করোনাভাইরাসের সঙ্গে কী করে বাস করতে হয় তা শিখতে হবে আমাদের। এ ছাড়া আর উপায় নেই। এ কথা বিজ্ঞানীরা সাফ সাফ বলে দিয়েছেন। ১৮ মাস পরে অথবা সামনের সেপ্টেম্বরে যে টিকা আসার কথা ছিল, আমরা যে ঘরের ভিতর বসে দিন রাত সেই টিকা আসবে, দুনিয়া থেকে আপদ দূর হবে, আমরা আবার আগের জীবন ফিরে পাবো, সেই স্বপ্ন দেখছি, তার কী হবে? তার কিছুই হবে না, টিকা এলে আসবে, কিন্তু না এলে জীবন তো স্থবির পড়ে থাকবে না, আরও অনেক ভাইরাসের মধ্যে যেমন বাস করি, তেমন এই করোনার সঙ্গেও বাস করতে হবে। এর চেয়ে ভয়াবহ দুঃসংবাদ আর কী হতে পারে এই সময়?

টিকা কবে নাগাদ আসবে তার ঠিক নেই, আদৌ আসবে কিনা, এ নিয়ে কিছু বিজ্ঞানী এবং গবেষক সন্দেহ প্রকাশ করছেন। তাঁরা বলেছেন, টিকা আবিষ্কার কোনও সোজা কথা নয়। সোজা হলে সার্স আর মার্স থেকে বাঁচার জন্য টিকা আবিষ্কার করা যেত। সার্স মার্স ইত্যাদিও করোনাভাইরাস। এরা অনেক আগেই এসেছে। কিন্তু একটির জন্য আজও টিকা বানানো সম্ভব হয়নি। নতুন করোনাভাইরাস নিয়ে সমস্যা এ-ই যে এ বড় বেশি ছোঁয়াচে। সে কারণে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে বেশি, মারাও পড়ছে বেশি। এটির টিকা বানাতে এত তো সমস্যা হওয়ার কথা নয়, এই ভাইরাস তো তেমন ঘন ঘন রূপ পাল্টাচ্ছে না, তাহলে?

 

টিকা তৈরি করার পদ্ধতি আসলেই খুব দীর্ঘ এবং জটিল। প্রথম পর্বে কয়েকজন মানুষকে টিকা দিয়ে দেখতে হবে। দ্বিতীয় পর্বে কয়েকশ মানুষকে টিকা দিয়ে দেখতে হবে। তৃতীয় পর্বে কয়েক হাজার মানুষকে টিকা দিয়ে দেখতে হবে। এই সব পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সফল হওয়া চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। নয় বলে আমরা যে টিকা পাবোই এ কথা জোর দিয়ে কোনও টিকা বিশেষজ্ঞ বলছেন না। সাধারণত দশ বছর সময় দরকার হয় টিকা বানাতে। এইচ আই ভি (হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস) ভাইরাসের টিকা আজও বানানো সম্ভব হয়নি। ৪০ বছর হয়ে গেল, এখনো চেষ্টা চলছে। ৭ কোটি ৫০ লাখ লোক আক্রান্ত হয়েছে এইচ আই ভি দ্বারা যে রোগ হয় সেই রোগে, অর্থাৎ এইডসে। মরেছে ৩ কোটি ২০ লাখ লোক। এখন এইচ আই ভি ভাইরাসের সঙ্গেই মানুষ জীবনযাপন করে। কী করে ভাইরাসের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে হয় তা মানুষ অনেক দিন ধরেই শিখেছে। আবোল তাবোল কারও সঙ্গে যৌন সম্পর্কে যাওয়া ঠিক নয়, গেলেও নিরাপদ যৌনতার কথা ভুলে গেলে চলবে না। এসব রীতিনীতি এখন মানুষের স্বভাব চরিত্রের অংশ। করোনাভাইরাস থেকে নিজেকে দূরে রাখতে মাস্ক পরা, গ্লাবস পরা, হাত ধোয়া, মানুষের সঙ্গে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, এগুলো মেনে চলাও একদিন খুব স্বাভাবিক হয়ে উঠবে, হয়তো হয়ে উঠবে স্বভাব চরিত্রের অংশ। বাঁচতে চাইলে এভাবেই আমাদের বাঁচতে হবে। এতে কোনও ভুল নেই। ভাবলে মনে হয় পরাবাস্তব একটি জগৎ এটি। হ্যাঁ এই পরাবাস্তবতাই এখন আমাদের বাস্তবতা।

