বাংলার মানচিত্রে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের মাঝে কালে কালে এমন কিছু মানুষের জন্ম হয়েছে যাদের নাম মানুষ আজীবন মনে রাখবে। তেমনই একটি নাম কবি শাহ লতিফ আফি আনহু।

বাংলা ১৩৩৬ সনের ৫ই আষাঢ় তৎকালীন যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার শালিখা থানার হরিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের দক্ষিণ দিক দিয়ে বয়ে গেছে চিত্রা নদী। যে নদীর পাড়ে বসে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে আজীবন সোনার মত খাঁটি করে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। তার পিতার নাম নাছের উদ্দিন বিশ্বাস এবং মাতা জরিনা বেগম। ছোটবেলায় তার মা তাকে নতে বলে ডাকতেন। প্রতিবেশীরা বলতেন লতিফ। গ্রামের পাঠশালা অতিক্রম করে তিনি ভর্তি হন মাগুরার সিদ্দিকীয়া মাদ্রাসাতে। এরপর তিনি যশোরের পদ্নবীলা মাদ্রাসা এবং সর্বশেষ কলকাতার বসিরহাট জানমামুদ হাইস্কুল ও কলেজে পড়াশোনা করেন। বৃহত্তর যশোর জেলার স্মরণীয় ব্যক্তিত্বের তালিকায় তিনি অন্যতম। মাত্র ২২ বছর বয়সে তিনি আধ্যাত্নিক জ্ঞান অন্বেষণে বেরিয়ে পড়েন। এলাকার গুনী কবিয়াল মহেন্দ্রনাথ গোস্বামীর পরামর্শে তিনি চলে যান কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়াতে। সেখানে লালন শাহের একনিষ্ঠ ভক্ত কোকিল শাহের নিকট বাউলমন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে লতিফ আফি আনহু হয়ে গেলেন শাহ লতিফ। এরপর তিনি বাউল গান এবং লালন শাহের উপর গবেষণা শুরু করেন। এ সময় লালন শাহের উপর অনেক অজানা তথ্য তিনি আবিষ্কার করেন। যার প্রমাণ অধ্যাপক আনোয়ারুল করিমের রচিত "বাউল সাহিত্য ও বাউল গান" নামক গ্রন্থ থেকে জানা যায়। এ সময় তিনি "পৃথিবী জীবনমন" নামক একটি কাব্য রচনা করেন। যেখানে তিনি মানুষের সেবায় সকল ধর্মের মূল বলে উল্লেখ করেন।তিনি লিখেছিলেন-

"পূজিয়া নয়নজলে মানুষের মহাচরণ

     সকলের বিলাইয়া আপন অহম"।

এ গানটি বাংলাদেশ বেতারে খুলনার অনুষ্ঠানে প্রায় শোনা যায়। একই সময়ে তিনি "গণসঙ্গীত" নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। যেটি গণজাগরণে বিশেষ ভুমিকা রাখে।

'৫২- র ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে মানুষকে সংগঠিত করেছেন। একই সাথে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে যশোর-মাগুরা অঞ্চলের কৃষকদের সংগঠিত করে কৃষক সমিতি গড়ে তোলেন। বিভিন্ন সভা সমিতির মঞ্চে তিনি গাইতেন কৃষকদের জন্য।এছাড়াও শিক্ষার আলো বিস্তারের জন্য তিনি প্রথম বাঘারপাড়া মাঠে আয়োজন করেন বইমেলার।

