কিশোরগঞ্জ : কিশোরগঞ্জ মধ্যযুগের বাংলা সংস্কৃতির রাজধানী। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওর আর সমতলের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা প্রাচীন জনপদ কিশোরগঞ্জের এখানে-সেখানে ছড়িয়ে আছে শিল্প-সংস্কৃতির নানা নিদর্শন।

মধ্যযুগের প্রখ্যাত ভাসান কবি দ্বিজ বংশী দাসের মেয়ে চন্দ্রাবতী তেমনি এক কিংবদন্তির নাম। তিনি ছিলেন মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক মহিলা কবি। মধ্যযুগে বাংলার প্রথম সার্থক মহিলা কবি চন্দ্রাবতী ছিলেন বাবার মতো ভাসান কবি, গীতিকার আর রামায়ণের রচয়িতা। মৈমনসিংহ গীতিকার পরতে পরতে মিশে আছে কবি চন্দ্রাবতীর অমর কাব্য, প্রেম আর বিরহের উপাখ্যান।

কিশোরগঞ্জ শহর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে পাতুয়াইর গ্রাম। এক সময় নির্জন আর বন-জঙ্গলে ঘেরা অনেকটা দুর্গম পাতুয়াইর গ্রাম ছিল ফুলেশ্বরী নদীর তীরে। এখন আর নদীর কোন চিহ্ন নেই। তবে পাথুয়াইর গ্রামেই মধ্যযুগের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর শিবমন্দির ও তার পূর্বপুরুষের বাড়ির স্মৃতি বয়ে চলছে আজো। কালের নীরব সাক্ষী হয়ে আজো দাঁড়িয়ে আছে চন্দ্রাবতীর শিবমন্দির আর ভগ্নপ্রায় কয়েকশ’ বছরের পুরনো বাড়ি। যার প্রতিটি ইটের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে নানা কিংবদন্তি।মনসা মঙ্গল কাব্যের অন্যতম রচয়িতা ও ভাসান কবি দ্বিজ বংশী দাস ও সুলোচনা দাসের মেয়ে চন্দ্রাবতীর জন্ম ১৫৫০ খ্রিষ্টাব্দে।

স্বরচিত রামায়ণের ভূমিকায় চন্দ্রাবতী আত্মপরিচয় দিয়েছেন:

"ধারাস্রোতে ফুলেশ্বরী নদী বহি যায়।
বসতি যাদবানন্দ করেন তথায়।।
ভট্টাচার্য্য বংশে জন্ম অঞ্জনা ঘরণী।
বাঁশের পাল্লায় তাল-পাতার ছাউনী।।
... ... ... ..... .... ...... ...... ... .... ...
বাড়াতে দারিদ্র-জ্বালা কষ্টের কাহিনী।
তার ঘরে জন্ম নিলা চন্দ্রা অভাগিনী।।
সদাই মনসা-পদ পূজি ভক্তিভরে।
চাল-কড়ি কিছু পাই মনসার বরে।।
... ... ... ... ... ... .... ... .... .... ....
শিব-শিবা বন্দি গাই ফুলেশ্বরী নদী।
যার জলে তৃষ্ণা দূর করি নিরবধি।।
বিধিমতে প্রণাম করি সকলের পায়।
পিতার আদেশে চন্দ্রা রামায়ণ গায়।।"

১৯৩২ সালে  দীনেশচন্দ্র সেন চন্দ্রাবতীর রামায়ণ প্রকাশ করেন। পূর্ববঙ্গ-গীতিকার চতুর্থ খন্ডের ২য় ভাগে এ রামায়ণ স্থান পেয়েছে। দীর্ঘদিন এ কাব্য পূর্ব ময়মনসিংহে ঘরে ঘরে পঠিত ও গীত হয়েছে। লৌকিক, মানবিক ও অন্যান্য মৌলিক উপাদানসমৃদ্ধ এ কাব্যটি বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। পশ্চিমবঙ্গের অনেক স্থানে পঠিত ও মহিলাদের দ্বারা গীত হয়েছে তার রামায়ণ গান। দস্যু কেনারামের গাথা  কাহিনীটি ‘দ্বিজ বংশীসুতা’ এ ভণিতায় চন্দ্রাবতীর রচনা বলে চিহ্নিত হয়েছে।

তাছাড়া চন্দ্রাবতী অজস্র লোকগীতি রচনা করেন। নৌকার মাঝির কণ্ঠে, ব্রতে, বিয়েতে এবং প্রতিদিনের গার্হস্থ্য জীবনে আজও শোনা যায় চন্দ্রাবতীর গান। ষোল শতকের সামাজিক-আর্থনীতিক অবস্থার স্বরূপ প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর রচনায়। চন্দ্রাবতীর স্মৃতি, রচনা, জীবন ও সাহিত্য আজও বহমান স্রোতোধারার মতো গবেষক ও পর্যটককে আকর্ষণ করে।

চন্দ্রাবতীর রচিত কাব্যগুলি হল;
▪ মলুয়া,
▪ দস্যু কেনারামের পালা (মনসার ভাসান, রচনাকাল: ১৫৭৫ শকাব্দ),
▪ রামায়ণ।

চন্দ্রাবতীকে নিয়ে প্রচলিত লোকগাঁথাটি ছিল এমন:

বাল্যকালে চন্দ্রাবতীর বন্ধু ও খেলার সাথী ছিলেন জয়চন্দ্র চক্রবর্তী নামের এক অনাথ বালক৷ ফুলেশ্বরী নদীর এপারে পাডুড়িয়া পল্লীতে চন্দ্রাবতীর বাস আর জয়চন্দ্রের নিবাস ওপারের সুন্ধা গ্রামে৷ জয়চন্দ্র তাঁর মাতুলগৃহে পালিত৷ দ্বিজ বংশীদাসের অনেক রচনায় এই দুজনার রচিত ছোট ছোট অনেক পদ রয়েছে৷ পুষ্পবনে শিবপূজার ফুল তোলার সময় চন্দ্রার সঙ্গে জয়চন্দ্রের পরিচয় ও সখ্যতা ঘটে। ক্র্রমশ কৈশোর উত্তীর্ণ হলে দুজনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন বলে স্থির করেন। বিবাহের দিনও স্থির হয়৷ শাস্ত্রবিৎ পণ্ডিত জয়চন্দ্র ইতোমধ্যে অন্য এক রমনীর প্রেমে পড়ে যান৷ স্থানীয় মুসলমান শাসনকর্তা বা কাজীর মেয়ে আসমানীর অসামান্য রূপে মুগ্ধ হয়ে ব্রাহ্মণ জয়চন্দ্র আসমানীকে একাধিক প্রেমপত্র লেখেন৷ এই ত্রিকোণ প্রেমের ফলাফল হয় মারাত্মক৷

জয়চন্দ্রের সাথে চন্দ্রাবতীর প্রেমের কথা জেনেও আসমানী তার পিতাকে জানান তিনি জয়চন্দ্রকে বিবাহ করতে চান৷ কাজী জয়চন্দ্রকে বলপূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে আসমানীর সঙ্গে তার বিবাহ দেন৷ ঘটনাটি ঘটে যেদিন জয়চন্দ্র ও চন্দ্রাবতীর বিবাহের দিন স্থির হয়েছিল সেই দিন৷ সেদিন সন্ধ্যাবেলা চন্দ্রাবতী বিবাহের সাজে পিত্রালয়ে বসে ছিলেন৷ তখনই সংবাদ পেলেন জয়চন্দ্র ধর্মান্তরিত হয়ে অন্যত্র বিবাহ করেছেন৷ ঘটনার আকস্মিকতায় চন্দ্রা হতভম্ব হয়ে পড়েন–

