এমন ষড়যন্ত্র শুধু একজন কিশোরের নয়, লক্ষ উদ্যমী কিশোরদের স্পিরিট নষ্ট করতে যথেষ্ট।
এবার তোরা মানুষ হ.........

সকালে ঘুম থেকে উঠে বিদ্যানন্দ প্রধান কিশোর এর পদত্যাগ এর খবর দেখা থেকেই আমার অবচেতন মন কোন একটা সংকেত দিচ্ছে। এটা মনের মধ্যে খচখচ করছে বলে সংকেতটা ভাল মনে হচ্ছে না। কিশোরকে আমি চিনি আজ থেকে ১৮ বছর আগে চুয়েট এ পড়ার সময় হতে। ২০০৬ সালে তার ব্যাচ এর র‌্যাগ অনুষ্ঠান এর কনভেনার ছিল সে। ঐ সময়ে র‌্যাগ কমিটির শিক্ষক প্রতিনিধি হবার সুবাদে তার সাথে গভীরভাবে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। পরবর্তীতে তার ব্যক্তিগত উত্থান/পতন এবং এই সংগঠন সৃষ্টির অনেক কিছু নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আলোচনা হয়েছে সেই সুবাদে।

সম্ভবত শেষবার দেখা হয়েছিল ৭ বছর আগে আমি বৃটেন থেকে PhD শেষে দেশে ফেরার কিছুদিন পর আর ওর পেরু যাবার সিদ্ধান্ত নেবার পর। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে যোগাযোগ কখনও বাধা হয়নি। বিদ্যানন্দ কিন্তু সৃষ্টি হয়েছে কিশোর প্রবাসী হবার পর। পাগল ছেলেটা একদিন চিন্তা করেছিল আত্মহত্যা করবে। তার আগে নিজের কষ্টার্জিত অর্থের সদগতি করার জন্য এই বিদ্যানন্দ এর সৃষ্টি করা। দিনে দিনে সেটি অনেক মানুষের ভালবাসার ও আস্থার একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সবচাইতে বেশী সফল এই করোনা দুর্যোগের সময়। আস্থার কারণে স্রোতের মত টাকা/খাদ্যদ্রব্য আসা শুরু করল। প্রথম ৫০০ পরিবারের মাঝে বিতরণটা আমাদের চুয়েট টিম-ই করেছিল গত ৬ এপ্রিল। এ সময়ে কিশোর-এর সাথে আরও কিছু পরিকল্পনা নিয়ে কথা হত যা করোনার পরে সমাজকে পাল্টে দিবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

আরও পড়ুন: ধর্মের কারণে পদত্যাগ করতে হলো ‘বিদ্যানন্দ’র প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার দাশকে

কিশোর-এর বিদ্যানন্দ প্রধান হতে বিদায় নেওয়ার খবরটা তাদের পেজ-এ যেভাবে লেখা হয়েছে তা থেকে অনেকগুলি প্রশ্নের জন্ম দেয়।

প্রথমত, নাম নিয়ে প্রশ্ন এতদিন পর কেন? ২ বছর আগে মানে ২০১৮ সাল। তখন তো সংগঠন খুব ভাল ভাবেই দাঁড়িয়ে গেছে, ’বিদ্যানন্দ’ নামটাই একটা ব্রান্ড হয়ে গেছে। পরিবতনের প্রস্তাবের যুক্তিটা খুবই খোড়া। যাহোক সেচ্ছাসেবীরা সেযাত্রা না ভোট দিল।

দ্বিতীয়ত, “বিদ্যানন্দের প্রবাসী উদ্যোক্তা সশরীরে খুব অল্পই সময় দিতে পারেন।” কথাটা অনেকটা অভিযোগের মত কানে বাজছে। আরে এই প্রতিষ্ঠান সে তো জন্ম দিয়েছে প্রবাস হতেই। তাহলে এখন কিভাবে তার সময় কম হয়ে যাচ্ছে? না টাকা আসার পরিমাণটা বেশী হয়ে যাচ্ছে? নাহলে জন্মের সাত বছর পর কেন এই প্রশ্ন?

