মাণিক রক্ষিত |

আদিম যুগ থেকে মানুষের মন মৃত্যুর পরপারে কি আছে জানার জন্য কৌতুহলী। সে সহজে মেনে নিতে চায় না যে তার প্রিয়জনের মৃত্যুর পর আর তার অস্তিত্ব থাকবে না; মৃত্যু চিরতরে মায়ার বন্ধন ছিন্ন করবে। নিজের মৃত্যুর পর যে তার অবলুপ্তি ঘটবে, প্রিয়জনের সঙ্গে যে তার কোন সম্বন্ধ থাকবে না - একথা ভাবতেও কষ্ট হয়, মৃত্যুর সময়েও তার একান্ত বাসনা, সে তার প্রিয়জনদের মধ্যে যেন আবার ফিরে আসতে পারে। তাই আদিম যুগ থেকেই সে পরলোক ও পুনর্জন্ম, আত্মার অবিনশ্বরত্ব সম্বন্ধে অনেক কাহিনী রচনা করেছে।

পুনর্জন্ম বিষয়ে বিশ্বাস কেবল এশিয়ার কয়েকটা দেশে সীমাবদ্ধ নয়, মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার আদিবাসী যেমন বান্টু, র্যোবা, দ্যৌলা, হৌসা, লাম্বাদের মধ্যে ও আমেরিকার আলাস্কার তিলিঙ্গাইতদের মধ্যে, ব্রাজিলের পর্তুগীজদের মধ্যে আজও বিদ্যমান। প্রাক্খৃষ্টীয় ইউরোপের কোথাও কোথাও এই মতবাদ চালু ছিল। জুলিয়াস সিজার উল্লেখ করেছেন গলের পুরোহিত ড্রুইডরা পুনর্জন্মে বিশ্বাসী ছিলেন।

প্রাচীন ও গ্রীক ও রোমান দার্শনিকদের কয়েকজন, যেমন- ইমপেডোক্লিস, পিথাগোরাস, প্লেটো, ভারগিল, প্লাটিনাস এই মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। আধুনিক ইউরোপের কয়েকজন বিশিষ্ট মনীষী, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক যেমন- হুমে, গ্যেটে, লেসিং, সোপেনহাওয়ার, উইলিয়াম জেমস, এফ ডব্লিউ মায়ারস্, স্যর অলিভার লজ, হাক্সলি, সি ডি ব্রড, সি জে ডুকাসে এই জন্মান্তরবাদ গ্রহণযোগ্য মনে করেন।

কিন্তু বিশ্বাস এক কথা আর প্রমাণিত সত্য বলে গ্রহণ করা আর এক কথা। সারা বিশ্বে হাজার হাজার পুনর্জন্মের দৃষ্টান্ত পাওয়া গিয়েছে। যে ব্যক্তি পূর্বজন্মের কথা স্মরণ করতে পারে হিন্দুশাস্ত্রে তাকে ‘জাতিস্মর’ বলা হয়। বাংলাদেশেও একাধিক জাতিস্মরের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। তারই মাঝে অন্যতম একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করা হল।

Reincarnation. One day I was examining all paper… | by zenny RD | Medium

কেস স্টাডি-১

খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার পূর্ব বাজুয়া গ্রামে সুশান্ত শেখর মণ্ডলের শ্বশুর বাড়ি। তাঁর নিজের বাড়ি পাইকগাছার কুমখালী গ্রামে। স্ত্রী রোহিনী মণ্ডল। ২০০৪ সালের ২৭ জুলাই তাদের সন্তান অর্পণ মণ্ডল জন্মগ্রহণ করে। আড়াই বছরের মধ্যে যখন সে মুখ দিয়ে পুরোপুরি কথা বলতে শুরু করে, তখনই ‘চন্দনা’ বলে মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে উঠত। কিন্তু চন্দনা নামে সুশান্ত শেখরের পরিচিত কেউ ছিল না। এটা নিয়ে অর্পণকে অনেকবারই জিজ্ঞেস করা হয়, কে এই চন্দনা? কেন এই নাম ধরে মাঝে মাঝেই সে চেঁচিয়ে ওঠে? একদিন হঠাৎ করে অর্পণ বলতে শুরু করে, চন্দনা মণ্ডল তার পূর্বজন্মের স্ত্রী।