এই কভিড-১৯ অসুখটি, বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন, প্রতি বছর শীতকালে উদয় হয়ে দুনিয়া তছনছ করবে। বছর বছর তো ডেংগিও আসে। বছর বছর ইনফ্লুয়েঞ্জা আসে। ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা নিতে হয় প্রতি বছর। ইনফ্লুয়েঞ্জাতেও তো এখনো প্রচুর মানুষ মারা যায়। একসময় মিজলস বা হাম হলে প্রচুর লোক মারা যেত। ডেংগি থেকে কী করে বাঁচতে হবে আমাদের জানা হয়ে গেছে। আমরা এসির জল, ফুলের টবের জল কোথাও জমতে দেবো না। জমলে ওই জলে ডেংগির মশা জন্ম নেয়। মশা যেন আমাদের না কামড়ায় সেটা লক্ষ্য রাখতে হবে। মশারি টাঙ্গাতে হবে, মশার ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। ডেংগির তো কোনও টিকা নেই। কিন্তু আমরা বর্ষাকালে সতর্ক হই কী করে মশার কামড় থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে পারবো। বাজারে কত কিছু পাওয়া যায় ডেংগির প্রকোপের সময়, সবই মশা দূর করার জন্য। আমার বাড়িতে আর গাড়িতে মশা মারার র‌্যাকেট তো এখনো আছে। যেভাবে ডেংগিকে দূর করি, সেভাবে করোনাভাইরাসকে দূর করতে হবে। এখন থেকে মশা মারার যন্ত্রের মতো হাতের কাছে রাখতে মাস্ক আর গ্লাবস।

করোনার টিকা ধরে নিতে হবে আসবে না, সে কারণে করোনা রোগের চিকিৎসার চেষ্টায় আরও বেশি করে মন দিতে হবে। যেহেতু ভাইরাসের কোনও নির্দিষ্ট ওষুধ হয় না, দেখতে হবে বাজারের কোনও ওষুধপত্র কাজ করে কিনা। ইতিমধ্যে ডাক্তাররা ম্যালেরিয়ার ওষুধ, ইবোলা রোগের ওষুধ, এইডসের ওষুধ, যক্ষ্মার টিকা করোনা রোগীদের দিচ্ছেন। এক গবেষক তো সেদিন বললেন, পোলিওর টিকা সবাইকে খাওয়াতে, এতেই করোনা থেকে বাঁচা যাবে। অন্য রোগের টিকা দিয়ে কাজ হয় কিনা ডাক্তাররা দেখছেন, টিকা আর ওষুধপত্রের মিশ্রণে কিছু তো কাজ হচ্ছে। সবচেয়ে ভালো হতো করোনার টিকা এলে। কিন্তু টিকা না এলে হাপিত্যেশ করে কি আমাদের মরে গেলে চলবে! আমাদের এভাবেই পরীক্ষা করে করে কিছু একটা ককটেল আবিষ্কার করতে হবে কাজ চালানোর জন্য। সুস্থ হয়ে ওঠা করোনা রোগীর রক্ত থেকে প্লাজমা নেওয়া হচ্ছে, এই প্লাজমার ভিতরে যে এন্টিবডি থাকে, তা দিয়ে অসুস্থকে সুস্থ করা যাচ্ছে আপাতত। এটিও তো করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আরেকটি হাতিয়ার। মৃত্যুকে সামান্য হলেও তো রোধ করা যাচ্ছে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই কম থাকলে লড়াইয়ে হেরে যেতে হবে। এইডসে, ম্যালেরিয়ায়, ডেংগিতে, ফ্লুতেও তো বছর বছর মানুষ মরছে। করোনাতেও মরবে। এখন যেমন এই মহামারীর বা অতিমারীর মাঝখানে বসে এই মৃত্যুগুলোকে আমরা গুনছি আর আতঙ্কগ্রস্ত হচ্ছি, এক সময় এই মৃত্যুও হয়তো স্বাভাবিক হয়ে উঠবে, আমরা আর দুশ্চিন্তায় ঘরে বন্দী থাকবো না। নতুন দুনিয়া তার মতো করে গুছিয়ে নেবে। মানুষও করোনার ভাইরাস থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে চলবে। যে কোনও অবস্থার মধ্যে বসবাস করা শুধু আরশোলাই জানে না, মানুষও জানে। তবে মানুষ চেষ্টা করলে এই করোনার ভয়াবহতার লাগাম টেনে ধরতে পারতো। কে করোনা দ্বারা আক্রান্ত, কে সুস্থ, কে অসুস্থ, কে ভাইরাস বহন করছে, কে ছড়াচ্ছে, কার শরীরে এন্টিবডি আছে, কার শরীরে নেই, এসব জানলে আলাদা করা যেত সুস্থ আর অসুস্থকে। তাহলে ভাইরাস আর এক শরীর থেকে আরেক শরীরে লাফিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেতো না। সুযোগ না পেলেই ভাইরাস তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে গিয়ে মুশকিলে পড়বে। মানুষ যত বেশি মানুষের কাছাকাছি যাবে, তত বেশি বেঁচে থাকার সুযোগ পাবে ভাইরাস।

