করোনা মহামারীতে সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও দুর্যোগ চলছে। দেশে করোনা রোগীর সংখ্যা সরকারী হিসাব মতে প্রায় দেড় লাখ। প্রতিদিনই মৃত্যুর মিছিল চলছে। কিন্তু তারই সঙ্গে ব্যাপকভাবে দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনাও ঘটছে বলে একটি প্রতিবেদনে দাবি করেছে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট।

বৃহস্পতিবার (০২ জুলাই) সকাল ১১টায় ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটির সাগর রুনি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে গত ছয় মাসে দেশে সংঘটিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবেদন উপস্থান করে সংগঠনটি।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব অ্যাডভোকেট গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক।

তিনি বলেন, প্রতিদিনই দেশের কোন না কোন স্থানে ঘটছে হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটছে। করোনাভাইরাসের প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফলে সারা দেশে মানুষের মনে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। কে বাঁচে, কে মরে কেউ বলতে পারছে না। কর্মহীন মানুষ খাদ্যাভাবে দিশেহারা। সেই দুর্যোগময় মুহুর্তেও ‘মরার ওপর খাড়ার ঘা’র মত হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ীঘর, মঠ মন্দিরে হামলা, ভাংচুর, হত্যা, হত্যা প্রচেষ্টা, জমি দখল, দেশ ত্যাগে বাধ্যকরণসহ নানা নির্যাতন অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের জনজীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে।

অ্যাডভোকেট গোবিন্দ প্রামাণিক জানান, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত গত ৬ মাসে মধ্যে হত্যার শিকার হয়েছে ৭২ জন, হত্যার হুমকী ৬১ জন, হত্যা চেষ্টা ৮৭ জন, জখম ও আহত করা হয়েছে ৫১২ জন, নিখোঁজ হয়েছে ২৫ জন, চাঁদাবাজী হয়েছে ২০ লাখ টাকা, পরিবার ও মন্দির লুঠ এর ৪০টির উপর ঘটনা ঘটেছে। বসতবাড়ী ভাংচুর ও লুঠপাট হয়েছে ১৫৫টি ও সম্পত্তির উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে ৪৬টি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ৩৫টি হামলার ঘটনা ঘটেছে, দখল হয়েছে ২৩৩৩ একর ৬৭ শতাংশ, যার মধ্যে চাক সম্প্রদায়ের ১০০০ একর এবং গারো আদিবাসীদের ৫ একর ভূমি রয়েছে।

হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব আরো বলেন, এই সময়ের মধ্যে ঘরবাড়ী দখলের ঘটনা ঘটেছে ২৬টি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ১৫টি, মন্দিরের ভূমি দখল ১০টি, বসত বাড়ী থেকে উচ্ছেদ ৪৮৯টি পরিবার, উচ্ছেদের চেষ্টা ১৪৬০টি পরিবার, উচ্ছেদের হুমকী ১৮০১ পরিবার, দেশ ত্যাগের বাধ্যকরণ ৫৪৫টি পরিবার। যার মধ্যে ৫০০টি আদিবাসী পরিবার, ৪৫টি হিন্দু পরিবার এবং গারো, ত্রিপুরা এবং মারমাদের ৪০টি গ্রাম শুন্য হয়। আদিবাসী সম্প্রদায় ভারত ও মায়ানমারে আশ্রয় নেয়। দেশত্যাগের হুমকীর শিকার ৫৪০টি পরিবার, নিরাপত্তাহীনতায় ৩৮০৬টি পরিবার, মন্দিরে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নি সংযোগ ১৬৪টি, মন্দিরে লুঠপাট ৬টি। প্রতিমা ভাংচুর ২৪৯টি, বাড়ীতে হামলা-ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে ৪৩৭টি। ৪৮ জনকে অপহরণ করা হয়েছে, অপহরণের চেষ্টা ১ জনকে।