সুশান্ত মণ্ডল দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকাকে বলেন, ‘অর্পণ আমাদের জানায়, আগের জন্মে তার নাম ছিল রণজিত মণ্ডল। বাবা মৃত নগেণ মণ্ডল ও মা কদমবালা মণ্ডল। সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার বরদাল/নাড়ারাবাদ গ্রামে ছিল তাদের বাড়ি। আর্থিক অবস্থা ভাল না থাকায় পড়াশুনা করতে পারেনি। ছোটকাল থেকেই মাছের ব্যবসা করত। সাতক্ষীরা বামনডাঙা, নরেনাবাদ থেকে মাছ কিনে চাপড়া বাজারে মাছ বিক্রি করত। বিবাহিত জীবনে তার পুত্র সন্তানও হয়। ২০০৪ সালের শিবচতুর্দশী রাতে রাজেন, বিষ্ণু ও পরেশ নামে তিন ব্যক্তি তাকে জোরপূর্বক মোটর সাইকেলে তুলে জঙ্গলের ভেতর নিয়ে যায়। সেখানে তারা তাকে গলা কেটে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়। তখন তাঁর বয়স ছিল প্রায় ৩০ বছর।’

সুশান্ত মণ্ডল আরো জানান, অর্পণের মুখে এসব কথা শোনার পর তিনি নিজে এবং তার বাবা বঙ্কিম মণ্ডল আশাশুনি থানায় যোগাযোগ করেন। থানায় রণজিত মণ্ডল নিরুদ্দেশ বলে একটি ডায়েরি দেখা যায়। এরপর খুঁজে পাওয়া যায় চন্দনা মণ্ডল ও তার ছেলেকে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে হাজির হন অর্পণের পূর্বজন্মের মা কদমবালা দেবী (৬৫)। তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, ‘অর্পণের আচার-আচরণ, কথাবার্তা ও চালচলনের মধ্যে আমি রণজিতের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি। আমি অর্পণকে আমার ছেলে হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছি।’

বাংলাদেশের একাধিক জাতীয় দৈনিকের মাধ্যমে জানা যায়, অর্পণের কথিত পূর্বজন্মের স্ত্রী চন্দনা মণ্ডল বলেন, ‘২০০৪ সালের শিব চতুর্দশীর পূজার রাতে আমার স্বামী নিখোঁজ হয়। তারপর থেকে তার আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।’ তিনি আরও বলেন,‘ আমি রণজিত মণ্ডলের আচার-আচরণ সবই ওই ছোট্ট শিশুটির শধ্যে দেখতে পাচ্ছি। আমাদের জীবনের বহু ব্যক্তিগত ঘটনা ও বলে দিচ্ছে। তাই ওকে আমার স্বামী না ভেবে পারা যায়নি।’

সরেজমিনে জানা যায়, ২০০৮ সালে আশাশুনি উপজেলার নাড়ারাবাদ গ্রামের মাছ ব্যবসায়ী রণজিত মণ্ডল নিখোঁজ হয়েছিলেন। অদ্যাবধি তার কোন সন্ধান মেলেনি। ওই ঘটনায় তার স্ত্রী চন্দনা মণ্ডল বাদী হয়ে ৬ জনকে আসামি করে আশাশুনি থানায় মামলা করেছিলেন।

এদিকে এই ঘটনা প্রকাশ পাওয়ায় এই বিষ্ময় বালককে দেখতে শত শত মানুষের ভিড় লেগে যায় সুশান্ত মণ্ডলের বাড়িতে। বিগত ১৫ মে, ২০০৯ শুক্রবার সন্ধ্যায় ওই বাড়িতে আসে শিশুটির আগের জন্মের বন্ধু রাজেন মণ্ডল। সব মানুষের ভিড়ে শিশুটি রাজেন মণ্ডলকে দেখে বিচলিত হয়ে ওঠে। সে সবার সামনে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলে, এই সেই রাজেন যে আমাকে মেরেছিল। এই ঘটনায় রাজেন মণ্ডল তৎক্ষণাৎ পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু উপস্থিত জনতা তাকে ধরে ফেলে। পরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে।

