শ্রীমঙ্গলে তখন মধ্যরাত। একজন গর্ভবতী নারীর প্রসব বেদনা ও রক্তক্ষরণ হচ্ছে, হাসপাতালে নিতেই হবে। লকডাউনে কোথাও কোন গাড়ি নেই।

উপজেলা চেয়ারম্যানের ছেলে ফোন নম্বর দিলেন স্থানীয় র‍্যাব কমান্ডারের। সনাতন ধর্মাবলম্বী প্রান্তিক পরিবার, সংকোচের মধ্যেও সাহস করে ফোন দিলেন। 

কয়েক মিনিটের মধ্যেই র‍্যাব কমান্ডার ও ৩৪তম বিসিএস এর পুলিশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন শামীম স্বয়ং হাজির গাড়ি নিয়ে। 

রোগীর গাড়িতে ওঠার অবস্থাও ছিল না। কমান্ডার শামীম নিজেই রোগীকে কোলে করে গাড়িতে তুললেন। হাসপাতালে পৌঁছে নিজেই আবার রোগীকে কোলে করে অপারেশন থিয়েটারে দিয়ে আসেন।

সর্বশেষ সংবাদ, মা ও নবজাত পুত্রসন্তান দুজনেই সুস্থ আছেন। 

অসহায় ওই প্রান্তিক পরিবারের পাশে দাঁড়ানোয় আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে পরিবারটি। তাদের একজন বলেন, শ্রীমঙ্গল র‍্যাবের শামীমকে যেন ভগবান ভালো রাখেন, সুস্থ রাখেন। তার এই মানবিক সহায়তার জন্য রাষ্ট্রের অনেক বড় পুরস্কার ঘোষণা করা হোক।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এই ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লে বারবার প্রশংসিত হন র‌্যাব সদস্য শামীম। সুষুপ্ত পাঠক নামের একজন ফেসবুকে লিখেছেন,

আনোয়ার হোসেন শামীমের মত মানুষরা আছেন বলে পৃথিবীর উপর এখনো শেষ আশাটুকু নিঃশেষ হয়ে যায়নি।

বলছিলাম র‌্যাব-৯ শ্রীমঙ্গল ক্যাম্পের কমান্ডার এএসপি আনোয়ার হোসেনের কথা।

তিনি মানুষ হিসেবে কেমন তা টের পাওয়া যায় যখন তিনি শিল্পী রানী পালের সদ্য জন্ম নেয়া ছেলের নামকরণ করেন। মানুষ যখন শিশুদের নামকরণ করে তখন সেখানে তার বিশ্বাস চিন্তা আকাঙ্ক্ষা স্বপ্ন রাজনীতি জাতীয়তা ধর্ম দিয়ে প্রভাবিত হয়। নামকরণে আমাদের মনের ছায়া এসে পড়ে আমাদের নিজের জ্ঞাতসারে বা অজান্তে। চেতনে অবচেতনে...।

আমাদের আনোয়ার হোসেন শিল্পী রানীর ছেলের নাম রেখেছেন "শচীন"। শচীন নাম কেন? আনোয়ার বলেন, “উপমহাদেশের বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ শচীন দেব বর্মনের একজন বড় ভক্ত আমি। তাছাড়া ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকারের খেলা দেখতেও অনেক পছন্দ করতাম সেই ছোটবেলা থেকে। এই দু’জন মহাগুণী মানুষের নামের সঙ্গে মিলিয়েই শিশুটির নাম রেখেছি আমি।”

না, আনোয়ারের কাছে জাতি ধর্ম নয়, মানুষ আর ভালো লাগাটা সবার আগে। শিল্পী রানীর মত প্রসূতিদের ডিউটি করতে সরকার তাকে বেতন দেয় না। তিনি না আসলেও কেউ তাকে দোষ দিত না। অসুস্থ রোগী নিয়ে কেউ র‌্যাব সদস্যকে ডাকে না। এটা পুলিশের ডিউটি না। কিন্তু আনোয়ার হোসেন নাকি এরকম মানবসেবা সব সময় করে থাকেন। অতিতে অনেক বার তিনি রাতদুপুরে একটা ফোন পেয়েই এসে হাজির হয়েছেন সঙ্কটাপন্ন নারীর দোরে ...।

গর্ভকালীন সঙ্কটাপন্ন শিল্পী রানী পালকেও এই করোনা পরিস্থিতিতে যখন কোথাও গাড়িঘোড়া নেই তখন এই আনোয়ার হোসেন খবর পাওয়া মাত্র তার সরকারি গাড়ি নিয়ে হাজির হন। অসুস্থ শিল্পী রানীর হাঁটার শক্তি ছিলো না। আনোয়ার হোসেন তাকে কোলে করে হাসপাতালের তিনতলায় প্রসূতি ওয়ার্ডে নিয়ে যান।

সেদিন রাত বারোটার দিকে শিল্পী রানী পুত্র সন্তান প্রসব করেন। এর ঠিক এক সাপ্তাহ পর শিশুটির নামকরণ অনুষ্ঠানে আনোয়ার হোসেনকে শিশুটির নামকরণের অনুরোধ করেন শিশুটির বাবা মা। আনোয়ার এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে নাম রাখেন শচীন।

এই শচীন বড় হয়ে যখন জানবে তাকে জন্ম দিতে গিয়ে যখন তার মা সঙ্কটাপন্ন তখন একজন আনোয়ার হোসেন বুক চেতিয়ে এগিয়ে এসেছিল, তখন তার মধ্যে এতটুকু সাম্প্রদায়িকতা কি স্থান নিতে পারবে? শচীন দেব বর্মণ বাংলাদেশের যে ঢোল বাজিয়ে গেছেন আজীবন তাতে আনোয়ার হোসেনদের মানবিক বাংলাদেশের সুরই তুলেছে। এই শিশুটিও সেই সুর শিখুক। মানুষের গান গেয়ে উঠুক।