বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র দ্বারা খন্ডনকৃত সতীর ডান হাত পড়ে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ ধামে। গবেষকদের মতে সতীর স্মৃতি বিজড়িত চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ ধামের নাম প্রথমে ছিল সতীকুণ্ড। কালের বিবর্তনে তা সীতাকুণ্ড হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণ পক্ষের শিব চতুর্দশীতে মানুষের মেলা বসে চট্টগ্রাম শহর থেকে ৩৭ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত সীতাকুণ্ড পাহাড়ে। এই তীর্থক্ষেত্র ৩৫০ কিলোমিটারের এক বিশাল অংশের পাহাড় এলাকা ঘিরেই আবর্তিত। এ অংশের মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর। পাশাপাশি এখানে দুই পাহাড়ের শীর্ষস্থানে আছে দুটি মন্দিরের অবস্থান।একটি বিরুপাক্ষ মন্দির অন্যটি চন্দ্রনাথ মন্দির। বিরুপাক্ষ ও চন্দ্রনাথ মন্দির, চন্দ্রনাথ মন্দিরটি সমতল ভূমি থেকে ১৩০০ ফুট উচ্চে পাহাড়ের শীর্ষদেশে অবস্থিত। এ মন্দির তথা পাহাড় একে অন্যে মিলেমিশে একাকার হয়ে চন্দ্রনাথ ধাম হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। প্রতি বছর শ্রীশ্রী শিবরাত্রি ব্রত উপলক্ষ্যে বাংলাদেশের প্রধান তীর্থস্থান হিসাবে খ্যাত চন্দ্রনাথ ধামে বসে মানুষের মিলন মেলা। তীর্থস্থান পবিত্র স্থান।
তীর্থের জল, মাটি বাতাস সবই পবিত্র ।তাইতো তীর্থ স্থানে গেলে মন পবিত্র হয়। মনে ধর্ম ভাব জাগে। ধর্মভাব জাগরনে মনের কলুষতা দূর হয়। পাপ কাজ থেকে মনকে সরিয়ে আনা সম্ভব হয়। তীর্থস্থান মানুষের মিলন মেলার স্থান। সেখানে গেলে কোন হিংসা-বিদ্বেষ, উচু নীচু ভেদ বৈষম্য কিংবা জাগতিক লোকসানের চিন্তাবোধ থাকেনা। তীর্থস্থান ভ্রমনের ফলে মনের ময়লা দূর হয়, পুণ্য আসে, মন জুড়ায়, অশান্তি দুর হয়।
সীতা মন্দির নামে পাহাড়ের পাদদেশে আছে একটি মন্দির। এ মন্দিরটির অবস্থান আকর্ষনীয়। ধর্মীয় গাম্ভীর্যের ভাব আর প্রকৃতির নির্ঝরনী শব্দ দুয়ে মিলে মনোরম দৃশ্য মুগ্ধ করে আগন্তুক ভক্তদের। উক্ত মন্দির অভ্যন্তরে আছে চতুর্ভূজা সীতাদেবীর মূর্তি। ত্রিপুরার ইতিহাসের তথ্যানুযায়ী সম্ভুনাথ মন্দিরের প্রথম কাজ হয়েছিল ১৫০১ খ্রিষ্ঠাব্দে।
ত্রিপুরার মহারানী রত্নমঞ্জরী ১৯২০/১৯২৪ সালে এ মন্দিরটি সংস্কার করেন। এ ছাড়াও মধ্যবর্তী পাহাড়ে আছে আরও বেশ কয়েকটি মন্দির। স্বয়ম্ভুনাথ, রামকুন্ড, লক্ষনকুন্ড মন্দিরের নাম বিশেষভাবে উল্যেখযোগ্য। উল্লেখিত মন্দির গুলোর মধ্যে এই তিথিতে ভক্ত সমাগম ও পুজার্চনা হয় সম্ভুনাথ মন্দিরে। কেননা সুউচ্চ পাহাড়ে যাদের পক্ষে উঠা সম্ভব হয়না তারাই এ মন্দিরে পুজার্চনা করেন। সম্ভুনাথ মন্দিরটি ষোড়শ শতাব্দিতে ধনমানিক্য বাহাদুর, পরৈকোড়ার জমিদার বৃন্দাবন দেওয়ানের মাতা দুর্গারানী, প্রতাপ চৌধুরী ও ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার জমিদার বিদ্যাময়ী দেবীর অর্থায়নে নির্মিত।