Spiritualist Allan Kardec on Reincarnation, the Afterlife and Ghosts

কেস স্টাডি-২

সমগ্র ভাতরবর্ষে তথা বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানমুখী বিশ্বকে আলোড়িত করে জন্মান্তরবাদের চিন্তাধারাকে সঞ্জীবিত করে তুলেছিল এই ঘটনাটি। ১৯২৬ সালের ১১ ডিসেম্বর দিল্লীতে একটি মেয়ের জন্ম হয়েছিল। দিল্লীর চিরাখানা মহল্লার রঙবাহাদুর মাথুরের কন্যা; জাতিতে কায়স্থ। তার নাম ছিল শান্তি দেবী। জন্মের পর প্রথম ৩ বছর সে কোন কথাই বলেনি। কিন্তু সে যখন বলতে শুরু করে তখন তার প্রথম কথাগুলো খুব বিস্ময়কর ছিল। তিন বৎসর বয়স থেকেই সে বলতে শুরু করে পূর্বজন্মে সে জাতিতে চৌবান ছিল, নাম ছিল লুগদী, বাড়ি মথুরায়, বাড়ির রঙ হলদে ছিল। যদিও শান্তি এই জীবনে কখনও মথুরায় যায়নি, তবু বিস্ময়কর নিখুঁতভাবে সে মথুরা শহরের বর্ণনা করত। সে মথুরার বিশ্রামঘাট, হোলিদরওয়াজা ও তার উপর ঘড়ি, দ্বারিকাধীশের (শ্রীকৃষ্ণের) মন্দির, মন্দিরের সামনে তার স্বামীর কাপড়ের দোকানের কথা ও আত্মীয়কুটুম কারো কারো নামও বলত; কিন্তু স্বামীর নাম বলত না। আরও বলত যে তার দুই সন্তান ছিল, কন্যা ও পুত্র। পুত্রের প্রসবের ৯/১০ দিন পরে সে মারা যায়।

দুই বছর ধরে তার বাবা-মা তার কথা আজগুবি বলে উড়িয়ে দিয়েছিল। তারা তাকে ভুলিয়ে রাখবার চেষ্টা করতেন এবং বলতেন এতদিনে তোমার পূর্বজন্মের স্বামী মারা গেছেন। কিন্তু অবশেষে এক সময় তার মায়ের মনে হল, এত জীবন্ত বর্ণনাকে অগ্রাহ্য করা অসম্ভব।

কয়েক মাস পরে তাদের এক নিকটাত্মীয় স্কুলশিক্ষক বাবু বিষণচাঁদ তাদের বাড়ি আসেন। তিনি বালিকাটিকে বলেন, ‘তোমার স্বামীর নাম যদি আমাকে বল তাহলে তাঁর খোঁজ নিয়ে তোমাকে মথুরায় নিয়ে যেতে পারি।’ বালিকা তাঁর কানে কানে বলেন ‘কেদারনাথ চৌবে’। অবসরপ্রাপ্ত কলেজ প্রিন্সিপাল লালা কিষণচাঁদ এব্যাপারে শুনে মেয়েটিকে দেখতে আসেন। তার বিবরণ শুনে ও তার কাছ থেকে পূর্বজন্মের স্বামীর নাম-ঠিকানা নিয়ে তিনি কেদারনাথ চৌবেকে চিঠি দেন।