বিগত ৬ মাসে ১৫ জন হিন্দু নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, ১১ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা হয়েছে, ২ জনকে গণধর্ষণ করা হয়েছে। ২৪৮৬ জনকে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। ২৯৩ জনকে ধর্মান্তরের চেষ্টা করা হয়েছে। ৭টি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগের ঘটনা ঘটেছে। মিথ্যা মামলা ৬৯টি, মিথ্যা মামলায় আসামী, গ্রেফতার, বরখাস্ত করা হয়েছে ৩৩ জনকে, ৩৪৩টি পরিবারকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান অপবিত্রকরণ ৫টি, ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনে বাধার ঘটনা ১৫টি। ধর্মীয় নিষিদ্ধ গরুর মাংস খাইয়ে অপবিত্রকরণ ৫০ জনকে। মিথ্যা রাজাকার বানানো ৩ জনকে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ২৫টি। সরস্বতী পূজা উপলক্ষে ৭ লাখ হিন্দু শিক্ষার্থীকে ধর্মীয়ভাবে আঘাত দেয়া হয়েছে।

গত ৬ মাসে ৫৯২টি আলাদা ঘটনা ঘটেছে। এ সবের অধিকাংশ একক ঘটনায় একাধিক ব্যক্তি, পরিবার ও প্রতিষ্ঠান মন্দির ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলে জানিয়েছে সংগঠনটি।

পরিসখ্যান দেখিয়ে হিন্দু মহাজোট দাবি করে, ২০১৯ সালের তুলনায় দ্বিগুন হারে বেড়েছে হিন্দু নির্যাতন। গত ২০১৯ সালে সারা বছর ধরে যে পরিমান নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ২০২০ সালের প্রথম ৬ মাসেই তার চেয়ে বেশী হিন্দু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৯ সালে সারা বছরে হত্যা হয়েছিল ১০৮ জন, ২০২০ এর ৬ মাসেই হত্যা হয়েছে ৭২ জন। আহত হয়েছিল ৪৮৪, অথচ এ বছরের প্রথম ৬ মাসেই আহত করা হয়েছে ৫১২ জনকে। গতবছর বসতবাড়ী থেকে উচ্ছেদ হয়েছিল ৪৩৪টি পরিবার, এবছরের প্রথম ৬ মাসেই বসত বাড়ী থেকে উচ্ছেদ হয়েছে ৪৮৯টি পরিবার, উচ্ছেদের চেষ্টা ১৪৬০ টি পরিবার, উচ্ছেদের হুমকী ১৮০১ পরিবার।

গত বছর দেশত্যাগের হুমকী ছিল ৬৪১টি পরিবারে। এ বছরের প্রথম ৬ মাসেই তিন গুন বেড়ে উচ্ছেদের হুমকীতে ১৮০১ পরিবার। গত বছর দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিলো ৩৭৮টি পরিবারকে, এ বছরের প্রথম ৬ মাসেই দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে ৫৪৫টি পরিবারকে। গতবছর নিরাপত্তাহীনতায় ছিল ২২৬১ পরিবার, এবছর এর প্রথম ৬ মাসেই ৩৮০৬ টি পরিবার। গত বছর মন্দিরে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছিল ১৫৩টি, এ বছরের প্রথম ৬ মাসেই ঘটনা ঘটেছে ১৬৪টি। বাড়ীতে হামলা ভাংচুর অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছিলো ৪৪৮টি, এবছর বেড়ে গিয়ে হয়েছে ৪৩৭টি।

এরপর গোবিন্দ প্রামাণিক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও এদেশের হিন্দু সম্প্রদায় কখনোই স্বাধীনতার স্বাদ লাভ করে নাই। স্বাধীনতার পরপরই ঐতিহ্যবাহী রমনা কালী মন্দির ধ্বংস করা হয়েছে। যদিও তা এখন ভারতীয় অর্থে পুনঃনির্মান হচ্ছে। ১৯৭৪ সালের পহেলা জুলাই পরিত্যক্ত সম্পত্তি আইন পাশ করে এদেশের লক্ষ লক্ষ একর সম্পত্তি দখল করা হয়েছে। এরপর সংবিধান কেটে ছেটে সাম্প্রদায়িকীকরন করা হয়েছে। ২০০১ সালে নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষ ধিক্কার জানালেও সেই সমস্ত নির্যাতনকারী অপরাধীদের একজনও শাস্তি ভোগ করে নাই। সরকারও নির্যাতন বন্ধে কোন ভূমিকা রাখে নাই। হিন্দু সম্প্রদায় দীর্ঘদিন যাবৎ সংখ্যালঘু নির্যাতন ও নিপীড়ন বন্ধে এবং সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব সুনিশ্চিত করতে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসন ও পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং একটি সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার দাবী উত্থাপন করেছে। উক্ত দাবী দাওয়া বাস্তবায়নের দাবীতে হিন্দু সম্প্রদায় সারা দেশে ব্যাপকভাবে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে। কিন্তু বেদনার বিষয় সরকার দাবী দুটির প্রতি কর্ণপাত করে নাই। যে কারনে দিন দিন হিন্দু নির্যাতন বেড়েই চলেছে। এমতাবস্থায় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে দাবি দু’টি পুনরায় উপস্থাপন করে।

