্র মুসলমানদের দল হওয়ার কারণে স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রেও তাদের মধ্যে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। তা সত্ত্বেও দল দু’টি ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য ক্রমান্বয়ে সোচ্চার হতে থাকে। দৃশ্যত, কংগ্রেস সামগ্রিকভাবে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার কথা বললেও মুসলিম লীগ মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য বিশেষ কিছু আলাদা দাবি উত্থাপন করতে থাকে। প্রাথমিকভাবে মুসলমানদের এসব দাবির মধ্যে মুসলমান অধ্যুষিত এলাকাগুলোকে নিয়ে স্বায়ত্ত্বশাসিত একাধিক প্রদেশ গঠনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের পর মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপিত হয়।
ইতোমধ্যে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দেশে প্রত্যাবর্তন করে কংগ্রেস দলীয় নেতৃত্বে আসীন হন। তিনি অহিংস পন্থায় বর্ণবিদ্বেষ বিরোধী ও অসাম্প্রায়িক ধারার রাজনীতি প্রবর্তনের মাধ্যমে অখণ্ড ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করেন। প্রায় সমসাময়িককালে বিলেত থেকে ফিরে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ও হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের মাধ্যমে অখণ্ড ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে কংগ্রেসের পতাকাতলেই রাজনীতি শুরু করেন। কিন্তু নানামুখী টানাপড়েনে ভারতবর্ষের অখণ্ডতা এবং বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়, বিশেষত হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে একতা রক্ষায় এই দুই নেতার প্রচেষ্টা ক্রমান্বয়ে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে থাকে। এরই এক পর্যায়ে ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সম্মেলনে ‘দ্বি-জাতি তত্ত্বের’ভিত্তিতে শেরেবাংলা এ, কে, ফজলুল হক মুসলমানদের জন্য একাধিক স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব উত্থাপন করেন। আশ্চর্য হলেও সত্য, উক্ত প্রস্তাব উত্থাপনকালে অসাম্প্রদায়িক এবং অখল্ড ভারতবর্ষের অন্যতম প্রবক্তা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ সভাপতিত্ব করেন।
উল্লেখ্য, ‘হিন্দু’ এবং ‘মুসলমানদের’ ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে তাদেরকে ‘হিন্দু জাতি’ এবং ‘মুসলমান জাতি’ আখ্যায়িত করে এক অদ্ভুত ‘দ্বি-জাতি’ তত্ত্ব আবিষ্কার করা হয়। ফলে হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে বিদ্বেষ নতুন মাত্রা পাওয়ার জের ধরে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়। সেসবের মধ্যে জিন্নাহ’র ডাকে পাকিস্তান বাস্তবায়নের দাবিতে তথাকথিত ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’-এর নামে ১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসে ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ এবং একই বছর অক্টোবর মাসে ‘নোয়াখালীর রায়ট’ সবচেয়ে ভয়াবহ ও বিভৎস রূপ ধারণ করে। এসব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হাজার-হাজার মানুষ নিহত এবং লক্ষ-লক্ষ মানুষ সর্বশান্ত বনে যায়।
এভাবে দাঙ্গা-হামাঙ্গার মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ এবং ১৫ আগস্ট ভারতবর্ষ বিভাজিত স্বাধীনতা লাভ করে। ভারত ভাগ করে মূল ‘ভারত’ নামে একটি এবং নতুন ‘পাকিস্তান’ নামের আরেকটি অদ্ভুত রাষ্ট্র বানিয়ে স্বাধীনতা দেয়া হয়। শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে একটি ‘জাতি’র সংজ্ঞা নির্ধারণ করে এ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করা হয়- যা আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রদত্ত রাষ্ট্রের সংজ্ঞা পরিপন্থী। তাছাড়া, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে ভারতবর্ষ ভাগ করে মুসলমানপ্রধান অঞ্চলগুলো নিয়ে মুসলমানদের জন্য একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার সুস্পষ্ট উল্লেখ ছিল। মূল এই প্রস্তাবনার বরখেলাপ করে ১২০০ মাইলের ব্যবধানে দু’খণ্ডে বিভক্ত ‘পূর্ব পাকিস্তান’ও ‘পশ্চিম পাকিস্তান’ মিলিয়ে বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম এ ধরনের একটি রাষ্ট্রের জন্ম দেয়া হয়। এই অপরিপক্ক জন্মদানের প্রসব বেদনায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারতবর্ষে, বিশেষত বাংলা এবং পাঞ্জাব ভাগ হয়ে যাবার ফলে এ দু’টি অঞ্চলজুড়ে হিন্দু-মুসলমান-শিখ দাঙ্গায় প্রায় ৫ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। অন্যদিকে হিন্দু, মুসলমান এবং শিখ সব মিলিয়ে প্রায় সোয়া কোটি মানুষের দেশান্তর ঘটে- যা বিশ্বের সমসাময়িক ইতিহাসে বিরল নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি ও নৃশংসতার দৃষ্টান্ত হিসেবে চিহ্ণিত হয়ে রয়েছে।
মূলত ‘মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা’ অনুযায়ী স্যার সাইরিল র্যাডক্লিফ কর্তৃক সীমানা নির্ধারনের উপর ভিত্তি করে ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ‘ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা বিল’ পাশ হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পাকিস্তান সৃষ্টির ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে ঐ বছরই ১১ আগস্ট জিন্নাহ্ নতুন এই রাষ্ট্র্রের নীতিনির্ধারণী নাতিদীর্ঘ বক্তৃতায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পাকিস্তান সবার জন্য সৃষ্ট একটি রাষ্ট্র বলে উল্লেখ করেন।
এতে করে দেখা যাচ্ছে- ভারত ও পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে দুই প্রধান নেতা গান্ধী ও জিন্নাহ্ একদিকে ‘দ্বি-জাতি’তত্ত্বকে মেনে নিয়েছেন, অন্যদিকে তাঁরা সকল ধর্মের সম-অধিকার এবং অসাম্প্রদায়িকতায়ও বিশ্বাসী। এই অবিমৃষ্যকারিতার ফলে উপমহাদেশের লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটে, আর কোটি কোটি মানুষ চৌদ্দ পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে দেশান্তর ও উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হয়।
১৯৪৭ সালের স্বাধীনতাকে ঘিরে উপমহাদেশে ব্যাপক সংহিস যেসব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল তার প্রত্যেকটিতে উভয় পক্ষের ‘দ্বি-জাতি’তত্ত্বধারী কায়েমী স্বার্থান্বেষীদের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা ছিল। এ ক্ষেত্রে দুই পক্ষের দুই শীর্ষ নেতা গান্ধী ও জিন্নাহ’র কারো পক্ষে ঔসব দাঙ্গা নিরোধে তেমন কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বিলেতি আদবকায়দায় মানুষ হওয়া জিন্নাহ্ ভোল পাল্টে যাবার পেছনে রাষ্ট্রীয় শীর্ষ ক্ষমতায় আসীন হবার বিষয়টিই মুখ্য ছিল বলে ধারণা করা হয়। কারণ, অখণ্ড ভারত স্বাধীন হলে তাতে ক্ষমতারোহনে তাঁর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আরেক বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার জওহরলাল নেহেরু। তাই একদিকে হিন্দু এবং মুসলমান উভয় পক্ষের উগ্রপন্থীদের সাম্প্রদায়িক ও নৈরাজ্যকর কর্মকাণ্ড, অন্যদিকে নেহেরু ও জিন্নাহর ক্ষমতার শীর্ষস্থান দখলের প্রতিযোগিতা- এই দুই মিলে তথাকথিত ‘দ্বি-জাতি’তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভাজন ব্যতীত অন্য কোন গত্যন্তর ছিল না বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। এভাবে বিশৃংখলতা, অস্পষ্টতা এবং গোঁজামিলের মধ্য দিয়ে স্বাধীন খর্বকায় ভারত এবং নব্য রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্মের মধ্যেই উভয় দেশে সাম্প্রদায়িকতার ভিত মজবুত হয়। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বেড়াজালে সদ্য স্বাধীন এ দেশ দু’টির রাজনীতি আবর্তিত হতে থাকে।