কেদারনাথ বিবরণগুলি সত্য বলে জানান এবং দিল্লীবাসী তাঁর এক জ্ঞাতিভ্রাতা পণ্ডিত কাঞ্জিমালকে ঘটনাটি যাচাই করে দেখার জন্য লেখেন। কাঞ্জিমালবাবু শান্তিদের বাড়ি এলে শান্তি তাঁকে দেখামাত্র জ্ঞাতিদেবর বলে সনাক্ত করে। নানা প্রশ্নের উত্তরে কাঞ্জিমালবাবু নিঃসন্দেহ হন যে, এই বালিকাই পূর্বজন্মে তাঁর জ্ঞাতিভ্রাতা কেদারনাথ চৌবের পত্নী লুগদী দেবী ছিলেন এবং চিঠি না দিয়ে নিজেই মথুরায় গিয়ে চৌবেজীকে সব কথা জানান। ১২ই নভেম্বর ১৯৩৫ সাল, তখন শান্তির বয়স প্রায় ৯ বছর, কেদারনাথ চৌবে, তার বর্তমান স্ত্রী ও লুগদী দেবীর ১০ বছরের পুত্র নবনীতলালকে নিয়ে কাঞ্জিমালবাবুর বাসায় উঠলেন এবং পরদিন রঙবাহাদুর মাথুরের বাড়ি উপস্থিত হলেন। তিনি নিজের পরিচয় বড় ভাই বাবুরাম চৌবে বলে জানালেন।

শান্তি স্কুলে গিয়েছিল। তাকে ডেকে আনা হল। সে কেদারনাথকে দেখে মাথা নত করে ঘরের একপাশে দাঁড়াল। ‘ইনি তোমার ভাসুর হন, এঁকে প্রণাম কর’ বলাতে শান্তি বলেন, ‘না, ইনিই আমার স্বামী। এঁর কথা অনেকবার আপনাদের বলেছি।’ সে পকেট হতে পয়সা বের করে চাকরকে পান আনতে দিল এবং পান আনা হলে একটি পান কেদারনাথ চৌবেকে ও আর একটি নবনীতলালকে দিল। পুত্র নবনীতলালকে দেখেই তাকে বুকে চেপে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

উপস্থিত অনেকে তাকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি যখন মারা যাও, এ তখন মাত্র ৯/১০ দিনের শিশু। একে তুমি কেমন করে চিনলে? শান্তি উত্তর দেয়, ‘এ আমার প্রাণ, প্রাণই প্রাণকে চিনে নিয়েছে।’ সে দৌড়ে গিয়ে নিজের সব খেলনা এনে ছেলেকে দেয়।

শান্তির বাবা-মার অনুরোধে চৌবেজী পুত্রসহ সেরাত্রি তাদের বাড়িতেই থেকে যান। শান্তির মাতা রামপ্যারী দেবী তাদের জন্য কি কি খাবার তৈরী করা হবে মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলে শান্তি বলে চৌবেজী ‘ভরে’ (আলুর তরকারি), কাশীফলের শাক ও পরমেঠা (পরোটা) পছন্দ করেন। আহারে বসে চৌবেজী রামপ্যারী দেবীকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি এসব কেন তৈরি করলেন? শান্তির মা তাঁকে জানাল শান্তি বলেছে এগুলি তাঁর প্রিয়। চৌবেজী স্বীকার করেন একথা সত্য।

চৌবেজী শান্তির সঙ্গে অনেক রাত পর্যন্ত আলাপ করেন এবং তাকে অনেকগুলি প্রশ্ন করেন। বাড়ির বর্ণনা প্রসঙ্গে শান্তি তাঁকে বলেন, বাড়ির আঙিনায় এক কোণে একটি কূয়া ছিল, সেখানে সে বসে স্বান করত। বাড়ির একটি ঘরে এক কোণে সে কিছু টাকা পুঁতে রেখেছিল। চৌবেজী বলেন, ‘তুমি এমন কিছু বল যা লুগদী দেবী ও আমি ছাড়া অন্য কেউ জানত না।’ তখন শান্তি বলে, ‘হাসপাতালে আমার সেবার জন্য একটি মেয়ে নার্স ছিল তার ঘটনাটা মনে আছে?’ চৌবেজী নীরবে মাথা হেলিয়ে স্বীকার করেন। তিনি শান্তিকে আরও জিজ্ঞাসা করেন, ‘আচ্ছা বাত রোগে লুগদী দেবী এত অসুস্থ ছিলেন যে তিনি পা দুটি সোজা করতে পারতেন না, বসে বসে চলতেন। এরকম অবস্থায় তিনি কিভাবে সন্তানসম্ভবা হন?’ শান্তি সঠিক বর্ণনা দিয়েছিল। তখন কেদারনাথ চৌবে নিঃসন্দেহ হন যে শান্তিই পুনর্জাতা লুগদী দেবী।