সংবাদ সম্মেলনে করোনা পরিস্থিতিতে হিন্দু মহাজোটের কার্যক্রম তুলে ধরেন গোবিন্দ প্রামাণিক। তিনি জানান, দেশে করোনা ভাইরাসের আক্রমণ শুরু হওয়ার পর পরই সারাদেশের ৪৭টি জেলায় মাস্ক, হ্যান্ডগ্লবস, হ্যান্ডসেনিটাইজার বিতরণ করা হয়। হাট বাজার মসজিদ মন্দিরসহ জনবহুল এলাকায় জীবানুনাশক স্প্রে বিতরণ করছে সংগঠনটি। কর্মহীন অসহায় মানুষদের মাঝে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করছে। অসহায় করোনা রোগীদেরকে খাদ্য ঔষধ, পথ্য ও পরামর্শ সেবা কর্মসূচী অব্যাহত আছে। বিভিন্ন জেলায় হিন্দু মহাজোটের নেতা কর্মীরা মানুষের ধান কেটে বাড়ী তুলে দিয়েছে। এ ছাড়াও একটি শব সৎকার টিম গঠন করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লাশ হাসপাতাল ও বাসাবাড়ী থেকে গ্রহণ করে শ্মশানে সৎকারের ব্যবস্থা করছে। বিভিন্ন শ্মশানে সৎকারকর্মীদের সুরক্ষার জন্য গামবুট, পিপিই সহ নিরাপত্তা সামগ্রী বিতরণ করেছে। ২১ সদস্য বিশিষ্ট ফ্রি মেডিকেল টীম গঠন করে বিনা ফিতে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে। ফ্রি লিগ্যাল এইড টিম গঠন করে বিনা ফিতে আইনগত পরামর্শ দিচ্ছে। সারা দেশে হিন্দু মহাজোটের সেবা কার্যক্রম অব্যাহত আছে এবং দুর্যোগ না থামা পর্যন্ত সেবা কার্যক্রম অব্যহত থাকবে।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন হিন্দু মহাজোটের সভাপতি অ্যাড. বিধান বিহারী গোস্বামী, নির্বাহী সভাপতি অ্যাড. দীনবন্ধু রায়, প্রেসিডিয়াম মেম্বার পরিতোষ তরুয়া, কালীপদ মজুমদার, সিনিয়র সহসভাপতি প্রদীপ পাল, যুগ্ম মহাসচিব সুজন দে, অ্যাড. লাকি বাছার, নকুল মন্ডল, অ্যাড. শর্মিলা হালদার, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক প্রদীপ চন্দ্র, হিন্দু স্বেচ্ছাসেবক মহাজোটের আহ্বায়ক শ্যামল ঘোষ, হিন্দু মহিলা মহাজোটের সভাপতি প্রীতিলতা বিশ্বাস, ঢাকা দক্ষিণ হিন্দু মহাজোটের সভাপতি ডিকে সমীর, সাধারণ সম্পাদক শ্যামল ঘোষ, মহিলা বিষয়ক সম্পাদক রুপন্তী ঘোষ, গাজীপুর মহানগরের সাধারণ সম্পাদক আশিষ কুমার, হিন্দু যুব মহাজোটের আহ্বায়ক কিশোর বর্মন, যুগ্ম আহ্বায়ক প্রদীপ শঙ্কর, প্রশান্ত হালদার, হিন্দু ছাত্র মহাজোটের সভাপতি সাজেন কৃষ্ণ বল, প্রদীপ সরদার, নিপু পাল, অখিল মন্ডল, গৌতম সরকার অপু, প্রবীর সরদার, অ্যাড. গৌরাঙ্গ রায়, মিল্টন বিশ্বাস, সানি সাহা, টিকে সরকার আশিষ, কল্যাণ ঘোষ প্রমুখ।

নিজস্ব প্রতিবেদক | বাংলাদেশদর্পণ.কম