অদ্ভুত ‘দ্বি-জাতি’তত্ত্বের কুফসলে সৃষ্ট আস্বাভাবিক রাষ্ট্র পাকিস্তানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা, যাদের মধ্যে প্রায় ৯৯ শতাংশই হিন্দু, সবাই রাতারাতি আপনাআপনি নিজ আবাসভূমে অবাঞ্ছিত বনে যায়। কারণ ধর্মভিত্তিক ঐ তত্ত্বের একমাত্র ব্যাখ্যা হচ্ছে- পাকিস্তান কেবলমাত্র মুসলমানদের জন্য সৃষ্ট একটি রাষ্ট্র। ফলে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে নিমিষেই অন্যান্য জাতি-ধর্মের বিশাল জনগোষ্টী নিজভূমে পরবাসী হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে লক্ষ-লক্ষ সংখ্যালঘু দেশান্তরিত হতে শরু করে। আর যারা চৌদ্দ পুরুষের ভিটেমাটির মায়া কাটিয়ে দেশান্তরিত হতে চায়নি, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তাদেরকে জোরপূর্রক বিতাড়ণের পর্ব শুরু হয়। এ প্রক্রিয়ায় তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের সরাসরি মদদে গোটা এ অঞ্চলের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর দুই দশকজুড়ে বিভিন্ন পর্যায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়। এসবের মধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যাপক আকার এবং ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। এতে আইন-শৃংখলা রাক্ষাকারী বাহিনী ও সেনাবাহিনীর সদস্যদেরকেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত থাকতে দেখা যায়।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর পরিচালিত হামলা করেই সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ক্ষান্ত হয়নি। তাদেরকে (মূলত হিন্দু) অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করার মহাপরিকল্পনা নিয়ে পাকিস্তান সরকার ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ চলাকালীন Enemy Property (Custody and Regulation) Order II of 1965 জারি করে। তাসখন্দ চুক্তিবলে ঐ বছর ২২ সেপ্টেম্বর যুদ্ধ বন্ধ হলেও পাকিস্তান সরকার ঐ আদেশকে পাকাপোক্ত করতে ১৯৬৬ সালে East Pakistan Enemy Property (Lands and Building) Administration and Disposal Order of 1966 জারি করে। পাকিস্তান আমলে ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন’ বলে পরিচিত কুখ্যাত এই আইনের যাঁতাকলে পড়ে হাবুডাবু খায় বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি হিন্দু পরিবার, অনেকে সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসে যায়, দেশান্তরিত হয়।
সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীসমূহের অপকর্মকাণ্ডের বিপরীতে ’৫২, ’৬২, ’৬৬, ’৬৭, ’৬৯ ও ’৭০-এর বিভিন্ন পর্যায়ে আন্দোলন-সংগ্রাম ও নির্বাচন এবং সর্বোপরি বাঙালি জাতির অবিসাম্বিদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রগতিশীল শক্তিসমূহের সকল আন্দোলন-সংগ্রাম ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং আদর্শপুষ্ট। এই ভূখণ্ডের অধিবাসীরা সবকিছু ছাপিয়ে ‘বাঙালি’ -এই অমোঘ সত্য প্রকাশের সুযোগ তারা নিখুঁতভাবে একবারই পেয়েছে, ১৯৭১ সালে।
‘বাংঙালি’ জাতিসত্তা এবং জাতীয়তাবোধই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এ ভূখণ্ডের মানবগোষ্ঠীকে মুক্তির নেশায় অকুতোভয় করে তুলে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিসমূহের মধ্যে ধর্মভিত্তিক একক সম্প্রদায় হিসেবে হিন্দুরাই পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসরদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। ’৭১-এর নয় মাসে বাংলাদেশের প্রতিটি হিন্দু পরিবার কোনও না কোনভাবে পাকিস্তানী এবং তাদের সহায়তাদানকারীদের হামলার শিকার হয়। মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতিদানকারী ৩০ লক্ষ শহীদের মধ্যে সংখ্যানুপাতিক হার এবং সহায়-সম্পত্তি, সকল প্রকার স্থাপনা, নারীর সম্ভ্রম ইত্যাতি সব মিলিয়ে এ দেশের হিন্দুজনগোষ্ঠীকেই একক সম্প্রদায় হিসেবে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়। আর মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ থেকে ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী এক কোটি শরনার্থীর মধ্যে ৯৫ শতাংশই ছিল হিন্দুজনগোষ্ঠী। তবে অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ফলে শরণার্থী প্রতিটি হিন্দু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে। কারণ, মুক্তিযুদ্ধে বিশাল ত্যাগ এবং অপূরণীয় ক্ষতি সাধন সত্ত্বেও তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, বাংলাদেশের জন্মগত বৈশিষ্ট্যের কারণে এ ভূখণ্ডে আর কোনদিনও তাদের ওপর সাম্প্রদায়িক কালো থাবা পড়বে না।
