ভগবান শিবের নটরাজ রূপ সারা ভারতবর্ষে, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে, অত্যন্ত জনপ্রিয়। ব্যাকরণ, আয়ুর্বেদ, সংগীত, নৃত্য, নাট্যসহ সকল কলাবিদ্যার দাতা নটরাজ। শিবের নৃত্যের নাম হল তাণ্ডব ও পার্বতীর নৃত্যকে বলে লাস্য। তাণ্ডব ধ্বংসাত্মক পৌরুষেয় নৃত্য; স্বয়ং শিবই কাল-মহাকাল বেশে বিশ্বধ্বংসের উদ্দেশ্যে এ নৃত্য করেন। শিবের অভেদ শক্তি পার্বতীর আবেগময় মধুর ও সুচারু নৃত্যকলাকে লাস্য বলে। লাস্যকে তাণ্ডবের নারীসুলভ বিকল্প বলে ধরা হয়। তাণ্ডব ও লাস্য যথাক্রমে ধ্বংস ও সৃষ্টির রূপ। নটরাজ শিরোমণি ভগবান মহাদেব সনক প্রভৃতি সিদ্ধগণকে উদ্ধার করার মানসে নৃত্যশেষে নবপঞ্চবার অর্থাৎ চতুর্দশবার ডমরু বাজিয়েছিলেন। তখনই শিবের ডমরু ধ্বনি থেকে আবির্ভূত হয় চৌদ্দটি সূত্র, তাকে বলা হয় শিবসূত্র। নন্দীকেশ্বর প্রণীত কাশিকায় এ সম্পর্কে বলা হয়েছে।
নৃত্তাবসানে নটরাজরাজো
ননাদ ঢক্কাং নবপঞ্চবারম্।
উদ্ধর্তুকামঃ সনকাদিসিদ্ধান্
এতদ্বিমর্শে শিবসূত্রজালম্।।
সনকাদি সিদ্ধগণকে উদ্ধারের জন্যে শিবের ডমরু থেকে উৎপন্নজাত ১৪টি শিবসূত্র হল:
১. অ ই উ ণ্
২. ঋ ৯ ক্
৩. এ ও ঙ্
৪. ঐ ঔ চ্
৫. হ য ৱ র ট্
৬. ল ণ্
৭. ঞ ম ঙ ণ ন ম্
৮. ঝ ভ ঞ
৯. ঘ ঢ ধ ষ্
১০. জ ব গ ড দ শ্
১১. খ ফ ছ ঠ থ চ ট ত ৱ্
১২. ক প য্
১৩. শ ষ স র্
১৪. হ ল্
এ চোদ্দটি শিবসূত্র বা মাহেশের সূত্র থেকেই পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীতে 'অণ্' থেকে 'হল্' পর্যন্ত ৪১ টি প্রত্যাহার সূত্র তৈরি হয়। পরে বার্তিক এবং উণাদি সূত্রে যথাক্রমে 'চয়্' ও 'ঞম্' এ দুটি প্রত্যাহার পরিলক্ষিত হয়। এ সকল প্রত্যাহার সূত্র দিয়েই সংস্কৃত ভাষার পাণিনীয় ব্যাকরণের সকল সূত্র তৈরি। সংস্কৃত ব্যাকরণের মূলেই শিবের নটরাজ রূপে দেয়া মাহেশ্বর সূত্র। পাণিনীয় ব্যাকরণ শুধু সংস্কৃতের নয়, পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন ব্যাকরণ। অর্থাৎ পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন ব্যাকরণের মূলেও নটরাজ শিব।
শিবের ডমরু থেকে উৎপন্ন চতুর্দশ শিবসূত্র থেকেই ব্যাকরণ সহ সকল বিদ্যার উৎপত্তি।শিব এ 'নটরাজ' রূপে নৃত্য সহ সকল কলাবিদ্যার গুরু। ভগবান শিব যখন প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ বা আনন্দিত হন তখনই শিবশক্তির মিলনে তাণ্ডব লাস্য নৃত্যকলা সম্পন্ন হয়। দক্ষযজ্ঞের পরে সতী দেহত্যাগ করলে, ভগবান শিব এক প্রলয়ঙ্কারী তাণ্ডবনৃত্য করেন। সৃষ্টিকে সচল রাখতে নৃত্য নটরাজের স্বভাব, নাদময় সঙ্গীত তদীয় স্বরূপ। ডমরুর ডিডিম্ ডিডিম্ ও ববম্ ববম্ ধ্বনিতে জেগে ওঠে নৃত্যকলার অপরূপ ভঙ্গিমা। নাট্যশাস্ত্রেরও আদি প্রবক্তা নটরাজ শিব। তিনি প্রথম নাট্যশাস্ত্র প্রজাপতি ব্রহ্মাকে দিয়েছিলেন। ব্রহ্মা ভরত মুনিকে দিলেন, ভরত তা পৃথিবীতে প্রচার করলেন। ভরত মুনির নামে এর নাম হয় ভরতের নাট্যশাস্ত্র। নাট্যশাস্ত্রের সাথে সাথে ভরত মুনি এক অনন্য নৃত্যশৈলী জগতে প্রচার করেন। সেই অপূর্ব মনোহর নৃত্যশৈলীর নাম 'ভরতনাট্টম্'। দক্ষিণ ভারতের মন্দির সহ, আজও শাস্ত্রীয় নৃত্যের প্রধানতম হিসেবে ; সারা পৃথিবী ব্যাপী 'ভরতনাট্টম্' প্রচলিত এবং জনপ্রিয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনে ও লেখাতেও এ নটরাজ রূপের প্রতি মুগ্ধতা দেখা যায়। সংগীত নিত্যশিল্পের তরঙ্গদল যে নটরাজের প্রলয়ঙ্কারী নৃত্যে আবির্ভূত হয়ে দুলে উঠল, তা অত্যন্ত সুন্দর করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর একটি সংগীতে ব্যক্ত করেছেন।
