আজ জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথি; অর্থাৎ শুভ অরণ্যষষ্ঠী। এটি জামাইষষ্ঠী নামেই বহুল পরিচিত। এই তিথিতে মা ষষ্ঠীর ব্রত পালন করা হয় সন্তান প্রাপ্তি ও সন্তানের মঙ্গল কামনায়।
বাঙালি হিন্দুসমাজে অনেকগুলি ষষ্ঠী ব্রত পালন করতে দেখা যায়। যেমন- মূলা ষষ্ঠী, অশোকা ষষ্ঠী, লুণ্ঠন ষষ্ঠী, পাটাই ষষ্ঠী, দুর্গা ষষ্ঠী। জ্যৈষ্ঠ মাসের অরণ্যষষ্ঠী সেগুলির একটি। সন্তানের দীর্ঘায়ু ও রোগ-শোকহীন জীবন প্রাপ্তির আশায় মায়েরা এই ব্রত করেন। যদিও এই অরণ্যষষ্ঠী জামাইদের কোন অনুষ্ঠান নয় তবু কালক্রমে এটি জামাইষষ্ঠী নাম ধারণ করেছে।
প্রাচীনকালে মেয়েরা বিয়ের পর খুব সহজে পিতার বাড়িতে আসতে পারত না। আসতে হলে বরের কিংবা বরের পরিবারের অনুমতি নিতে হত। তাছাড়া দূরের পথ এবং অর্থনৈতিক অবস্থার কারণেও ইচ্ছা করলেই যখন-তখন পিতৃগৃহে যেতে পারত না কন্যারা। কিন্তু জ্যৈষ্ঠ মাসে যখন মায়েরা সন্তানের মঙ্গল কামনায় ষষ্ঠীব্রত পালন করে সন্তানকে অনেক উপাচারে দূর্বার আঁটি বেঁধে আশির্বাদ করবেন তা থেকে বিবাহিতা কন্যাসন্তানরা কীরূপে বাদ পড়তে পারে! তাই তখন বিবাহিতা কন্যাসন্তানকে বাবার বাড়িতে আনার জন্য মেয়ের সাথে মেয়ের জামাইকেও আমন্ত্রণ জানাতেন। আর মেয়ে যখন জামাইসমেত আসতো তখন নিজ ছেলে-মেয়ের সাথে মেয়ের জামাইকেও ষষ্ঠীর আশীর্বাদ করতেন মায়েরা। কিন্তু বাড়িতে জামাই এলে জামাইকে মনের মতো করে আপ্যায়ণ না করলে কি হয়! আর জামাইকে যত বেশি আদর আপ্যায়ণ করা হবে মেয়ে তো ততই সুখে থাকবে। তাইতো ষষ্ঠীর দিনে ঘরে ঘরে মেয়ে ও মেয়েজামাইদের আগমনে উৎসবের আবহ লেগে যেত। আর এই আবহেই অরণ্যষষ্ঠী কালক্রমে হয়ে উঠলো জামাইষষ্ঠী।
আরও পড়ুন: নেপালের যশস্বী রাজা বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব
মা ষষ্ঠীর বাহন বিড়াল। বিড়াল এর জীবনের দিকে লক্ষ্য রাখলে আমরা দেখি সে তার ছানাগুলোকে বড় যত্নে লালন পালন করে, এমনকি নিজের জিহ্বা দিয়ে চেটে সন্তানের শরীর পরিষ্কার করে, দুগ্ধ প্রদান করে। শিশুর জন্মদাত্রী মাও তার সন্তানকে ঠিক একইভাবে অনেক আদর-যত্নে লালন পালন করেন। তাই ষষ্ঠী মায়ের বাহন বিড়াল। কিন্তু এই দেবীর নাম ষষ্ঠী কেন? শুধু যে ষষ্ঠী তিথিতে পূজা হয় সেটাই একমাত্র কারণ নয়।
দেবীভাগবত পুরানে নবম স্কন্ধের একটি শ্লোকে বলা হয়েছে-
“ষষ্ঠাংশা প্রকৃতের্যে চ সা চ ষষ্ঠী প্রকীর্তিতা বালকানামধিষ্ঠাত্রী বিষ্ণুমায়া চ বালদা।”
অর্থাৎ - বালকগণের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, বালকদায়িনী বিষ্ণুমায়া প্রকৃতির ষষ্ঠকলা, এই জন্য ষষ্ঠী নামে এই দেবী কীর্তিত হয়েছেন।
মহাভারতের সভাপর্বে এক ষষ্ঠী দেবীর নাম উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি ব্রহ্মার সভায় বিরাজিতা থাকেন। দেবীভাগবত পুরাণ মতে, প্রিয়ব্রত নামক এক রাজাকে দিয়েই দেবী ষষ্ঠীর পূজা আরম্ভ হয়। বস্তুত মাতা ষষ্ঠী ভগবতী মহামায়ারই একটি প্রকাশ। মহামায়া ভিন্ন ভিন্ন রূপে যেমন অসুর দলন করেন, তেমনি এই সৃষ্টি পরিচালনাও করেন। তাই তো তিনি আদতে এক হয়েও বহুরূপে বিরাজিতা। কারণ সকল দেবীই মহামায়ার প্রকাশ। দক্ষিণ ভারতে দেবী ষষ্ঠী কার্তিকেয়র ধর্মপত্নী রূপে পূজিতা, দেবী ভাগবত মহাপুরাণে তাকে দেবসেনা নামে উল্লেখ করা হয়েছে।
দেবী ষষ্ঠীর ধ্যান:
ওঁ গৌরাভাং দ্বিভুজাং ষষ্ঠীং নানালঙ্কার - ভূষিতাম।
সর্বলক্ষণ - সম্পনাং পিনোন্নতপয়োধরাম।।
দিব্যাবস্ত্রপরিধানাং বামক্রোড়ে সপুত্রিকাম।
প্রসন্নবদনাং ধ্যায়ে জগৎধাত্রীং সুখপ্রাদাম।।
অর্থাৎ, দেবী ষষ্ঠীর ধ্যান মন্ত্র অনুযায়ী- তিনি দ্বিভুজা, বরাভয়দায়িনী, গৌরবর্ণা, নানালঙ্কারভূষিতা, স্তনযুগল পরিপূর্ণ, দিব্যবসন পরিহিতা, নিত্যা, জগদ্ধাত্রী, সন্তানপ্রদা, সর্ব সুলক্ষণসম্পন্না। সকল মাতৃত্বের গুণ নিয়েই মা ষষ্ঠী আবির্ভূতা। মা ষষ্ঠী বামক্রোড়ে পুত্র ধারন করে থাকেন যা মাতৃত্বের পরিচায়ক।
মায়ের প্রণাম মন্ত্র:
জয় দেবী জগন্মাত জগতানন্দকারীনী।
প্রসীদ মম কল্যাণী নমস্তে ষষ্ঠী দেবীতে।।
অর্থাৎ হে দেবী! তুমি জগন্মাতা, জগৎকে আনন্দদায়িনী। তোমার জয় হউক। তুমি কল্যাণী নামে সুপ্রসিদ্ধা। হে মাতা ষষ্ঠী দেবী! তোমায় প্রণাম।
অর্জুন কর্মকার, নিজস্ব প্রতিবেদক | বাংলাদেশদর্পণ.কম