কিন্তু বছর না ঘুরতেই ১৯৭২ সালের দুর্গাপূজার সময় সাম্প্রদাযিক অপশক্তি ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একযোগে পূজামণ্ডপ এবং মন্দিরে হামলা ও ভাংচুর করে। তারপরও অন্তত তিন বছর পর্যন্ত এ দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা হতাশ হননি। কারণ অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল আদর্শের স্রষ্টা, ধারক ও বাহক বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সহকর্মীরা স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান পাস ও কার্যকর করেন। রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি হিসেবে ‘জাতীয়তাবাদ’, ‘সমাজতন্ত্র’, ‘গণতন্ত্র’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ অন্তর্ভূক্তকরণের মধ্য দিয়ে জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে প্রজাতন্ত্রের সকল নাগরিকের সম-অধিকার উক্ত সংবিধানে নিশ্চিত করা হয়। এতে করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী এদেশে তাদের নিরাপত্তার ভরসা এবং আস্থার স্থলটি খুঁজে পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তাদের সেই আস্থাস্থলের যবনিকাপাত ঘটে।
মূলত জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানী ভাবধারায় বাংলাদেশকে পরিচালনা করা শুরু হয়। সামরিকচক্রের সহায়তায় রাষ্ট্রপতির নামে একাধিক অধ্যাদেশ জারি, সামরিক ফরমান এবং ১৯৭৯ সালে পঞ্চম ও ১৯৮৮ সালে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশে পাকিস্তানের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পুনর্বহাল করা হয়। অসাম্প্রদায়িক এবং ধর্মনিরপেক্ষ এই দেশটিকে সাংবিধানিকভাবে একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়। ফলে নতুন করে প্রজাতন্ত্রের ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে।
১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনের পর ভোলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলার ফলে তখন থেকে নব পর্যায়ে হিন্দুদের দেশত্যাগ শুরু হয়। বিগত নব্বই দশকের প্রথম দিকে ভারতের বাবরি মসজিদে হামলা এবং তা ধ্বংসের জের ধরে বাংলাদেশের হিন্দুদের উপর সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী কর্তৃক হামলা, অত্যাচার ও নির্যাতন পরিচালিত হয়। ফলে পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা দেশত্যাগ করে। এরপর ১৯৯৬ সালের জুন মাস থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত র্সংখ্যালঘুদের তেমন দেশত্যাগ ঘটেনি। তবে ২০০১ সালের ১ অক্টোাবর নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা সংখ্যালঘুদের উপর সর্বৈব অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়ন পরিচালনা করে। এসব নারকীয় ঘটনাবলী বন্ধে কোনো প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ না করার ফলে আস্কারা পেয়ে তৎকালীন চার দলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর টানা পাঁচ বছর অত্যাচার, নির্যাতন ও হালমা অব্যাহত রাখে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা ঘোষিত হলে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের মাত্রা কিছুটা হ্রাস পায়।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করলে তাদের উপর নির্যাতন সাময়িকভাবে বন্ধ হলেও তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। দল-বেদলের ধর্মীয় মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তি অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নানা অযুহাত ও কৌশলে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলের নেৃতত্বে সরকার পরিচালিত হলেও সংখ্যালঘুরা হামলা থেকে রেহাই পায়নি। দেশের সকল প্রান্তে রয়ে-রয়ে সকল ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীই কমবেশি হামলার শিকার হয়েছে। ২০১১ ও ২০১২ সালের বিভিন্ন সময়ে চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হিন্দুদের উপর নানা প্রকার হামলা পরিচালিত হয়। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা, ভাংচুড় ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। খৃষ্ট ধর্মাবলম্বীরাও হামলা থেকে রেহাই পায়নি।
