কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহের চেকপোস্টে ঈদুল ফিতরের দিন জঙ্গি হামলার ৫ বছর পূর্ণ হলো বুধবার (৭ জুলাই)।

২০১৬ সালের ৭ জুলাই এই হামলার ঘটনায় দুই পুলিশ সদস্য এবং এলাকার এক গৃহবধূ নিহত হন। এছাড়া বন্দুকযুদ্ধে এক জঙ্গি ঘটনাস্থলে নিহত হয়। দেশের ইতিহাসে গুলশানের হলি আর্টিজানে অস্ত্রধারী জঙ্গিদের ভয়াবহ হামলার ৬ দিন পর শোলাকিয়ায় এই রক্তাক্ত হামলার ঘটনা ঘটেছিল।

ওই দিন জামাতের আগে শোলাকিয়া ঈদগাহের প্রায় আধাকিলোমিটার দূরে চরশোলাকিয়া এলাকার সবুজবাগ মোড়ে মুফতি মোহাম্মদ আলী জামে মসজিদের সামনে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যদের ওপর বোমা হামলার পর দুই পুলিশ সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা করে জঙ্গিরা।

ঘটনার পর পুলিশ-র‌্যাবের সম্মিলিত প্রতিরোধে হামলায় অংশ নেয়া দুই জঙ্গির একজন নিহত ও আরেকজন আহত অবস্থায় আটক হয়। ভয়ংকর সেই জঙ্গি হামলার দুঃসহ স্মৃতি আজও ভুলতে পারেনি এলাকার মানুষ।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সবুজবাগ গলির মাথায় মুফতি মোহাম্মদ আলী মসজিদের সামনে টহলরত ছিলেন পুলিশ সদস্যরা। সেখান দিয়ে জঙ্গিরা ভেতরে ঢোকার সময় তাদের ব্যাগ তল্লাসি করতে যায় পুলিশ। এর মধ্যেই হাতবোমা ছুঁড়ে মারা হয় পুলিশকে লক্ষ্য করে। বোমার বিস্ফোরণে কয়েকজন পুলিশ সদস্য মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আক্রান্ত অন্য পুলিশ সদস্যরা আত্মরক্ষার্থে পিছু হটেন।

চেকপোস্ট আক্রান্ত হওয়ার খবরে অন্য পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে জঙ্গিদের ধরতে অভিযানে নামেন। এ সময় জঙ্গিরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু করে। পুলিশও পাল্টা গুলি ছোঁড়া শুরু করে। চেকপোস্টটি দিয়ে ঈদগাহমুখী মুসল্লিরা তখন আত্মরক্ষার্থে দিকবিদিক ছুটতে থাকেন।

জঙ্গি হামলা ও বন্দুকযুদ্ধের পুরো বিষয়টি পাঁচতলার বাসা থেকে প্রত্যক্ষ করেন সবুজবাগ এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী হাফিজুর রহমান রেনু। তিনি জানান, ঘুম থেকে উঠে জামাতে যেতে গোসলের প্রস্তুতি নেন তিনি, এমন সময়েই বোমার বিস্ফোরণ।

ঘটনার বিবরণ এবং জঙ্গিদের অবস্থান জানিয়ে হাফিজুর রহমান রেনু সদর থানার ওসিসহ জেলা পুলিশের উর্ধতন একাধিক কর্মকর্তাকে ফোনে অবহিত করেন। এরপরই পুলিশ জঙ্গিদের ধরতে অভিযান শুরু করে। পুলিশের সঙ্গে জঙ্গিদের গোলাগুলিতে তখন কান ঝালাপালা অবস্থা।

জঙ্গিরা ঢুকে পড়ে রেনুর বাসার সামনে সবুজবাগ গলিতে। ভয়ে বাসার সবাই দরজা-জানালা বন্ধ করে মেঝেতে শুয়ে পড়েন। নিচের কেঁচি গেট লাগিয়ে দেওয়া হয়। হাফিজুর রহমান রেনু বাসার চার তলায় গিয়ে জানালার পাশে অবস্থান নেন। তাঁর বাসার পাশের বাসার বাইরে ঘুপচিতে দুই জঙ্গি অবস্থান নিয়েছিল। তাদের ধরতেই গুলিবিনিময়।

হাফিজুর রহমান রেনু বলেন, ‘পুলিশ গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে যখন ঘুপচির দিকে এগিয়ে যায় তখন এক হামলাকারী পুলিশকে লক্ষ্য করে হাতবোমা নিক্ষেপ করে। ঘুপচির ওপাশে দেয়াল দিয়ে বন্ধ থাকায় দুই হামলাকারী আটকা পড়ে যায়। এক হামলাকারী এ সময় হাতে থাকা চাপাতি ঘোরাতে ঘোরাাতে পুলিশকে আক্রমণ করতে আসে।

এক পর্যায়ে সে সময়ের কিশোরগঞ্জ সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ মুর্শেদ জামান (বর্তমানে ইটনা থানার ওসি) সহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য একের পর এক গুলি করে চাপাতি হাতে থাকা জঙ্গিকে মাটিতে ফেলে দেন।’