গোড়ার দিকে শান্তি তার দুটি সন্তান ছিল বলত। অনুসন্ধানে জানা যায় লুগদী দেবী প্রথমে একটি মৃতসন্তান প্রসব করে। দ্বিতীয় সন্তান নবনীতলাল। শান্তি বলত, তার স্বামীর বাম গালে একটা বড় আঁচিল আছে। চৌবেজী এলে শান্তি তার বাবা-মাকে সেটি দেখিয়ে বলে, দেখ আমার কথা ঠিক কিনা। বর্তমান স্ত্রীর গায়ের গহনার মধ্যে কোন-কোনটি পূর্বজন্মে তার ছিল তাও শান্তি চৌবেজীকে ঠিক ঠিক দেখিয়ে দেয়। দুদিন পরে চৌবেজী স্ত্রীপুত্রসহ যখন মথুরা ফিরবেন, শান্তি তাদের সঙ্গে যেতে চায়। তাকে কোনরকমে ভুলিয়ে সিনেমায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপর শান্তির মথুরা যাবার ইচ্ছা পূর্বের চেয়েও প্রবল হয়।

This is what happens at death .. A doctor reveals secrets about the exit of  the soul | Eg24 News

সরকারি তদন্ত কমিশন গঠন:

তখন ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলছিল। হিন্দু-মুসলিম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। মহাত্মা গান্ধী তখন একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজছিলেন। কিন্তু শান্তির পুনর্জন্মের ঘটনা সংঘর্ষকে আরও উস্কে দেয়। মুসলমানরা এটিকে হিন্দু ধর্ম প্রচারের একটা কৌশল হিসাবে অভিহিত করে। ১৯৩৫ সালে গান্ধীজী শান্তি দেবীকে তলব করেন। এমনকি ৬২ বছর বয়সেও শান্তিদেবী স্মরণ করে বলেন, যখন তিনি গান্ধীজীর কোলে বসেছিলেন, তিনি গান্ধীর অস্থির স্পর্শ অনুভব করেছিলেন। ১৯৩৫ সালে শান্তির ঘটনা একটি জাতীয় আলোড়ন সৃষ্টি করলে গান্ধী ঘটনা তদন্তের জন্য একটি কমিশন গঠন করেন। রাজনীতিবিদ, বিজ্ঞানী ও সাংবাদিকসহ ১৫ জন বিশিষ্ট নাগরিকের সমন্বয়ে এই কমিশন গঠিত হয়। ‘তেজ’ পত্রিকার সম্পাদক ও ভারতীয় আইনসভার সভ্য লালা দেশবন্ধু গুপ্ত, জাতীয়তাবাদী নেতা পণ্ডিত নেকীরাম শর্মা, বিখ্যাত এ্যাডভোকেট শ্রীতারাচাঁদ মাথুর প্রমুখ এই কমিটিতে ছিলেন। এই কমিটির একটি বিবৃতিতে বৈজ্ঞানিক ও সংশয়বাদী মুসলমান ও খৃস্টান সুধীবৃন্দকে এই কেসটি পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষরূপে অনুসন্ধান করে তাদের মতামত প্রকাশের জন্য আহ্বান করা হয়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তেমন কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। হয়ত এই অকাট্য সত্যের আলোতে তারা নিজেদের অসহায় প্রতিপন্ন করতে চায়নি।