২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি অন্যতম যুদ্ধাপরাধী দুর্ধর্ষ ও কুখ্যাত দেইল্যা রাজাকারের ফাঁসির রায় ঘোষিত হওয়ার পর সংখ্যালঘুদের উপর দেশব্যাপী একযোগে সবচেয়ে বড় হামলা পরিচালিত হয়। এ সময় প্রায় প্রতিদিন দেশের কোনো না কোনো স্থানে তাদের উপর হামলা চলে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোট বিভিন্ন কর্মসূচি পালনকালে তাদের উগ্র এবং সন্ত্রাসী কর্মীবাহিনী সংখ্যালঘুদের উপর হামলে পড়ে। পাবনার সাঁথিয়াসহ দেশের কোথাও-কোথাও আবার সরকার সমর্থক সন্ত্রাসীরাও এ ধরণের হামলা পরিচালনা করে। ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের আন্দোলনের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে-সাথে তাদের জঙ্গি কর্মীবাহিনী কর্তৃক সংখ্যালঘুদের উপর হামলার মাত্রাও বৃদ্ধি পায়। ১২ ডিসেম্বর অন্যতম যুদ্ধাপরাধী মিরপুরের কসাই নামে কুখ্যাত কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হলে জঙ্গিদের হামলার মাত্রা তীব্রতর হয়। দেশের বিভিন্নস্থানে যৌথবাহিনী অভিযান চালিয়ে এবং নির্বাচনকালীন স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে সেনাবাহিনী মাঠে থাকা সত্ত্বেও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের সময় এবং আগে ও পরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলা বন্ধ করা যায়নি। সকল পক্ষেরই সাধারণ লক্ষ্যবস্তু ছিল সংখ্যালঘুরা। নির্বাচনের আগে থেকেই যে আশঙ্কা করা হয়েছিল- দিনাজপুর ও যশোরসহ সারা দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর ব্যাপক হামলার মাধ্যমে সেই আশঙ্কাই সত্য বলে প্রতীয়মান হয়।
এরপর ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসির নগরে ব্যাপকভাবে হিন্দুদের মন্দির ও ঘরবাড়িতে ব্যাপক হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। তাছাড়া প্রায়শই সোস্যাল মিডিয়াতে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা ও বানোয়াট প্রচারণার শিকার হচ্ছে সংখ্যাঘলু সম্প্রদায়ের অনেকেই। অন্যদিকে, পত্রপত্রিকার এবং ইন্টারনেটে বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংখ্যাঘলুদের জমিজমা দখল এবং ঘরবাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগসহ নানা ধরণের অত্যাচার ও নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হতে দেখা যায়। যদিও বর্তমান সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র সার্বিক তত্ত্বাবধানে অতীতের চেয়ে বর্তমানে দেশে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির অনুকূল পরিবেশ বিরাজ করছে।
অতীত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বৃটিশ আমল থেকে এ ভূখণ্ডের কোথাও না কোথাও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নানাভাবে নির্যাতিত হয়ে আসছে, তাদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, নারীদেরকে ধর্ষণ ও জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত ও বিয়ে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা বৈষম্যেরও শিকার হচ্ছে। ফলে তাদের অনেকেই দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছে বিধায় বর্তমানে যে-ভূখণ্ড নিয়ে বাংলাদেশ গঠিত সে-অঞ্চলের মোট জনসংখ্যায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের হার ১৯০১ সালে ৩৩.৯ শতাংশ এবং ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় কমবেশি ২৯.৬ শতাংশ থেকে নেমে ২০১৯ সালে ১১.৬ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কর্তৃক প্রকাশিত দলিলাদিসূত্রে জনসংখ্যার হিসাব নিচের সরণিতে দেয়া হলো।