সবুজবাগ গলি থেকে পুলিশের ওপর জঙ্গিরা গুলি ছুঁড়ছে। নিক্ষেপ করছে হাতবোমা। বিপরীত দিক থেকে পুলিশও পাল্টা গুলি ছুঁড়ছে। এ সময় একটি গুলি সবুজবাগ এলাকার বাসিন্দা গৌরাঙ্গনাথ ভৌমিকের ঘরের টিনের জানালা ভেদ করে ঘরে তার স্ত্রী ঝর্ণা রাণী ভৌমিকের মাথায় গিয়ে লাগে। সাথে সাথেই মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। মৃত্যু হয় তার।

অন্যদিকে জঙ্গি হামলায় আহতদের মধ্যে কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে কনস্টেবল জহিরুল ইসলাম তপুর মৃত্যু হয়। এছাড়া কনস্টেবল আনসারুল হককে ময়মনসিংহ সিএমএইচে নেওয়ার পর ওইদিনই দুপুরে সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়।

এছাড়া পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ঘটনাস্থলে নিহত হয় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া জঙ্গি আবির রহমান (২৩)। ঘটনাস্থল থেকে অপর জঙ্গি দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট এলাকার শফিউল ইসলাম ওরফে ডন (২২) কে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় র‌্যাব আটক করে। পরবর্তিতে নান্দাইলের ডাংরী এলাকায় র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে সে মারা যায়।

ওইদিন জীবন তুচ্ছ করে প্রথম প্রতিরোধ গড়েন চেকপোস্টের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা। জঙ্গিদের হামলায় দুইজন নিহত ও ১২ পুলিশ সদস্য আহত হন। পুলিশ বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে অসীম সাহসিকতার সাথে জঙ্গিদের প্রতিরোধ করায় নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত হয়েছিল শোলাকিয়ার বৃহত্তম ঈদজামাত।

ঘটনাস্থল সবুজবাগ গলির নাম এখন ‘ঝর্ণারাণী ভৌমিক সড়ক’। যদিও পৌরসভার সংস্কার কাজ করতে গিয়ে নামফলকটি সরিয়ে রাখার পর আর প্রতিস্থাপন করা হয়নি। গলির ভেতরে বিভিন্ন বাসার দেয়ালে এখনো গুলির চিহ্ন। এগুলো এখনো মুছেনি।

পাঁচ বছরেও এলাকাবাসী ভুলতে পারেননি সেই দুঃসহ স্মৃতি। সেই ভৌমিক নিবাসে আজো শোকের আবহ। যে জানালাটা ভেদ করে গুলি ভেতরে গিয়ে ঝর্ণা রাণী মারা যান, জানালাটার পাশে ৭ জুলাইয়ের স্মৃতি হিসেবে টানানো হয় ঝর্ণা রাণীর ছবি।

ঝর্ণা রাণীর স্বামী গৌরাঙ্গ ভৌমিক জানান, ঝর্ণা রাণী মারা যাওয়ার পর তার নামে বাসাসংলগ্ন সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। সরকার বড় ছেলে বাসুদেব ভৌমিককে এনআরবি গ্লোব্যাল ব্যাংকে চাকুরি দিয়েছে। সে বাড়িতে আসার সুযোগ খুব কম পায়। এর মধ্যে গৌরাঙ্গ ভৌমিককে অন্যায়ভাবে নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান চাকুরিচ্যুত করেছে। ফলে ছোট ছেলে শুভদেবকে নিয়ে কষ্টে দিনযাপন করছেন তিনি।

গৌরাঙ্গ ভৌমিক বলেন, ছোট ছেলে শুভদেবকে নিয়েই আমার যতো চিন্তা। তার একটা নিশ্চিন্ত জীবন দেখে মরে গেলেও শান্তি পেতাম।

গৌরাঙ্গ ভৌমিক জানান, ঝর্ণা রাণী মারা যাওয়ার পর তার পরিবারকে সরকার পুনর্বাসনের আশ্বাস দিয়েছিল। এ ব্যাপারে সরকারি দপ্তরে চিঠি চালাচালি হলেও এখনো তা বাস্তবায়িত হয়নি।

গৌরাঙ্গ ভৌমিক বলেন, ‘ছোট ছেলে শুভদেব মায়ের ছবি নিয়ে এখনো কাঁদে। বাইরে কোনো কিছুর শব্দ হলেই ভয়ে আতঁকে ওঠে সে। রাতে ‘মা’ ‘মা’ করে চিৎকার করে প্রায়ই ঘুম থেকে জেগে ওঠে। ঘুমানোর আগে দরজা জানালা ভালো করে বন্ধ করতে বলে আমাকে।’

শুধু ঝর্ণা রাণী ভৌমিকের পরিবারের সদস্যরা নয়, সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় এলাকাবাসীও এখনো ভুলতে পারেননি সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি। তাদের ভাষ্য, এখনো সেদিনের কথা মনে হলে তাঁরা আঁতকে ওঠেন। বিশেষ করে শিশুদের মন থেকে এই ঘটনার স্মৃতি দূর হচ্ছে না কিছুতেই।

 

অর্জুন কর্মকার, জেলা প্রতিনিধি | বাংলাদেশ দর্পণ