কট্টর সুন্নি মুসলমানরা হিন্দুবিরোধী, ইহুদিবিরোধী, খ্রিস্টানবিরোধী, নাস্তিকবিরোধী,,সুফিবিরোধী, শিয়াবিরোধী, আহমদিয়াবিরোধী, জোরোয়াস্ত্রিয়ানবিরোধী, বাহাইবিরোধী.....।

আর কট্টর হিন্দুরা মুসলমানবিরোধী, মুসলমানবিরোধী এবং মুসলমানবিরোধী।

হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান নাস্তিক আস্তিক লিবারেল কট্টর ইত্যাদি মিলিয়ে যে বাঙালি সমাজ--সেটিকে দেখতে পাই ফেসবুকে।

আর কিছুটা অবাঙালি ভারতবর্ষকে দেখি টুইটারে। ফেসবুকের তুলনায় টুইটার ভয়াবহ জায়গা। আমাকে হিন্দুত্ববাদীদের গালি খেতে হয় সকাল বিকাল। যা কিছুই বলি না কেন, তারা খোঁজে ভারত সম্পর্কে বা হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে তিল পরিমাণের হলেও কোনও কটাক্ষ করেছি কিনা। কটাক্ষ না করলেও তাদের কাছে মনে হতে থাকে এই বুঝি কটাক্ষ ওই বুঝি কটাক্ষ।

কাল কিছু মুসলমান তরুণ মানব বন্ধন করে একটি মন্দিরকে রক্ষা করতে চাইছে উন্মত্ত মুসলিমদের হাত থেকে -- এই ছবিটি টুইটারে পোস্ট করার পর উথাল পাথাল গালি শুরু হলো হিন্দুদের। ওটা নাকি ফেইক নিউজ। বড় মিডিয়াগুলো ছাপিয়েছে, ভিডিওও বেরিয়েছে, ফেইক নিউজ নয়। কিন্তু কোনও মুসলমান যে মানবিক হতে পারে এ তারা বিশ্বাস করে না বলেই ওটি ফেইক নিউজ। কাল ব্যাঙ্গালোরের মুসলিম সন্ত্রাসের ঘটনা স্মরণ করে লিখেছিলাম রিলিজন ইজ দ্য রুট কজ অব রিলিজিয়াস টেরোরিজম। অমনি বন্যার জলের মতো গালি এসে ভেসে গেল আমার আঙ্গিনা । দোষটা কী আমার? তারা ধরেই নিয়েছে ওই রিলিজন শব্দের মধ্যে হিন্দু ধর্ম আছে ( যদিও তারা তাদের ধর্মকে ধর্ম বলে, রিলিজন বলে না। ধর্ম এবং রিলিজন যে আলাদা তাও বলে)। আমি একজনকে জিজ্ঞেস করলাম তোমরা কি রিলিজিয়াস টেরোরিজম করো? উত্তর এলো, না। প্রশ্ন, তাহলে কেন ভাবছ হিন্দু ধর্মের কথা বলা হয়েছে এখানে? যারা ধর্মীয় সন্ত্রাস করে, শুধু তাদের কথা বলা হয়েছে। কে শুনবে কার কথা? প্রধানমন্ত্রী এবং গৃহমন্ত্রীকে ট্যাগ করে আমার ভিসা বাতিল করার শত শত উপদেশ পাঠিয়ে দেওয়া হলো।

আজ টুইট করেছি ট্রাম্পকে নিয়ে। কমলা হারিসের নাগরিকত্ব নিয়ে ট্রাম্প সংশয় প্রকাশ করছেন, ঠিক যেমন ওবামার নাগরকিত্ব নিয়ে করেছিলেন। -- এটিকে ট্রাম্পের বর্ণবাদী মানসিকতা বলে যে-ই না উল্লেখ করেছি, যেই না বলেছি ট্রাম্পের মা-ও তো ইমিগ্র্যান্ট ছিলেন, স্কটল্যান্ড থেকে আসা, তাহলে কি ইউরোপ থেকে মা বাবা এলে ঠিক আছে, শুধু এশিয়া আর আফ্রিকা থেকে এলেই ঠিক নেই? (ডেমোক্রেট পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী কমলা হারিসের মা ভারত থেকে , বাবা জামাইকা থেকে, কমলা জন্মেছেন আমেরিকাতেই।) ও মা, আমার দিকে ধেয়ে এল গালির তুফান। কমলা নাকি এন্টিইণ্ডিয়া। ট্রাম্পকে সাপোর্ট না করে কমলাকে ডিফেণ্ড করেছি কেন, নিশ্চয়ই আমি ভেতরে ভেতরে মুসলমান! আবারও ট্যাগ। আবারও একই উপদেশ, এর ভিসা বাতিল করো।

হিন্দুদের ইনসিকিউরিটি দেখি। দেখি আর বুঝে পাই না, কিভাবে এর আশু সমাধান হবে। যেভাবে হিন্দুদের মধ্যে বাস করে কিছু মুসলমান জ্বালাও পোড়াওয়ে মেতে ওঠে, এতে হিন্দুদের ঘৃণা আরো বেড়ে যায়, রাগ আরো বেড়ে যায়, ইনসিকিউরিটিও আরো বেড়ে যায়। আমার ভয় হয় হিন্দু মুসলমানে আবার কোনদিন না রায়ট লেগে যায়। আমরা তো দেশভাগ না দেখলেও দেশভাগের ভয়াবহ রক্তপাত দেখেছি। ভয় হয়।

মাঝে মাঝে ভাবি ভাগই যখন হয়েছিল দেশ, তখন ঠিক ঠাক ভাগ হওয়াই হয়তো উচিত ছিল। সব মুসলমান পাকিস্তানে, সব হিন্দু ভারতে। সেক্যুলার ভারত কি সত্যিই সেক্যুলার ভারত? সেক্যুলার হলে মুসলিমদের জন্য ধর্মীয় আইন থাকতো না। সেক্যুলার হলে মন্দির মসজিদ ধর্ম টর্ম নিয়ে রাষ্ট্র মাথা ঘামাতো না। দেশভাগ হয়েছে ৭৩ বছর আগে, আজও ভারতে পাকিস্তানে, পাকিস্তান থেকে টুকরো হওয়া বাংলাদেশে, ধর্মটা কোনও ধর্ম নয়, স্রেফ রাজনীতি।

এ অঞ্চলের মুসলমানের প্রায় সকলেরই পূর্বপুরুষ/পূর্বনারী ভারতীয় হিন্দু। একই রক্ত বইছে দু'পক্ষের শরীরে। একই ভাষা আর সংস্কৃতি দু'পক্ষের। তাই হিন্দু- মুসলমানের বন্ধুত্বের আশা করেই যাচ্ছি নিরবধি। এ কি দেখা হবে আমার জীবনকালে?সংশয়।

তসলিমা নাসরিন, নির্বাসিত লেখিকা

[এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। বাংলাদেশ দর্পণ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।]