আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথিকে বলা হয় গুরু পূর্ণিমা। এদিনেই আদিযোগী শিব গুরুরূপে আত্মপ্রকাশ করে সপ্তঋষিকে জ্ঞানপ্রদান করেছিলেন। মহান বেদসংকলক ও মহাভারতের রচয়িতা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেব এই তিথিতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাই গুরু পূর্ণিমাকে ব্যাস পূর্ণিমাও বলা হয়।
হাজার হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষে এদিনে গুরুদেবের পূজা করা হয়। আধুনিক যুগে যেমন শিক্ষকদের শ্রদ্ধা জানিয়ে শিক্ষক দিবস পালন করা হয়, অনেকটা তেমনই। তবে এদিনের তাৎপর্য আরও অনেক বেশি।
১৫,০০০ বছর আগে আদি-যোগী রূপে শিব সপ্ত-ঋষিদের দক্ষিণমুখি হয়ে, যোগ-বিজ্ঞানের শিক্ষাপ্রদান শুরু করেছিলেন আজকের এই পূর্ণিমার তিথিতে। সপ্ত-ঋষিগণ চুঁরাশি বছর ধরে সাধনা করছিলেন । পৃথিবী যখন তাঁর গতিপথ বদলে উত্তরায়ন-দক্ষিণায়নে আসে তখন আদি-যোগী শিব তাঁদের দিকে তাকিয়ে দেখেন ঋষিগণ উজ্জ্বল দীপ্তিশীল আধার হয়ে উঠেছে। শিব তাঁদের অবস্থা দেখে উপেক্ষা করতে না পেরে সিদ্ধান্ত নেন পূর্ণিমা তিথি থেকে তাঁদের গুরু হবেন এবং আজকের এই পূর্নিমার দিনে শিক্ষাপ্রদান শুরু করেছিলেন। এই দিনটিতে গুরু হিসেবে শিব নিজেকে রূপান্তরিত করলেন, আদি-যোগীতে রূপান্তরিত হলেন, সেই থেকে এই পূর্ণিমার দিনটিকে গুরু পূর্ণিমা হিসেবে উদযাপন করা হয়।
যোগ-বিজ্ঞান মানে অনেক অঙ্গ-ভঙ্গিতে আসন দেখানো নয়। যোগ হচ্ছে মানবতন্ত্রকে জানার বিজ্ঞান। বিশ্ব ব্রক্ষান্ডের সকল অস্তিত্ব বোঝা ও উপলব্ধি করার বিজ্ঞান যা শিখিয়েছেন আদি-যোগী শিব। সৃষ্টির এক টুকরো হিসেবে সৃষ্টিতেই ফিরে যাওয়া এবং সৃষ্টির সাথে এক হয়ে যাওয়ার পাকা পথ তৈরি করে দিয়েছেন আদি-যোগী। যোগশাস্ত্রে উল্লেখ শিব বলেছেন, “তুমি যদি এই রাস্তায় চলতে থাকো তাহলে শেষপর্যন্ত গিয়ে তোমার আর সৃষ্টিকর্তার মধ্যে কোনও তফাৎ থাকবে না।“ সফরটা এটাই – সৃষ্টি থেকে সৃষ্টিকর্তা পর্যন্ত। শিব এক বিজ্ঞানের, এক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির যা কিনা সেই পরিধিগুলোকে মুছে ফেলতে পারে যেগুলো প্রকৃতি আপনার ওপর চাপিয়ে দিয়েছে।
জীবন পূর্ব-নির্দিষ্ট নয় এই দিনে মানুষকে এটা মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। নিজের সম্পূর্ণ ইচ্ছা ও পূর্ণ উদ্যমের প্রচেষ্টা করলে, সৃষ্টির সকল দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত। প্রয়োজনে নিজেকে রক্ষার জন্য চারপাশে বলয় সৃষ্টি করা এবং প্রয়োজন ফুরোলে সহজেই সেটাকে ত্যাগ করা শিখিয়েছেন আদি-যোগী।
প্রত্যেকটি পূর্ণিমা ও অমাবস্যাই পালন করা উচিত। শুধু গুরু পূর্ণিমা পালন করা আর বিপদে পরে একদিন মন্দিরে যাওয়ার মত ব্যাপার। প্রতিদিন পূজা করার মতই সকল পূর্ণিমা ও অমাবস্যাই পালন করা উচিত।
এই দিনটির গুরুত্ব সম্বন্ধে বেশীরভাগ মানুষই অবগত নন – যে ধর্মের যাবতীয় ধারনা আদি-যোগী স্থাপন করে গেছেন যে একটা মানুষের পক্ষে তার বর্তমান অস্তিত্বকে অতিক্রম করে অস্তিত্বের এক সম্পূর্ণ অন্য মাত্রায় পৌঁছনো সম্ভব তা অনেকেই অবগত নন এবং এই মহান জ্ঞান আজকের দিনেই দেওয়া হয়েছিল।
আদিযোগীর উদ্দেশ্য এটাই ছিল যে প্রকৃতির মায়াবী রূপকে ব্যবহার করে তিনি এরম বহু পদ্ধতি নিয়ে এলেন সেই ঐন্দ্রজালিক দুর্গ তৈরি করার, যার ভিতরে-বাইরে আপনি সহজেই যেতে পারবেন কিন্তু কোন শত্রুই যেটা ভেদ করতে পারবেনা। এরম একটা উন্নত ও অসামান্য ব্যাপার মানব ইতিহাসে প্রথমবার ঘটেছে, এটার উদযাপন করতেই গুরু পূর্ণিমা পালন করা হয়।