সৌর্যে, বীরত্বে পরিপূর্ণ ছিলেন রাজপুত রাজা মহারানা প্রতাপ। ইতিহাসের সেই বীরনায়ক মহারানা প্রতাপের জন্মজয়ন্তী আজ। যাকে দেখে ভয়ে সামাজ্রবাদী মুঘলরাও কাঁপতো। এই সাহসিকতার কারণে ভারতের ইতিহাসে হিন্দু রাজা মহারানা প্রতাপের নাম অমর হয়ে আছে।   

মহারানা প্রতাপ ৯ মে ১৫৪০ সালের মেওয়ারের  কুম্ভলগড় দুর্গে (বর্তমানে এই প্রদেশ ভারতের রাজস্থান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত) শিশোদিয়া রাজপুত রাজবংশে জন্মগ্ৰহণ করেন। মহারানা প্রতাপ প্রায় ৭ ফুট ৫ ইঞ্চি লম্বা ছিলেন এবং তিনি প্রায় ১১০ কেজির কবচ পরতেন, কিছু জায়গায় কবচের ওজন ২০৮ ​​কেজিও লেখা আছে। তিনি ২৫-২৫ কেজির ২টি তলোয়ারের ভিত্তিতে যে কোনও শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেন। তাঁর কবচ ও তরোয়ালগুলি রাজস্থানের উদয়পুরের একটি যাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।

মহারানা প্রতাপ এমনই এক হিন্দু রাজা ছিলেন যিনি মুঘল সম্রাট আকবরের অধীনতা গ্রহণ করেননি। আকবরের সেনাবাহিনী তার মোকাবিলা করতে না পারায় কয়েকবার পালিয়ে যায়। হলদিঘাটির যুদ্ধ এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। বিখ্যাত এই যুদ্ধে মহারানা প্রতাপ পনেরো হাজার সৈন্য নিয়ে প্রায় পচাঁশি হাজার মুঘল সেনার বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করেছিলেন।

হলদিঘাঁটির যুদ্ধের পর ১৫৮২ সালের অক্টোবর মাসে আরও একটি যুদ্ধ হয় যার নাম দিবের যুদ্ধ। এ সম্পর্কে তথাকথিত ইতিহাস বইগুলোতে খুব কমই লেখা রয়েছে। এই যুদ্ধে মহারানা প্রতাপ ও মুঘল সেনার মধ্যে হয়েছিলো। এ লড়াইয়ে মুঘল সেনার বিরুদ্ধে একদিক থেকে মহারানা প্রতাপ নিজে নেতৃত্ব দেন এবং অন্যদিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন পুত্র অমর সিং। 

বিজয়া দশমীর দিন মা ভবানীকে স্মরণ করে শুরু হয় মুঘল বিনাশের পর্ব। ভীষণ যুদ্ধে মুঘলদের পরাস্ত করেছিলেন। মহারানা প্রতাপের ছেলে অমর সিং ছিলেন একজন দুঃসাহসী যোদ্ধা। তিনি মুঘল সেনাপতির উপর এত প্রবল শক্তির সাথে তীর ছোড়েন যে ঘোড়া সহ সেনাপতির বুক চিঁড়ে তা মাটিতে গেঁথে যায়। অন্যদিকে মুঘলদের নেতৃত্বকারী বেহলল খানকে ঘোড়া সমেত দু-টুকরো করে দেন মহারানা প্রতাপ। যুদ্ধে মুঘল সেনা পরাস্ত হয় এবং বেঁচে থাকা সেনা মহারানা প্রতাপের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এভাবেই মহারানা প্রতাপ বিদেশাগত মুঘলদের সঙ্গে অনেক কঠিন যুদ্ধ করেছেন কিন্তু পরাজিত হননি। ভারতের তথাকথিত বিকৃত ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে সাম্রাজ্যবাদী অত্যাচারী মুঘল রাজাদেরকে ইতিহাসের সেরা নায়ক হিসেবে দেখানো হয়। যেন মুঘলরা ভারতবাসীদের ত্রাতা ও উদ্ধারকর্তা। কিন্তু ইতিহাসে উপেক্ষিত থেকে গেছে স্বদেশী রাজা-মহারাজাগণ। 

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বীরযোদ্ধা মহারানা প্রতাপ সিংহ সম্পর্কে কবিতায় বলেছেন-

“তোমার আসন শূন্য আজি, 
 হে বীর পূর্ণ কর ঐ যে দেখি বসুন্ধরা কাঁপল থরথর। 
বাজল তূর্য আকাশ পথে,
সূর্য আসেন অগ্নিরথে, আকাশপথে,
এই প্রভাতে দখিন হাতে বিজয়খড়্গ ধর।
ধর্ম তোমার সহায়, তোমার সহায় বিশ্ববাণী।
অমর বীর্য সহায় তোমার, সহায় বর্জ্রপাণি।
দুর্গম পথ সগৌরবে, তোমার চরণচিহ্ন লবে, সগৌরবে। চিত্তে অভয় বর্ম, তোমার বক্ষে তাহাই পর।”

নিজ মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য আত্মবলিদানকারী, সাহস আর বীরত্বের প্রতীক স্বাভিমানী দেশভক্ত মেওয়ারের মহানায়ক মহারানা প্রতাপ সিংহের জন্মজয়ন্তী তে জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি ও  শতকোটি প্রনাম। 

১৫৯৭ সালে এক শিকার অভিযানের সময় দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে আহত হন মহারানা প্রতাপ। এই দুর্ঘটনাই তার মৃত্যুর কারণ হয়। ২৯ জানুয়ারী, ১৫৯৭ মেবারের এই সিংহ, বীর যোদ্ধা, ভারতবর্ষের অন্যতম স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা পরপারে পাড়ি জমান।  তিনি আমৃত্যু শত্রুর বশ্যতা স্বীকার করেননি, স্বাধীনতার জন্যেই তিনি বেঁচেছেন, লড়েছেন, স্বাধীনতার স্বপ্ন দু’চোখে নিয়েই তিনি নিজের জীবনকাল পূর্ণ করে পৃথিবী ছেড়েছেন। একজন মহারানা প্রতাপ মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতা আদায়ে বিরামহীন প্রয়াসের মূর্ত প্রতীক। মুক্তিকামী মানুষের চিরন্তন প্রেরণার উৎস হয়েই থাকবেন তিনি।

জয়ন্ত কর্মকার, ৯ মে, ২০২০