করোনার প্রকোপ দূর করতে প্রচুর টেস্ট করতে হবে। দুনিয়ার সবাইকে টেস্ট করতে পারলে সবচেয়ে ভালো। চীনের উহানে নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। চীন সিদ্ধান্ত নিয়েছে উহানের সবাইকে, ১ কোটি ১০ লাখ লোককে আগামী ১০ দিনে পরীক্ষা করে দেখা হবে। ওদিকে আমেরিকাও বলেছে আগামী ৭ দিনে ১ কোটি লোককে পরীক্ষা করবে।

করোনা নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে ব্যবসা-বাণিজ্য চাকরি-বাকরি করার জন্য। অর্থনীতি ধসে পড়ছে। এভাবে চললে মানুষ না খেয়ে মরবে। অল্প অল্প করে তাই শহর বন্দর খুলে দেওয়া হচ্ছে। ভাগ্যবানরা বেঁচে থাকবে, দুর্ভাগারা মরবে।

দুর্ভাগাদের মধ্যে বেশির ভাগই গরিব শ্রমিক, যাদের পক্ষে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে কাজ কর্ম করার উপায় নেই। যাদের পক্ষে বিপ্লব করার উপায় নেই ধনী মালিকদের বিরুদ্ধে, যারা জীবনভর তাদের ঠকিয়ে যাচ্ছে। দুর্ভাগাদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাদের কম, যাদের ঘরে বসে থাকলে চলবে না, জীবিকার জন্য কাজে বেরোতে হয়, তারা শ্রমিক না হলেও তারা দুর্ভাগা। কোনওক্রমে ভাইরাস তাদের ফুসফুসে ঢুকে যেতে পারলেই তাদের গণকবরে পাঠিয়ে দেবে। এই বাস্তবতা আমরা প্রথম মেনে নিতে না পারলেও ধীরে ধীরে মেনে নিচ্ছি। এ ছাড়া আসলে আমাদের আর উপায়ও নেই।

রেস্তোরাঁ চালু করেছে কিছু দেশ। হাতেগোনা লোককে ঢুকতে দিচ্ছে। টেবিলগুলোর মধ্যে বিরাট দূরত্ব। করোনার অভিজ্ঞতা মানুষকে ক্যাফে রেস্তোরাঁ যাওয়া থেকে বিরত রাখবে। আজই তো আমাকে আমার একটি প্রিয় রেস্তোরাঁ থেকে ফোন করে জিজ্ঞেস করা হলো আমি কিছু খাবার চাই কিনা, তারা হোম ডেলিভারি দেবে। আমি অতি সতর্ক, ডেলিভারি দেওয়ার লোকদের শরীরে কিছুদিন আগে ভাইরাস পাওয়া গেছে। সুতরাং বিশ্বাস নেই। আমি বাইরের খাবার খাবো না বলে দিই। অনেক রকম ব্যবসাকেই আমার মনে হয় পাততাড়ি গুটোতে হবে। যেমন ক্যাফে রেস্তোরাঁর ব্যবসা। জানি না, সময়ই বলবে। আমার এক চেনা চিত্রপরিচালক শুনেছি চলচ্চিত্র বানানোর বদলে এখন ওয়েব সিরিজ বানানোর চেষ্টা করছেন। কাজ বদলানো মনে হয় শুরু হয়ে গেছে। নতুন সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কাজ বদলে যাবে।

লকডাউনের সময় আমার নতুন একটি বই বেরোলো হারপার কলিন্স থেকে। হারপার কলিন্স ছাপানো বইয়ের বদলে ইলেকট্রনিক বই বের করেছে। এটি বিক্রিও হচ্ছে ভালো। মানুষ এখন বইয়ের দোকানে গিয়ে বই কেনা বা অনলাইনে বই অর্ডার করে ডেলিভারি দেওয়া লোকের হাত থেকে বইয়ের প্যাকেট নিয়ে সাতবার সাবান দিয়ে হাত আর প্যাকেট ধোয়ার বদলে ই-বুক কিনছে অনলাইনে, কম্পিউটারেই পড়ে নিচ্ছে বই। এভাবেই তো জীবনযাপন পালটে যাচ্ছে।

আমি শুধু ভাবছি আমার এত যে শাড়ি, শাড়িগুলো পরার কখনো কি সুযোগ পাবো? সুন্দর একটি শাড়ির সঙ্গে মাস্ক কি মানাবে? হয়তো এখন ভাবছি মানাবে না। এক সময় হয়তো দেখবো, ঠিকই মানাচ্ছে। যে কোনও অবস্থাকে গ্রহণ করতে পারে মানুষ। পারে বলেই এত ভাইরাস এত ব্যাকটেরিয়ার মধ্যেও, এত ভূমিকম্প, এত টর্নেডো, এত বন্যা, সুনামির মধ্যেও মানুষ বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। করোনাও মানুষকে বিলুপ্ত করতে পারবে না।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।