"না কাঁদে না হাসে চন্দ্রা নাহি কহে বাণী।
আছিল সুন্দরী কন্যা হইল পাষাণী।।
মনেতে ঢাকিয়া রাখে মনের আগুনে।
জানিতে না দেয় কন্যা জ্বলি মরে মনে।।"


এরপর শুরু হয় চন্দ্রাবতীর বিরহ-বিধুর জীবন৷ শোকবিহ্বলতা কাটাতে তিনি পিতার কাছে অনুমতি নেন যে সারা জীবন অবিবাহিত থেকে তিনি শিবের সাধনায় আত্মনিবেদন করবেন ৷ তাঁর পিতা তাঁর জন্য ফুলেশ্বরী নদীর তীরে একটি শিব মন্দির নির্মাণ করিয়ে দেন৷ সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ শাস্ত্রজ্ঞানী চন্দ্রাবতীর কৈশোরকাল থেকেই ছিল ৷ তিনি বাকী জীবন বীতস্পৃহভাবে শান্তমনে শিবের উপাসনা ও সাহিত্যচর্চা করে কাটাবেন বলে স্থির করেন৷ ইতোমধ্যে বেশ কিছুকাল পরে জয়চন্দ্র বুঝতে পারেন যে, আসমানীর প্রতি তার টানটা ছিল মোহ মাত্র ৷ মনের থেকে তিনি চন্দ্রাবতীকেই প্রকৃত ভালবাসেন৷ অনুতপ্ত জয়চন্দ্র স্থির করেন যে চন্দ্রাবতীকে তাঁর মনের কথা জানাবেন৷ তিনি চন্দ্রাবতীকে একটি পত্র লিখে পাঠান,

"শুন রে প্রাণের চন্দ্রা তোমারে জানাই।
মনের আগুনে দেহ পুড়্যা হৈছে ছাই।।
..................... .........................
শিশু কালের সঙ্গী তুমি যৌবন কালের মালা।
তোমারে দেখিতে মন হৈয়াছে উতলা।
..................... .........................
ভাল নাহি বাস কন্যা এ পাপিষ্ঠ জনে।
জন্মের মতন হইলাম বিদায় ধরিয়া চরণে।।
একবার দেখিয়া তোমা ছাড়িব সংসার।
কপালে লিখেছে বিধি মরণ আমার।।"

পত্র পড়ে চন্দ্রাবতীর সংকল্পিত ব্রহ্মচর্য, অবিচলিত সংযম ও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। অশ্রুসিক্ত বদনে তিনি পিতার কাছে বিধান চাইলেন। কন্যার মানসিক শিথিলতা মেটাতে বংশীদাস তাকে সান্ত্বনা দিলেন,

"তুমি যা লইয়াছ মাগো সেই কাজ কর।
অন্য চিন্তা মনে স্থান নাহি দিও আর।।"

জয়চন্দ্রকে পত্রদ্বারা নিষেধ করে চন্দ্রাবতী যোগাসনে বসে মনের সমস্ত অর্গল রুদ্ধ করলেন, তাঁর চোখের জল শুকিয়ে গেল। শিব-ধ্যানে আত্মহারা হয়ে তিনি সমস্ত জাগতিক জ্ঞান লুপ্ত হলেন।