১৯২৩ সালে বর্ধমান জেলার শিয়ালশোলের রাজা শ্রীযুক্ত প্রমথনাথ মালিয়া শম্ভুনাথ মন্দিরে যাওয়ার ৬৮টি সিড়ি নির্মান করে দেন। চন্দ্রনাথ পাদদেশ থেকে শীর্ষস্থান পর্যন্ত থাক থাক করে বানানো হয়েছে সিঁড়ি। সিঁড়িগুলো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জন বানিয়ে দিয়েছেন। অধিকাংশ সিঁড়ির গায়ে খোদিত আছে উদ্যোক্তার নাম। পাপ খন্ডন অথবা নিকট আত্নীয়দের নামে উৎসর্গ করা হয়েছে সিঁড়িগুলো। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, সিঁড়ি নির্মানের প্রথম উদ্যোগ গ্রহন করেন চব্বিশ পরগনা নিবাসী শ্রীগঙ্গারাম বিশ্বাস। তার বৃদ্ধ মাতা চন্দ্রনাথ দর্শনে এসে পাহাড়ী দূর্গমপথে পৌছুতে পারেননি চন্দ্রনাথ মন্দিরে। এ কারনে বৃদ্ধমাতা ছেলেকে নির্দেশ দেন- সীতাকুন্ড পাহাড়ে সিঁড়ি নির্মান করে দেওয়ার। মাতৃ আজ্ঞা পালন করতে ১২৭০ বঙ্গাব্দে শ্রীগঙ্গারাম বিশ্বাস সীতাকুন্ডের পাহাড়ী পথে ৭৮২টি সিঁড়ি নির্মান করেন। নানা কারনে সিঁড়ি গুলো ক্ষতিগ্রস্থ হলে ১৩২৯ বঙ্গাব্দে সিঁড়িগুলো সংস্কার করে দেন চব্বিশ পরগনার জমিদার শ্রীসূর্যকান্ত রায় চৌধুরী।
এরপর শ্রীগোপাল চন্দ্র সাহা ও মধুসূধন সাহা নামের দুই সহোদর বিরুপাক্ষ মন্দির থেকে চন্দ্রনাথ মন্দির পর্যন্ত প্রায় ১.২৫ কিলোমিটারের পথে সিঁড়ি নির্মান করে দেন। এছাড়াও অন্নদা রঞ্জন বন্দোপাধ্যায় ও বসন্ত কুমারী দেবীর নামে রয়েছে কিছু সিঁড়ি। এ সিঁড়িগুলো নির্মানের ফলে তীর্থযাত্রীরা পৌছাতে পারেন শীর্ষস্থানে। মূল পাহাড়ী চুঁড়ায় অবস্থিত মন্দিরটি চন্দ্রনাথ মন্দির এবং সর্বোচ্চ গিরিশৃঙ্গে অবস্থিত বিরুপাক্ষ মন্দির। পরৈকোড়ার জমিদার নারায়ন লালা এ মন্দিরগুলোর নির্মাতা।
তিনি চন্দ্রনাথ মন্দির ও বিরুপাক্ষ মন্দিরের জল সরবরাহের খরচ নির্বাহে ৮০০দ্রোন লাখেরাজ ভূমি দান করেছিলেন। ১৩২৫ সালে মন্দির গুলো ক্ষতিগ্রস্থ হলে রংপুরের ডিমলার রানী শ্রীমতী বৃন্দারানী চৌধুরানী বহু অর্থ ব্যায় করে মন্দিরগুলোর সংস্কার করে দেন। এ ছাড়াও তিনি ১৩০৪ বঙ্গাব্দে চন্দ্রনাথ ও বিরুপাক্ষ মন্দিরের সিঁড়ি ও লৌহ সেতু নির্মান করে দেন এবং তাঁর স্বামী রাজা শ্রীজানকি বল্লভ সেনের নামে স্মৃতি ফলক দেন।
মন্দির নির্মান, সংস্কার ও উন্নয়নে আরও অনেক ব্যাক্তির অবদান রয়েছে। এর মধ্যে ত্রিপুরার রাজা শ্রীগোবিন্দ মানিক্য, সরোয়াতলী গ্রামের জমিদার শ্রীরাম সুন্দর সেন এবং ময়মনসিংহের জমিদার রাজেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরী অন্যতম। বর্তমানে মন্দিরগুলো জরাজীর্ণ অবস্থায় আছে তাই এগুলোর সংস্কার করা জরুরী।
স্বয়ম্ভুনাথ মন্দিরঃ ভবানী মন্দির হতে সামনের দিকে ২৫/৩০ খানা সিঁড়ি অতিক্রম করলে চারদিকে উঁচু পাহাড় এবং মাঝখানে একটুখানি সমতল ভূমি। এখানেই রয়েছে শ্রী শ্রী স্বয়ম্ভুনাথ মন্দির । অষ্টশক্তি অষ্টমূর্তি সহিত এ অনাদি শিব লিঙ্গ ত্রিলোকে দূর্লভ। মানবকুল তাঁকে দর্শন করে সকল পাপ হতে মুক্ত হয়ে ধনধান্য, স্ত্রী-পুত্রাদি, ঐশ্বর্য সুখ-ভোগাধিসানে শিবত্ব লাভ করতঃ আর পুনঃ জন্ম গ্রহণ করেনা। পূণ্যপ্রদ স্বয়ম্ভুলিঙ্গ দর্শনে সকল তীর্থ দর্শনের ফল। স্বয়ম্ভুনাথ মন্দির চত্বরে রয়েছে শ্রী শ্রী নব ভৈরব মন্দির, হরগৌরী শিব মন্দির, অন্নপূর্ণা মন্দির, নারায়ণ মন্দির, ভগবান বিষ্ণুর শালগ্রাম শিলা এবং অন্নপূর্ণা বাসুদেব, রাম-লক্ষণ সীতা’র মূর্তি রয়েছে।