অতঃপর কমিশন শান্তিকে মথুরায় নিয়ে গিয়ে সরেজমিনে তদন্ত করবার সিদ্ধান্ত নিলেন। শান্তি ইতিপূর্বে কখনও দিল্লীর বাইরে যায়নি। লালা দেশবন্ধু গুপ্ত, পণ্ডিত নেকীরাম শর্মা প্রমুখ ১৫ জন দিল্লীর বিশিষ্ট নাগরিক ২৪ নভেম্বর ১৯৩৫, শান্তি ও তার পিতামাতাকে সঙ্গে নিয়ে মথুরা রওনা হলেন। মথুরা পৌঁছবার প্রাক্কালে শান্তি মথুরাবাসীর ভাষায় বলে উঠল, তারা যে সময় মথুরা পৌঁছবে ‘মন্দির কী পট বন্ধ হো জায়েগা’ (মন্দিরের দ্বার বন্ধ হয়ে যাবে)। তখন তার চোখমুখে আনন্দের ভাব ফুটে উঠেছিল। ট্রেন স্টেশনের কাছাকাছি এসে গেলে সে চারিদিকে চেয়ে উত্তেজিতভাবে বলে উঠল, ‘মথুরা আগয়ী, মথুরা আগয়ী’। স্টেশনে বিরাট জনসমাবেশ হয়েছিল, ট্রেন থেকে নেমে শান্তি লালা দেশবন্ধু গুপ্তের কোলে ছিল, ভিড়ের মধ্যে থেকে বিরাট লাঠি হাতে পাগড়ীধারী এক পরিণতবয়স্ক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে শান্তিকে জিজ্ঞাসা করলেন সে তাকে চিনতে পারে কিনা। দেশবন্ধু গুপ্তের কোল থেকে নেমে শান্তি তাঁর পায়ে প্রণাম করল এবং বলল ইনি আমার ‘জেঠ’ (ভাসুর), সত্যই তিনি কেদারনাথ চৌবের জ্যেষ্ঠভ্রাতা বাবুরাম চৌবে।

অতঃপর শান্তি সত্যই মথুরার পথঘাট চেনে কিনা পরীক্ষা করার জন্য তাকে এক মুসলমান টোঙাওয়ালার টোঙায় চড়িয়ে দেওয়া হল এবং টোঙাওয়ালাকে বলা হল মেয়েটি যেমন যেমন পথ দেখাবে টোঙাওয়ালা সেই সেই দিকে যাবে। আর সকলে গাড়িতে, পদব্রজে এই টোঙার পিছু পিছু চলতে লাগল। শান্তির নির্দেশমত টোঙাওয়ালা টোঙা চালাতে লাগল। পরে কমিটির সভ্যগণ এই টোঙাওয়ালাকে দিয়ে তার এক বিবৃতি লিখিয়ে নেন। হোলিদরওয়াজার কাছাকাছি পৌঁছলে শান্তি উৎফুল্লভাবে বলে উঠল, ‘ঐ দেখ হোলিদরওয়াজা দেখা যাচ্ছে, আমি বলেছিলাম দরওয়াজার মাথায় ঘড়ি আছে। ঐ দেখ ঘড়ি।’ তার কোন্ দিকে তার স্বামীর বাড়ি যেতে হবে তা সে দেখিয়ে দিল এবং রাস্তার দুপাশের অট্টালিকার পরিচয় দিতে লাগল। সে আরও মন্তব্য করে, এই রাস্তা আগে পিচঢালা ছিল না। এও সত্য। টোঙা দুটি গলির সংযোগস্থলে পৌঁছলে শান্তি টোঙা হতে নেমে একটি গলির ভিতর চলল, আর আর সকলে তার পিছু পিছু যেতে লাগল।

কিছুদূর যাবার পর গলির ভিতর বিপরীত দিক থেকে এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণকে আসতে দেখে সে তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল এবং বলল, ইনি আমার শ্বশুর। সত্যই তিনি কেদারনাথ চৌবের ৭৫ বছর বয়স্ক বৃদ্ধ পিতা মহাদেব চৌবে। অল্প পরেই সে তার পূর্বজন্মের স্বামীর গৃহের সামনে এসে উপস্থিত হল। বাড়ির রঙ সে পিলা (হলদে) বলত। এখন রঙ পাল্টানো হয়েছে। উপস্থিত সকলেই স্বীকার করল বাড়ির রঙ আগে হলদে ছিল। শান্তি বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে পরিচিতের ন্যায় এঘর ওঘর ছুটোছুটি করে করে দেখাতে লাগল কোন্ ঘরে সে শয়ন করত, কোন্ ঘরে তার বাক্স, কাপড়চোপড় থাকত, কোন ঘরে রান্না হত।

