“সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি”। বাঙালির শাশ্বত শিক্ষা-সংস্কৃতিতে বাল্যকালের শিক্ষার প্রথম ধাপের এই প্রত্যয়টির প্রায়োগিক দিক আমরা পাই ‘বাল্যশিক্ষা’র শুরুতে সীতানাথ বসাক প্রণীত ‘আদর্শলিপি ও সরল বর্ণ পরিচয়’ বইয়ে।

বইটির প্রথমেই ‘অ’তে- অসৎ সংঘ ত্যাগ কর’ বাক্যটি দিয়ে কোমলমতি শিশুদের আনুষ্ঠানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরু হত। তার পরের বাক্যটি “আ’তে–আলস্য দোষের আকর”। সামাজিক জীবন দর্শনে সততা ও পরিশ্রমের অনিবার্যতার বিষয়কে সামনে রেখে আদর্শলিপির শিক্ষার প্রাথমিক স্তরের এই দুটি আদর্শ ভিত্তিক বাক্যের পাঠ দিয়ে বঙ্গশিশুর মনে শিক্ষা ও আদর্শের ভিত্তি রচিত হত।

সততা ও পরিশ্রমের এই আদর্শিক মননশীলতা গড়ে তোলার মাধ্যমে একটি সফল, সার্থক, সুন্দর ও স্বাচ্ছন্দময় জীবন গঠনের মূল শিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করা গেলে আদর্শবাণ অথবা সফলতম একজন মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে কারোই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ভাল হয়ে চলতে গেলে, সুস্থ্য ও পরিচ্ছন্ন জীবন ব্যবস্থায় ভালভাবে প্রতিষ্ঠা পেতে এই দুটি বাক্যের ভাব সম্প্রসারণগত অর্থ জীবনের আদ্যান্তের প্রতিটি মুহূর্তে এবং প্রতিটি কর্ম ও ক্রিয়ায় অনুকরণীয় এবং প্রায়োগিক।

প্রতিটি জীবন ও সমাজের নিত্য-নৈমিত্তিক এবং প্রাকৃতিক বিবর্তিত ধারায় ‘অসততা’ ও ‘অলসতা’ পরিহার করা প্রতিটি মানুষের সামাজিক মানুষ হিসেবে টিকে থাকার ক্ষেত্রে একটি অনিবার্য এবং সার্বক্ষণিক চ্যালেঞ্জ। আমাদের বাল্যশিক্ষার সুচনায় এই দুটি আদর্শিক বাক্যে সেই বাস্তবতাকে তুলে ধরে প্রতিটি শিশুকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে সামাজিক ও দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তোলার পথ প্রদর্শিত হয়েছে।

সময় ও সামাজিক বিবর্তনের ধারায় আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় আমাদের এই সনাতনী শিক্ষার প্রচলন বা প্রতিফলন কতটুকু, অথবা প্রকৃতপক্ষে এই আদর্শিক শিক্ষার কোন মূল্যবোধ অথবা প্রয়োগের প্রয়োজন আধুনিক সমাজে আদৌ রয়েছে কিনা তা নিয়ে ভাববার, সতর্ক বিচার বিশ্লেষণের সময় এসেছে। গুণ ও গুণীর কদর, সত্য ও নিষ্ঠার মূল্যায়ন, শ্রম ও মেধার যাচাই বাচাইএ আজ নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ।

বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতির ক্রমবিবর্তিত ধারায় সত্য-সুন্দর, স্বার্থ-সমাজ, ন্যায়- নৈতিকতার প্রকৃত অর্থ নিয়ে অযথা সংশয়, তথা ভিন্নমত আজ যুক্তি, তর্কে ও বিতর্কের মধ্যে নিমজ্জিত। প্রাথমিক শিক্ষায় প্রচলিত এই বাক্য দুটির প্রচলন অব্যাহত রেখে এর নুন্যতম ভাবার্থও যদি ব্যক্তি ও সামাজ জীবনে প্রতিফলিত করার সমন্বিত প্রচেষ্টা গ্রহণ করা যেত তা হলে আমাদের বাঙালি সমাজ ব্যবস্থা আরও সুন্দর ও সহনশীল হত, সমাজে ন্যায়-নীতির কদর, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও মূল্যবোধের বাস্তবানুগ মূল্যায়ন হত।

‘ভাল’-‘খারাপ’ বিষয়টি আপেক্ষিক। সমাজ-সংস্কৃতি, ব্যক্তি, পরিবেশ-পরিস্থিতিতে এর মাত্রা, গুরুত্ব নির্ণয় এবং বিচারিক মূল্যায়ন এক বা অভিন্ন নয়। শিক্ষার ক্ষেত্রেও একটি শিশু অথবা একজন শিক্ষানবিস একই জিনিষ সমান দক্ষতা বা মানে শিখার কথা নয় এবং সম্ভবও নয়। তারপরও কোন বিষয়ের মৌলিক দিক, সর্বজন গ্রাহ্য সাধারণ ভাবার্থে ভিন্নতা থাকার কথা নয়। সমস্যা আমাদের তখনি, যখন মানবতা, সমাজ ও সংস্কৃতিকে আমরা রাজনীতি, ধর্ম, লিঙ্গ ও বর্ণের সাথে বা বৈষম্যে গুলিয়ে ফেলি। মানবিক, সামাজিক ও সহাবস্থানের সমন্বিত এবং সামগ্রিক মূল্যবোধকে আমরা ব্যক্তি, কোটারী, দল বা ধর্মীয় স্বার্থে ব্যবহার করি।

প্রতিটি মানুষ বাল্যশিক্ষায় আদর্শলিপির প্রণীত প্রথম দুটি চয়নের বাস্তবানুগ ও প্রায়োগিক অর্থ যদি যথার্থভাবে প্রাত্যহিক জীবনে মেনে চলায় অভ্যস্থ হত, তবে বাঙালি জাতি আরও সৎ, কর্মঠ, সৃজনশীল ও দায়িত্বশীল জাতি হিসেবে বিশ্বে তার অবস্থানকে সুদৃঢ় করা সম্ভব হত। অনিবার্য হত আমাদের ব্যক্তিগত সুখ ও সামাজিক শান্তি।