এক সন্ধ্যায় জয়চন্দ্র ও চন্দ্রাবতীর বিচ্ছেদ হয়েছিল; অপর সন্ধ্যায় সেই বিচ্ছেদ মুছে গিয়ে মিলন হবে দুজনার — এই আশায় জয়চন্দ্র রওনা দিলেন পাতুয়ার/পাটোয়ারী গ্রামে৷ জয়চন্দ্র যখন গন্তব্যস্থলে পৌঁছলেন তখন সূর্য্যাস্ত হয়ে গেছে, তখন দিন ও রাত্রির সন্ধিক্ষণ৷ শিব মন্দিরের ভেতর দ্বার রুদ্ধ করে সন্ধ্যারতি ও তপজপে নিজেকে নিবদ্ধ করেছেন চন্দ্রাবতী৷ জয়চন্দ্র মন্দিরের দ্বারে এসে কয়েকবার ডাকলেন চন্দ্রাবতীকে৷ কিন্তু দ্বার রুদ্ধ থাকায় এবং একাগ্রমনে ধ্যানে নিমগ্ন থাকায় সেই শব্দ প্রবেশ করল না চন্দ্রাবতীর কানে৷ ব্যর্থ প্রেমিক জয়চন্দ্র তখন লালবর্ণের সন্ধ্যামালতী ফুল দিয়ে মন্দিরের দ্বারে চারছত্রের একটি পদে চন্দ্রাবতী ও ধরাধামকে চিরবিদায় জানিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করেন৷

"শৈশব কালের সঙ্গী তুমি যৌবন কালের সাথী।
অপরাধ ক্ষমা কর তুমি চন্দ্রাবতী।।
পাপিষ্ঠ জানিয়া মোরে না হইলে সম্মত।
বিদায় মাগী চন্দ্রাবতী জনমের মত।।"

অনেক পরে মন্দির থেকে বেরিয়ে চন্দ্রাবতী বুঝতে পারেন যে দেবালয় কলুষিত হয়েছে৷ দ্বার পরিষ্কার করার জন্য তিনি কলসী কাঁখে জল আনতে যান পার্শ্ববর্তী ফুলেশ্বরী (স্থানীয় নাম ফুলিয়া) নদীতে৷ ঘাটে পৌঁছেই চন্দ্রাবতী বুঝলেন সব শেষ৷ ফুলেশ্বরীর জলে নিজেকে নিমগ্ন করে প্রাণত্যাগ করেছেন জয়চন্দ্র৷ প্রাণহীন দেহ ভাসছে ফুলেশ্বরীর জলে৷ এই অবস্থায় নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারলেন না চন্দ্রাবতী৷ তিনিও অচিরে প্রেমিকের সাথে পরলোকে চিরমিলনের কামনায় ফুলেশ্বরীর জলে ডুবে প্রাণত্যাগ করেন।

"একেলা জলের ঘাটে সঙ্গে নাই কেহ।
জলের উপরে ভাসে জয়চন্দ্রের দেহ।।
দেখিতে সুন্দর কুমার চাঁদের সমান।
ঢেউ-এর উপরে ভাসে পৌর্ণ মাসী চাঁদ।।
আঁখিতে পলক নাই! মুখে নাই বাণী।
পারেতে দাঁড়াইয়া দেখে উন্মত্তা কামিনী।।"

জয়চন্দ্রের গ্রাম সুন্ধা খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ তবে ইতিহাসের স্মৃতি বিজড়িত পাতুয়ার/পাটোয়ারী গ্রাম আজও আছে৷ কিশোরগঞ্জ শহর থেকে উত্তর-পূর্ব্ব দিকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে৷ আর আছে ফুলেশ্বরী নদীর ধারে চন্দ্রাবতীর পূজিত শিব মন্দির৷

বাংলা সাহিত্যের মূল্যবান সম্পদ চন্দ্রাবতীর পালা আর চন্দ্রাবতী রচিত রামায়ণ। কবি চন্দ্রাবতীর অমর প্রেমের স্মৃতি মিশে আছে শিব মন্দিরকে ঘিরে। কিন্তু দীর্ঘদিন সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ না করায় বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে এ ঐতিহাসিক স্মৃতি। 

মন্দিরকে ঘিরে একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা এবং কবির স্মৃতি রক্ষায় একটি পাঠাগার গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছেন পর্যটক ও এলাকাবাসী।

অর্জুন কর্মকার, নিজস্ব প্রতিনিধি | বাংলাদেশদর্পণ.কম