ঢাকা:সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, সেসব ঘটনায় পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ। পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল কুমার চ্যাটার্জি বলছেন, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে যত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তার একটিরও সুষ্ঠু বিচার হয়নি। কোনো ঘটনা ঘটার পর দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর পাল্টাপাল্টি দোষারোপের সংস্কৃতি পরিস্থিতি আরও নাজুক করে।

শারদীয় দুর্গাপূজায় কুমিল্লা, নোয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন মণ্ডপে হামলার পর শুক্রবার সকালে রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সংবাদ সম্মেলন করে পূজা উদযাপন পরিষদ। 

লিখিত বক্তব্যে নির্মল চ্যাটার্জি বলেন, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা ও হামলা পরবর্তী সময়ে স্থানীয় প্রশাসন সময়োযোগী পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে।

‘দুর্গাপূজার মধ্যে গত ১৩ অক্টোবর ভোরে নানুয়া দীঘির পাড়ে দর্পন সংঘের পূজামণ্ডপে হনুমানের মূর্তির কোলে মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআন রাখা দেখে এলাকায় উত্তেজনা ছড়ায়। হামলা, ভাংচুর চালানো হয় অন্তত আটটি মন্দিরে। তার জের ধরে সেদিনই চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে মন্দিরে হামলা হয়, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হয় পাঁচজন। এর পরের কয়েকদিনে নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ কয়েকটি জেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়। তাতে নোয়াখালীতে নিহত হয় দুজন।’

সংবাদ সম্মেলনে নির্মল চ্যাটার্জি বলেন, কুমিল্লা নানুয়া দীঘিরপাড়ের মণ্ডপটি অস্থায়ী। ঘটনার রাতে মণ্ডপে মাত্র একজন পাহারায় ছিল। রাত ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য মণ্ডপ এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আমাদের প্রশ্ন, কী কারণে কিছু সময়ের জন্য বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, সেই বিষয়গুলো তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে কি?... থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হনুমান মূর্তির কোলের ওপর রাখা পবিত্র কুরআন শরীফটি সরিয়ে নেওয়ার পর কেন ভিডিও করার সুযোগ করে দিলেন? কেন সে ভিডিও ভাইরাল হয়েছে তা সবার কাছে বিরাট প্রশ্ন?

নির্মল চ্যাটার্জি বলেন, নোয়াখালীর চৌমুহনীতে বেলা ১১টার মধ্যে সকল পূজা মণ্ডপেপ্রতিমা বিসর্জন সম্পন্ন হওয়ার পরও যখন হামলা শুরু হয়, তখন পুলিশ ও প্রশাসনের কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের কোনো পর্যায়ের দায়িত্ব পালনে গাফলতি আছে কিনা তা অবিলম্বে চিহ্নিত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

বিচারহীনতা বা বিচার না হওয়ার সংস্কৃতি দুষ্কৃতকারীদের ‘উৎসাহিত করছে’ এবং প্রায়ই তারা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক। 

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা নিয়ে পরে আওয়ামী লীগের সময়ে তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। সেই কমিশনের রিপোর্টের আলোকে একজনেরও বিচার হয়েছে বলে দৃশ্যমান না।

রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকার সমালোচনা করে নির্মল চ্যাটার্জি বলেন, কোনো একটি ঘটনা ঘটলে রাজনৈতিক দলসমূহের পারস্পরিক দোষারোপ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রধান হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক দলসমূহের পারস্পরিক দোষারোপের কারণে প্রকৃত দোষীরাও পার পেয়ে যাচ্ছে, যা দেশের আইনশৃঙ্খলা ও পারস্পরিক আস্থার জন্য সুখকর নয়।

সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার হয়ে গত ৫০ বছরে ‘উল্লেখযোগ্য সংখ্যক’ হিন্দু দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, যারা এখনো দেশকে ভালোবেসে মাতৃভূমিতে থাকতে চাইছেন বা আছেন, তারাও পর্যায়ক্রমে সহিংসতার শিকার হয়ে আস্থার সংকটে পড়েছেন। ভবিষ্যৎ বলে দেবে তারা কতদিন দেশে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারেন।

সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি মিলন কান্তি দত্ত। তিনি বলেন, আমাদের অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু সেগুলো রক্ষা করা হয় না। এ সময় অন্যদের মধ্যে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাবেক সভাপতি কাজল দেবনাথ, পূজা উদযাপন পরিষদের উপদেষ্টা জয়ন্ত সেন, মহানগরের উদযাপন পরিষদের মহানগর কমিটির সভাপতি শৈলেন মজুমদার, সাধারণ সম্পাদক কিশোর মণ্ডল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।


প্রতিবেদক, বাংলাদেশ দর্পণ