" প্রলয়-নাচন নাচলে যখন আপন ভুলে
হে নটরাজ, জটার বাঁধন পড়ল খুলে॥
জাহ্নবী তাই মুক্তধারায় উন্মাদিনী দিশা হারায়,
সঙ্গীতে তার তরঙ্গদল উঠল দুলে॥
রবির আলো সাড়া দিল আকাশ-পারে।
শুনিয়ে দিল অভয়বাণী ঘর-ছাড়ারে।
আপন স্রোতে আপনি মাতে, সাথি হল আপন-সাথে,
সব-হারা সে সব পেল তার কূলে কূলে॥"
স্কন্দপুরাণে মহেশ্বরের ছয়রাগ ও ছত্রিশ রাগিনীর মাধ্যমে বিভিন্ন নৃত্য নৃত্যাভিনয়ের বর্ণনা পাওয়া যায়।কেবল নৃত্য নয় সঙ্গীতেও তিনি অনন্য অদ্বিতীয়।নৃত্য, গীত, বাদ্য এবং নৃত্য এ তিনকে একসাথে প্রাচীনকালে বলত সংগীত। মহেশ্বরের এই নৃত্য ও নাট্যশিল্পের পারদর্শীতার দরুণ তাঁকে নটরাজ বলে অভিহিত করেন সনকাদি সকল সিদ্ধগণ। ভগবান শিবের তাণ্ডব নৃত্য প্রধানত সাত প্রকারের। আনন্দতাণ্ডব, সংহারতাণ্ডব এ প্রত্যেকটি নামের মধ্যেই সুস্পষ্ট সেই তাণ্ডবের রূপ এবং প্রকৃতি।
১. আনন্দতাণ্ডব
২. সন্ধ্যাতাণ্ডব
৩. কলিকাতাণ্ডব
৪. ত্রিপুরাতাণ্ডব
৫. গৌরিতাণ্ডব
৬. উমাতাণ্ডব
৭. সংহারতাণ্ডব
সদাশিব অল্পতেই তুষ্ট হন এবং অল্পতেই রুষ্ট হন ; তাই তাঁর নাম আশুতোষ ।তাঁর নৃত্যছন্দে ব্রহ্মাণ্ড স্পন্দিত হয়। মহাপ্রলয়ের তাণ্ডবে পৃথিবী লয় হয়। জগতের আদি পিতামাতা শিব এবং শক্তি একইসাথে তাণ্ডব এবং লাস্য নৃত্য করেন। এতেই পৃথিবীতে লয় হয়, আবার লয়ের পরে পুনরায় সৃষ্টি হয়, পৃথিবী রক্ষা পায়। শিব এবং শক্তি অভেদ, ব্রহ্মাণ্ডের সকল শক্তির উৎস। এ কারণেই বেদে বিশেষ করে কৃষ্ণ যজুর্বেদীয় তৈত্তিরীয় আরণ্যকের দশম প্রপাঠকে একা ভগবান শিব নয় অম্বিকাপতি, উমাপতিকেও বন্দনা করা হয়েছে-
নমো হিরণ্যবাহবে হিরণ্যবর্ণায় হিরণ্যরূপায়
হিরণ্যপতয়ে অম্বিকাপতয় উমাপতয়ে
পশুপতয়ে নমো নমঃ।।
"অম্বিকাপতি,উমাপতি, পশুপতি, হিরণ্যাদি সর্বনিধির পালক,তেজোময়, হিরণ্যবাহু, হিরণ্যবর্ণ,হিরণ্যরূপ পরমেশ্বর শিবের উদ্দেশ্যে নমস্কার।"
হিমালয়ের কৈলাস থেকে শুরু করে একেবারে দক্ষিণ পর্যন্ত সারা ভারতবর্ষে অসংখ্য শিবমন্দির বিরাজিত। এর মধ্যে পবিত্র দ্বাদশ শিবলিঙ্গ আছে,তাদের দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ বলে। এ জ্যোতির্লিঙ্গগুলো হল: কাশীতে বিশ্বনাথ; উত্তরাখণ্ডে কেদারনাথ; গুজরাটে সোমনাথ; মহারাষ্ট্রে নাগেশ্বর , ভীমাশঙ্কর, ঘৃষ্ণেশ্বর, ত্রম্ব্যকেশ্বর; ঝাড়খণ্ডে বৈদ্যনাথেশ্বর ; মধ্যপ্রদেশে মহাকালেশ্বর, ওঙ্কারেশ্বর; তামিলনাড়ুতে রামেশ্বর; অন্ধ্রপ্রদেশে মল্লিকার্জুন জ্যোতির্লিঙ্গ। স্বয়ম্ভু এ লিঙ্গমূর্তিতে শিব স্বয়ং বিরাজমান। তবে আশ্চর্যের বিষয় রামেশ্বর কেদারনাথ এ স্বয়ম্ভুলিঙ্গ সহ শিবের সাতটি প্রাচীন মন্দির রয়েছে একই সরলরেখায়। মন্দিরগুলোর দ্রাঘিমাংশ একই ; প্রত্যেকটি মন্দিরই ৭৯ ডিগ্রি ৪১ মিনিট ৫৪ সেকেন্ড পূর্বে অবস্থিত।
