গাঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়ি বা "মানববাবুর বাড়ি" কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলায় গোবিন্দপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। কিশোরগঞ্জ সদর থেকে এর দূরত্ব ১২ কিলোমিটার।

অপূর্ব কারুকার্যময় এই বাড়িটি প্রাচীন সভ্যতার অপূর্ব এক নিদর্শন। অষ্টাদশ শতকের রোমান-গ্রীক স্থাপত্যকলার দারুণ ব্যবহার দেখা যায় এই বাড়ির স্থাপত্যে শৈলীতে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ভারতের উত্তরপ্রদেশ থেকে এক শাস্ত্রীয় পণ্ডিত খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে এ দেশে এসে বসতি স্থাপন করেন। তার পূর্বপুরুষেরা রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ গোত্রের ছিলেন। তিনিই ছিলেন এ জমিদারদের প্রথম পুরুষ। সে সময়ে গৌড়ীয় রীতি অনুযায়ী তিনি বাড়ির পতিত ভিটায় পূজা-অর্চনার জন্য একটি শিব মন্দির তৈরি করেনর। এ শিব মন্দিরটিই এ বংশের প্রথম নির্মিত মন্দির। 

ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা, পূজা-পার্বণ, আচার-অনুষ্ঠানে জমিদার পরিবারটি এ অঞ্চলে এক সময় ব্যাপক পরিচিতি ও প্রতিপত্তি অর্জন করে। এই বংশের দীননাথ চক্রবর্তী অত্র অঞ্চলের প্রথম জমিদার ছিলেন। তিনি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে হোসেনশাহী পরগণার এক তৃতীয়াংশ ক্রয় করে এ অঞ্চলে জমিদারির গোড়াপত্তন করেন। পরবর্তীতে দীননাথ চক্রবর্তীর ছেলে অতুলচন্দ্র চক্রবর্তী আঠার বাড়ির জমিদার জ্ঞানদা সুন্দরী চৌধুরানীর কাছ থেকে আরো দুই আনা-অংশ ক্রয় করে গাঙ্গাটিয়া জমিদারির সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করে নেন। আর এভাবেই এই জমিদার বাড়িটির উত্থান ঘটে।

জমিদারবাড়ির প্রায় এক কিলোমিটার দূরে নির্মিত এ বংশের প্রথম শিব মন্দিরটি বর্তমানে জরাজীর্ণ হয়ে পড়লেও কালের সাক্ষী হয়ে এটি এখনো বিদ্যমান। এই মন্দিরের পরই দেখতে পাবেন বিশালাকার একটি পুকুর, যার নাম ‘সাগরদিঘী। তার পাশেই আরো একটি জরাজীর্ণ শিব মন্দির রয়েছে। এখনও সেখানে পারিবারিক পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। 

এরপরই শ্রীধর ভবন নামে একটি বিশাল ফটক। এখান থেকে প্রায় ৩০০ গজ দূরে অবস্থিত গাঙ্গাটিয়া জমিদারবাড়ির মূল ভবন। মূল ফটকের সামনে থেকে প্রায় ১২ ফুট চওড়া আর দুপাশে নারকেল গাছের সারিবদ্ধ দৃষ্টিনন্দন রাস্তাটি পেরিয়ে যেতে হয় জমিদারবাড়িতে। এই বাড়ির সৌন্দর্য যে কাউকেই মুগ্ধ করে। এতকাল আগে এতো সুন্দর করে বাড়িটির স্থাপত্য শৈলী নির্মিত হয়েছে তা সত্যিই অবাক করার মত। মূল ভবনটি দুইতলা ভবন। এখানে দেখতে পাবেন বৈঠকখানা, অতিথি কক্ষ, দরবার খানা ও সংগীত সাধনায় ব্যবহৃত কক্ষগুলো। এছাড়াও রয়েছে কাচারিঘর, নহবতখানা, দরবারগৃহ। 

এ জমিদার বাড়ির পিলারের গায়ে গায়ে দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য মুগ্ধ করার মত। জমিদার বাড়িটির সামনেই রয়েছে সুবিশাল আঙ্গিনা এবং বাড়িটি চতুর্দিক থেকে সুউচ্চ প্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টিত।

গাঙ্গাটিয়ার জমিদারের সর্বশেষ বংশধর মানব বাবু বসবাস করার কারনে বর্তমানে এই জমিদার বাড়িটি মানব বাবুর বাড়ি নামে পরিচিত। জমিদার বাড়ির কাছেই মানব বাবু মাছ চাষ করেন। আপনি চাইলে তার সাথেই মাছের খামার ঘুরে দেখতে পারবেন।

মানব বাবুর ভাষ্যমতে, তারা হলেন এদেশের সবচেয়ে ছোট জমিদার পরিবার। তারা হলেন ব্রাহ্মণ গোত্রীয় এবং তাদের পূর্বসূরীরা এখানে ভারত থেকে এসেছিল।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা জমিদার বাড়িটির ব্যপক ক্ষতিসাধন করে। বর্তমানে মানব বাবু এখানে তার স্ত্রী ও বোনকে নিয়ে বাস করছেন। মানব বাবু এবং তাঁর পরলোকগত কোন ভাইয়েরই কোন সন্তান নেই।

গাঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়ির সম্মুখভাগে রোমান স্থাপত্যের কলাম রয়েছে। সামনে থেকে এই জমিদার বাড়িটির স্থাপত্যশৈলী এক কথায় অসাধারণ। ছোট এই জমিদার বাড়িটি বিশাল এলাকার উপর অবস্থিত। জমিদার বাড়ির সম্মুখ দরজাটি নকশায় পরিপূর্ণ।

কারুকার্য ও নান্দনিক সৌন্দর্যের এই জমিদার বাড়িটি সেই সময়কার জাঁকজমকপূর্ণ অতীত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে এখনো স্বমহিমায় বিদ্যমান।

অর্জুন কর্মকার, কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি | বাংলাদেশদর্পণ.কম