রংপুর: মিলন রবিদাস পেশায় একজন মুচি। বাবার মৃত্যুর পর জুতা সেলাইয়ের কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। থাকেন জ্যাঠার জমিতে ঘর তুলে। অনেক কষ্টে দুই শতাংশ জমি কিনেছেন মিলন। সেখানে একটা ঘর বানাবেন বলে তিল তিল করে ২০ হাজার টাকাও জমিয়েছিলেন। 

কিন্তু নিজের ঘর বানানোর চেয়ে এই টাকা দিয়ে অনাহারি মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করলেন এই দরিদ্র মুচি। তাই দেশমাতৃকার সেবা করার এই সুযোগ হাতছাড়া করলেন না তিনি। সঞ্চিত সেই ২০ হাজার টাকা জমা দিলেন প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে। 

সারাদেশে এখন সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগে দরিদ্র ও কর্মহীন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। কেউ কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগেও দিচ্ছেন ত্রাণসামগ্রী। আবার কেউ কেউ করছেন ত্রাণ চুরি। খাটের নিচে, খড়ের গাদায়, গোপন স্থান থেকে ত্রাণসামগ্রীর ভাণ্ডার ধরা পড়েছে অনেক জনপ্রতিনিধির বাড়িতে। ত্রাণ চুরিসহ বিভিন্ন অভিযোগে ইতোমধ্যে ৩৫ জন জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করা হয়েছে। 

জাতীয় এই দুর্যোগে যখন জনপ্রতিনিধিরা ত্রাণ চুরিতে ব্যস্ত তখন অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার লতিবপুর ইউনিয়নের আবদুল্লাহপুর গ্রামের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী রবিদাস সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি। তার নাম মিলন রবিদাস (৩৭)। 

মিলন মূলত একজন মুচি। জুতা সেলাই করে সংসার চলে তার। কিন্তু তিনি যে মহৎ দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী, তা অনেক উচুস্তরের মানুষের থেকেও মহান।

সোমবার (২৭ এপ্রিল) দুপুর আড়াইটার দিকে মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মামুন ভূঁইয়ার হাতে ২০ হাজার টাকা তুলে দিয়েছেন মিলন রবিদাস।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অভাবের কারণে পঞ্চম শ্রেণিতেই পড়ালেখার পাঠ চুকে যায় মিলনের। প্রায় ২০ বছর আগে মারা যান বাবা মতিলাল রবিদাস। এরপর বাবার পেশায় হাল ধরে সংসারের ঘানি টানতে শুরু করেন রবিদাস। মিঠাপুকুর উপজেলা পরিষদের পাশে জুতা সেলাইয়ের ছোট দোকান দিয়ে বসেন তিনি। সেখান থেকে যা আয় হয় তা দিয়েই মা, স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে কোনোপ্রকারে চলে যায় জীবন। মেয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে এবং ছেলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ছে। নিজস্ব জমিও ছিল না তার। জ্যাঠার জমিতে বসবাস করছেন।

অভাব-অনটনের মাঝেও অনেক কষ্টে দুই শতাংশ জমি কিনেছেন মিলন। কিন্তু এখনও বাড়িঘর বানানো হয়নি তার। নিজের জমিতে মা ও স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে একটি ঘরে থাকার স্বপ্নে তিল তিল করে জমিয়েছিলেন ২০ হাজার টাকা। কিন্তু ঘর আর তার বানানো হলো না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিলন রবিদাস বলেন, দেশে অনেক সময় অনেক দুর্যোগ দেখেছি। আগে থেকেই ইচ্ছা ছিল দেশের দুঃসময়ে দেশের মানুষের সেবার জন্য কিছু করার। করোনার মহামারি আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। জুতা সেলাই করে কিছু টাকা জমিয়েছি ঘর করার জন্য। কিন্তু করোনার দুর্যোগে না খেয়ে থাকা মানুষের কষ্ট দেখে ঘর করার ইচ্ছা মরে গেল। দীর্ঘদিনের জমানো ২০ হাজার টাকা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা দিয়ে দিলাম। আশা করি, এতে একটু হলেও দরিদ্র মানুষের উপকার হবে।

মিলন রবিদাসের এই দানের খবর সামাজিক মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, চারদিকে যখন ত্রাণচুরির অভিযোগ, ব্যবসায়ে মানুষকে ঠকানোর অভিযোগের শেষ নেই, তখন এরকম মানবিক হৃদয়বত্তার খবর মানুষকে একটু হলেও স্বস্তি দিচ্ছে, উৎসাহ দিচ্ছে একটি মানবিক সমাজ গড়ার।

আরকে/