পাড়ার উকিল এক ভদ্রলোক দ্বারকানাথজী তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘জাজুরীখানা’ কোথায়? সঙ্গে সঙ্গে নীচে নেমে এসে পায়খানা দেখিয়ে দিল। আর একজন জিজ্ঞাসা করল ‘কটোরা’ কি বলতে পার? শান্তি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল ‘পরামটে’ (পরোটা)। এ দুই শব্দ দিল্লীবাসীদের অজ্ঞাত ও দুর্বোধ্য। এই বাড়িটি তখন ভাড়া দেওয়া হয়েছে। শান্তি শ্রান্ত হয়ে পড়ায় পিতামাতা ও দলবলসহ তাকে নিকটবর্তী জবলপুরী ধর্মশালায় বিশ্রামের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সে সকমবেত জনতার মধ্যে একটি যুবককে তা পূর্বজন্মের ভাই ও একটি মধ্যবয়স্ক লোককে তার খুড়শ্বশুর বনমালি চৌবে বলে ঠিক ঠিক সনাক্ত করে। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর শান্তি দলের একজনের কাঁধে চড়ে তার পূর্বজীবনের দ্বিতীয় বাড়ি যেখানে সে শেষজীবন স্বামীর সঙ্গে অতিবাহিত করে, দেখাবার জন্য পথ দেখিয়ে নগরা পইসা মহল্লার এক বাড়ির সামনে গেল।

সেই বাড়িতে প্রবেশ করে আঙিনার এক কোণ দেখিয়ে বলল, এখানে একটি কুয়া ছিল। আমি ¯œান করতাম। পাথর সরিয়ে দেখা গেল সেখানে এক কুয়া ছিল। সিঁড়ি দিয়ে একটি ঘরে প্রবেশ করে বলল, এই ঘরে আমি শয়ন করতাম এবং ঘরের চারিদিক দেখে একটি জায়গা দেখিয়ে বলল, এখানে আমার টাকা পোতা আছে। সেখানে খুঁড়ে একটা কৌটা পাওয়া গেল, সেটা শূন্য দেখে সে আশ্চর্য হয়ে বলল, আমি নিশ্চয় টাকা রেখেছিলাম, কেউ তুলে নিয়েছে। তখন কেদারনাথ চৌবে স্বীকার করলেন লুগদী দেবীর মৃত্যুর পর তিনি ঐ টাকা তুলে নিয়েছিলেন। তারপর শান্তি যমুনা নদীতে স্বান করতে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করে এবং নীচের ঘরে বাক্সে রাখা তার কাপড় স্নানের জন্য নিতে বললে তা করা হয়। নদীর পথে যেতে যেতে একটি বাড়ির সামনে এসে সেই বাড়ির ভিতর যেতে চায়। জিজ্ঞাসা করারয় সে বলে, এটি তার পূর্বজীবনের পিতামাতার বাড়ি। মথুরা আসার আগে পর্যন্ত সে পিতামাতার কথা কিছু বলেনি। বাড়িটি দেখে হঠাৎ তাদের স্মৃতি জেগে ওঠে। বাড়ির ভিতরে সে সমবেত বহুলোকের মধ্যে তার পিতা চতুর্ভূজ চৌবে ও মাতা জগতী দেবীকে সনাক্ত করে এবং জগতি দেবীর কোলে উঠে পড়ে। পূর্বজীবনের পিতামাতা উভয়েই তাকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে। তাদের কাছ থেকে শান্তিকে নিয়ে আসতে বেগ পেতে হয়। মাকে সে জিজ্ঞাসা করে, তার পুত্র ভ’মিষ্ঠ হবার দিন তাম মা যে দ্বারিকাধীশকে সওয়া মণ পেঁড়া ভোগ দেবার মানত করেছিল তা দেওয়া হয়েছিল কিনা। দেওয়া হয়নি শুনে সে মাকে তা দিয়ে দিতে বলে এবং পরে তা দিয়ে দেওয়া হয়।