সরণিতে পরিসংখ্যান ব্যুরো কর্তৃক প্রকাশিত ১৯০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত আমদশুমারী এবং ২০১৫ ও ২০১৯ সালের স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইয়ারবুকের উপাত্ত নেয়া হয়েছে।
১৯৪৭ সালে কোনো আদমশুমারী না হওয়ার কারণে তার পূর্বে কাছাকাছি সময়ে পরিচালিত ১৯৪১ সালের আদমশুমারীর জনসংখ্যাকে ভারত বিভক্তির সময়ে প্রমিত জনসংখ্যা বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। এতে দেখা যাচ্ছে সংখ্যার বিচারে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা ১৯৪৭ সালের তুলনায় বর্তমানে প্রায় ৬৮ লক্ষ বেশি হলেও শতকরা হারে প্রায় এক-তৃতীয়াংশে মেনে এসেছে। তাই বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, সংখ্যালঘুদের মোট জনসংখ্যা কত বৃদ্ধি পেয়েছে তার চেয়ে মুখ্য বিষয় হচ্ছে তাদের শতকরা হার অতিমাত্রায় কমে গেছে।
এখানে আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে, সময়ের পরিক্রমায় পরিবর্তিত ভূ-অঞ্চলগত রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে আদমশুমারী, জনমিতি, সংখ্যাতত্ত্ব ও পরিসংখ্যান সম্পর্কে কারো সম্যক ধারণা না থাকলে কোনো জনগোষ্ঠীর মোট জনসংখ্যা ও শতকরা হার নিয়ে বিভ্রাট সৃ্ষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে এমন যদি বলা হয়- “জনসংখ্যার হার ১৯৪৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকলে বাংলাদেশে বর্তমানে যত সংখ্যক সংখ্যালঘু রয়েছে তার চেয়ে তাদের সংখ্যা দ্বিগুণ বা তিনগুণ বেশি বা নির্দিষ্টভাবে কোনো সংখ্যা হতো”, তা’হলে বিষয়টি ‘অনুমান’ নির্ভর (Hypothetical) হবে। তাই কোথাও অনুমাননির্ভর হয়ে নির্দিষ্ট করে সংখ্যালঘু হ্রাসের কোনো সংখ্যা উল্লেখ করা মানে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা।
‘বাস্তব’ অবস্থা হচ্ছে- ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসের পর হতে এ ভূ-অঞ্চলে সংখ্যালঘু জনসংখ্যার হার হ্রাস পেতে থাকলে সংখ্যাগতভাবে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধির পরিবর্তনও (Variation) নিম্নগামী হতে থাকে। তাই এ বিষয়টি মস্তিষ্কে ধারণ করতে হবে যে, ‘অনুমান’ ও ‘বাস্তব’ এক ব্যাপার নয় এবং জনসংখ্যা ও জনসংখ্যার শতকরা হার ভিন্ন জিনিস, বিশেষ করে যেখানে স্বাভাবিক নিয়মে সংখ্যালঘু জনসংখ্যার হার হ্রাস পায়নি বা তাদের বৃদ্ধির পরিবর্তন হয়নি, মূলত তা ঘটেছে রাজনৈতিকি সিদ্ধান্তের কারণে।
বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের শতকরা হার হ্রাস পাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে তাদের দেশত্যাগ করা, যা একদিনে ঘটেনি, বিগত ৭২ বছর ধরে ঘটে চলেছে। এতদ্সত্ত্বেও সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যচ্ছে এ দেশে বর্তমানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংখ্যা ১ কোটি ৯২ লক্ষেরও অধিক, যা খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। কারণ, জাতিসংঘের পপ্যুলেশন ড্যাটাবেজে দেখা যাচ্ছে বর্তমানে বিশ্বের ১৯৫টি দেশের মধ্যে ১৩৩টি দেশের প্রত্যেকটির জনসংখ্যার চেয়ে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অধিক।
উপমহাদেশের রাজনৈতিক উথাল-পাথালে ঐতিহাসিকভাবে এবং উত্তরাধিকারসূত্রে বাংলাদেশের বিশাল ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে অনেক সমস্যা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে, এটি অস্বীকার করা যাবে না। তাই বাস্তবতার নিরিখে সংখ্যালঘুদের সমস্যাগুলো যথাযথ গুরুত্বসহকারে সমাধানে সরকার, রাজনৈতিক দলসমূহ এবং সুশীল সমাজসহ সকল শ্রেণী-পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও প্রযুক্তিবিদ, Email: [email protected]
[এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। বাংলাদেশ দর্পণ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।]