তৃতীয়ত, ধর্মের বিষয় যেটা এসেছে তা নিতান্তই এই প্রতিষ্ঠান সৃষ্টিতে যে সকল উদ্দেশ্য ছিল তার সাথে চরমভাবে সাংঘর্ষিক।

প্রাথমিকভাবে বিদ্যানন্দ পথশিশুদের এক টাকার বিনিময়ে মৌলিক চাহিদা (অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিতসা, আইনসেবা) পুরনের জন্য কাজ করে সমাদৃত হয়। আমাকে একটু বুঝিয়ে দিন তো এ কাজগুলি কোন ধর্মে নিষেধ করা হয়েছে? তাহলে আপনাদের কথামত যারা প্রতিষ্ঠতার ধর্মপরিচয় নিয়ে অপপ্রচার চালায় তারা যে ধর্মেরই হোক না কেন তারা কারা? আর কিশোরের ধর্মপরিচয়ের কারণে যদি প্রতিষ্ঠানের অনুদান আজকে কমে যায় তবে বলতে হবে গত সাত বছরে তা হল না কেন? কথা যদি ঠিকই হয় তবে প্রতিষ্ঠাতা কোন ধর্মের তার উপর ভিত্তি করে যারা দান করতে চান তারা মানবতার ফেরিওয়ালা নয়, ধর্মব্যবসায়ী।

বিদ্যানন্দ যে কাজগুলি করে তা সরাসরি কোন ধর্মীয় কাজ নয় কিন্তু সব ধর্মেই মানবতার সেবা করতে বলা হয়েছে। তাহলে অনুদান যখন ব্যাপকহারে আসছে তখন তা আরও বাড়ানোর নাম করে একদিন যে সর্বস্ব ত্যাগ করে সংগঠন তৈরি করেছিল তাকে সরানোর মতলব মোটেই ভাল নয়। আবার বলছেন এটি আপনারা গোপন রাখতে চেয়েছিলেন করোনা ক্যাম্পেইন শেষ হওয়া পর্যন্ত। কেন? তাহলে ভয় আছে কিশোর ছাড়া এই প্রতিষ্ঠান সহজে চলবে না। টাকা আসাই মুল কথা। টাকা আসা শেষ হলে তাকে অফিসিয়ালি বিদায় দিয়ে দিব।

আর শেষমেষ পদ আকড়ে থাকার কথা কেন আসছে? কতদিন হয়েছে ছেলেটার বয়স? বড়জোর ৪০ বছর। আরও ২০ বছর চালাক তারপর ‍যদি দেখা যায় সে একক নেতৃত্ব দিয়েই চালাচ্ছে এবং বিকল্প তৈরি হচ্ছে না তখন তাকে সরানোর প্রস্তাব দেওয়া যাবে। প্রতিষ্ঠা হতে ৭ বছর কাজ করে সে বিদেশ থেকে সংগঠনকে এ পর্যায়ে এনেছে, আরও ২০ বছর বেঁচে থাকবে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবার জন্য। দায়িত্বে না থাকলে তার যে বেঁচে থাকাটাই কঠিন হবে!

বিদ্যানন্দ আমার অতি প্রিয় একটি সংগঠন। দেশব্যাপী এবার বড় পরিসরে কাজ করে উদাহরণ সৃষ্টি যেমন করেছে, তেমনি দুষমন হয়েছে কিছু শয়তানের। তারা প্রথমদিকে ফেসবুক থেকে পেজ গায়েব করে দিত। ওরা আবার পেজ বানাত, রাতে আবার খেয়ে ফেলত। আরও কিছু সংগঠন আছে যারা কোন কিছু দেবার চেয়ে প্রদর্শনীতে ব্যস্ত বেশী থাকে। বিদ্যানন্দ তাদেরও চক্ষুশুল।

আরও পড়ুন: ‘বিদ্যানন্দ’র চেয়ারম্যান পদেই থাকছেন কিশোর কুমার দাশ

দিনে দিনে বিদ্যানন্দ দেশের সিংহভাগ মানুষের মন জয় করেছে। আর তার পিছনে কাজ করেছে অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। সামান্য কিছু কুচক্রীর মনের আশা পূরণ করার জন্য প্রতিষ্ঠানটি ধংস না হোক, এটিই মনে প্রাণে কামনা করি। 

লেখক: অধ্যাপক সাদিকুল ইসলাম, পুরকৌশল বিভাগ
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)