নদীর তীরে প্রথমে সে স্বামীঘাট দেখিয়ে বলল, এখানে পাণ্ডারা যাত্রীদের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। একথা ঠিক। সে পূর্বজীবনে বিশ্রামঘাটে স্বান করত। সেখানে এসে সে পরম সন্তোষ প্রকাশ করল এবং নিজের গলার মালা থেকে ফুল ছিড়ে ছিড়ে যমুনার পূজা করল এবং হাতজোড় করে প্রণাম করল। সেখান থেকে দ্বারিকাধীশের মন্দিরে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করায় তাকে অসকুণ্ডা বাজারে নিয়ে যাওয়া হল। দূর হতে সে ঐ মন্দির দেখিয়েছিল কিন্তু এই মন্দিরের দ্বারে প্রণাম করল না। ঠিক বিপরীত দিকে সে কেদার চৌবের দোকান দেখিয়ে দিল। গলির মধ্যে অপর একটি ছোট মন্দিরে সে প্রণাম করল ও বলল, এখানে সে প্রায়ই পূজা দিত। প্রবল জনতার চাপে ক্রমে বালকাকে নিয়ে ঘোরাফেরা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠল। বিকালে কিশোরীরমন উচ্চ ইংরাজি বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি জনসভা ডাকা হয়েছিল। বালিকাকে কোনক্রমে সেখানে নিয়ে যাওয়া হল। পণ্ডিত নেকীরাম শর্মা এই সভায় ভাষণ দেন। সভা শেষে শান্তিসহ দলবল সন্ধ্যার ট্রেনে দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করেন।

What The Ancients Say About Life, Death & Reincarnation | Dr. Rita Louise

তদন্তের ফলাফল:

দিল্লী ফিরে কমিটির সভ্যগণ শান্তির পূর্বজীবনের স্মৃতি ও মথুরার ভ্রমণবৃত্তান্ত সম্বলিত একটি প্রতিবেদন পুস্তক আকারে প্রকাশ করেন। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল- A Case of Reincarnation.

তাদের রিপোর্টের শেষে মন্তব্য করা হয়- ‘যদি ধর্ম ও বিজ্ঞান একই সাধারণ ভিত্তিতে মিলিত হয়, তাহলেই জন্মান্তরবাদের রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব। এটি সমগ্র মানবজাতির জন্য একটি গুরূত্বপূর্ণ ব্যাপার। আমরা সমস্ত বিজ্ঞানীদের অনুরোধ করছি তারা যেন আমাদের সত্যানুসন্ধানে সাহায্য করেন।’

ড. রাওয়াত হলেন ভারতের অন্যতম জন্মান্তরবাদ বিশেষজ্ঞ। তিনি তার জীবনের এক বড় অংশ ব্যয় করেছেন শান্তিদেবীর ঘটনার তদন্ত কাজে। তিনি শান্তির সাথে কেদারনাথের প্রথম সাক্ষাত সম্পর্কে ডিসকভারি চ্যানেলকে বলেন, ‘যখন কেদারনাথ প্রথমবারের মত দিল্লীতে আসেন তখন বহু উৎসুক জনতা জমা হয়েছিল। সেখানে উৎসুক জনতারাও জানতে চাচ্ছিল, শান্তি ঠিক বলছে নাকি আবোল-তাবোল বলছে। কিন্তু সকালবেলা যখন কেদারনাথ স্পষ্টভাবে সর্বসমক্ষে ঘোষণা করলেন যে, ‘আমি একশতভাগ নিশ্চিত যে শান্তিই আমার মৃতা স্ত্রী লুগদী।’ তখন সমস্ত ঘটনা দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল। প্রতিদিন শত শত মানুষ শিশুটিকে দেখতে আসত।’

ডক্টর স্টিভেনসনও এই কেসটির তথ্যানুসন্ধান ও সমীক্ষা করেছেন এবং এই কেসটির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছেন, The Evidence for Survival from Claimed Memories of Former Incarnations নামক প্রবন্ধে যা Journal of the American Society for Physical Research -এর ৬ষ্ঠ সংখ্যায় ১৯৬০ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয়।

চলবে...

 

লেখক: মাণিক রক্ষিত