১৯৫৯ সাল থেকে তিনি শালিখা ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ছিলেন অত্র অঞ্চলের সমাজতন্ত্রের অগ্রনায়ক।এ সময় তিনি সংখ্যালঘূদের সহযোগিতার কারণে ডিআইবি মামলা দায়ের হয়। যার কারণে কিছুদিন কারাবরণও করেন। ১৯৬৫ সালে তৎকালীন ঢাকা মিউজিয়ামের অধ্যক্ষ ডঃ ইনামুল হক তাকে শিল্প সংগ্রহক হিসাবে নিয়োগদান করেন। ঐ সময় তিনি বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পী কামরুল হাসান ও আসাফ উদ দৌলার সাথে কাজ করেন। দেশের এবং এলাকার প্রাচীন লুপ্তপ্রায় শিল্পকর্ম তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। এ সময় তিনি লেখেন "সিন্ধু তীরের ক্ষতি" নামক বিশাল এক কবিতা। যেখানে তিনি প্রাচীন সভ্যতার অনেক অজানা বিষয় ফুটে উঠে।

হোমিওপ্যাথি ও প্রাকৃতিক চিকিৎসা বিজ্ঞানেও শাহ লতিফের অবদান অসামান্য। যেকোন ব্যাধি নিরাময়ে তার যশের কথা এলাকাবাসী আজও স্মরণ করে। ষাটের দশকে তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের উপর অনেক গবেষণা করেন এবং লিপিবদ্ধ করেন। ঐ সময় চট্টগ্রাম থেকে অমল চন্দ্র সেনের সম্পাদিত "শাশ্বতী" নামক চিকিৎসা বিষয়ক পত্রিকাতে তার গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হত। এ ছাড়াও "সমবিধান" নামক পত্রিকাতে হোমিওপ্যাথি ও প্রাকৃতিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেক অজানা বিষয়ের বিভিন্ন গবেষণা প্রকাশিত হয়।

'৭১- এর মুক্তিসংগ্রামের মাঝামাঝি সময়ে তিনি ভারতে চলে যান এবং সেখানে স্বল্প সময় অবস্থাকালে "আকাশবাণী" বেতারকেন্দ্রে দেশাত্মবোধক গান পরিবেশ করে মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করেন। তার গান মুক্তিসংগ্রামী বাঙ্গালীকে পথ নির্দেশক হিসেবে কাজ করে। এর মাঝে তিনি দেশে ফিরে আসেন। দেশে তখন নকশালপন্থীদের গণহত্যা চলছে। তিনি এই গণহত্যার বিরোধিতা করে গাইলেন-

"মানুষ মেরে মানুষের জন্য সমাজতন্ত্র, 

    ও তন্ত্র ভেজালতন্ত্র,ও নয় গণতন্ত্র

    ও তন্ত্র ধ্বংসতন্ত্র,ও নয় মুক্তিতন্ত্র"।

 

এই গণহত্যার বিরোধিতা করতে গিয়ে অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী শাহ লতিফ আফি আনহু ১৯৭১ সালের ২০ জুন(বাংলা ১৩৭৮ সনের ৫ ই আষাঢ়) মাত্র ৩৯ বছর বয়সে ঘাতকের গুলিতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন নারিকেলবাড়িয়া বাজারস্থ নিজ চিকিৎসাকেন্দ্রে। কবির মৃত্যুর পর তার সারাজীবনের সাধনা ও কর্মফলের সকল পান্ডুলিপি বাড়ি থেকে চুরি হয়ে যায়। আলমারি থেকে হারিয়ে যায় রাশি রাশি মূল্যবান পুথি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বাংলাদেশ সরকার কবিকে বাঙালী জাতীয় বীর সন্তান হিসাবে গেজেট প্রকাশ করেন। মহৎই প্রাণের বিয়োগের পর তার স্মরণ সভায় গান করেছেন বাংলাদেশর প্রখ্যাত সব শিল্পী। তবে আজও মানুষ শ্রদ্ধা ভরে গেয়ে থাকেন-

 

" চিত্রা নদীর পাড়ে,হরিশপুরের গায়ে,

শহিদ আমার সোনার লতিফ, রয়েছে ঘুমায়ে"।

 

(তথ্যসূত্রঃ লতিফ শাহ, একজন সোনার মানুষের গল্প) 

সন্দীপ মন্ডল, বাঘারপাড়া প্রতিনিধি | বাংলাদেশদর্পণ.কম