ভারতবর্ষের সংস্কৃতি শিবময়। এখানে জীবকেও শিবের স্বরূপ মেনে বলা হয়, "যত্র জীব, তত্র শিব"। শিবের নটরাজ রূপের সঙ্গে বিজ্ঞানের এক গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তাই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণাগার সুইজারল্যান্ডের CERN-এর গবেষণাগারের সামনে ২০০৪-এর ১৮ জুন স্থাপন করা হয় এক নটরাজ বিগ্রহ। পারমাণবিক গবেষণার জন্য ইউরোপীয় গবেষণা সংস্থাটি বৃহত্তম কণা পদার্থবিদ্যার পরীক্ষাগার পরিচালনা করে। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি ১৯৫৪ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়।এর সদস্য দেশ মাত্র ২৩। প্রতিষ্ঠানটি জাতিসংঘের অফিসিয়াল পর্যবেক্ষক।
পাশ্চাত্য বিজ্ঞানীরা শিবের নটরাজ মূর্তি কেন স্থাপন করছেন, একটি ফলকে রয়েছে মূর্তি স্থাপনের অপূর্ব ব্যাখ্যা। রয়েছে পদার্থবিদ ফ্রিৎজো ক্যাপ্রার বক্তব্য। তিনি বলেছেন, "কয়েক’শ বছর আগে ভারতীয় কোন শিল্পী শিবের নৃত্যরত ছবি এঁকেছিলেন। আর সৃষ্টির নৃত্য বোঝাতে আমরা প্রযুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করি। কিন্তু এ সৃষ্টির ব্যাখ্যাই রয়েছে পুরাণে। নটরাজ মূর্তি একদিকে ধর্মীয় শিল্প আবার অন্যদিকে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান।"
আজ বিজ্ঞানের আকর্ষক গবেষণা চলছে God particle বা ঈশ্বর-কণা নিয়ে। এ নামটি বিজ্ঞানীরাই দিয়েছেন।বিজ্ঞানের ভাষায় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আদি কণাকে, হিগ্স-বোসন কণা বলে নামকরণ করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সত্যেন বোসের পদবী অনুসারেই কণাটির নামকরণ করা হয় বোসন কণা। কণা পদার্থ বিজ্ঞান গবেষণার প্রধান কেন্দ্র সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে। প্রতিষ্ঠানটিকে সবাই সংক্ষেপে CERN নামেই চেনে।পৃথিবীর প্রায় ৭৯৩১ জন বিজ্ঞানী কাজ করছেন, এ বৃহৎ গবেষণাগারে। CERN এর গবেষণাগারের সামনেই স্থাপিত হয়েছে শিবের নটরাজ রূপের এক অপূর্ব সুন্দর মূর্তি।বিজ্ঞান গবেষণায় ধর্মীয় মূর্তি কেন? ১৯৭৫ সালে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী ফ্রিটজফ কাপ্রার কথায় আছে এর উত্তর। তার মতে শিবের নৃত্যই হল অতিপরমাণবিক পদার্থের অন্তহীন স্পন্দন। "The dance of Shiva is the dancing universe, the ceaseless flow of energy going through an infinite variety of patterns that melt into one another. "
CERN-এর এক গবেষকের ব্যাখ্যা হল, শিবের এ নৃত্য আসলে মনে করিয়ে দেয়, জগতে সবকিছুই পরিবর্তনশীল। কোনও কিছুই স্থির নয়। বিজ্ঞানী কার্ল সাগানও এই প্রসঙ্গে বলেন, "হিন্দু ধর্ম হল বিশ্বের অন্যতম এক প্রাচীন ধর্ম, যারা বিশ্বাস করে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে জন্মও মৃত্যু বৃত্তাকারে ঘুরে চলছে।" আমরা যাকে মৃত্যু, ধ্বংস বলে অবিহিত করি, বেদান্তে বলে রূপ পরিবর্তন। শক্তির ক্ষয় নেই, সৃষ্টিও নেই, শুধুই রূপান্তরিত হয়।এ কথা বিজ্ঞান বলে, একইকথা বেদান্তও বলে। শিবের নটরাজ এ সত্যকেই আমাদের সামনে দৃশ্যমান করেছে। মূল অব্যক্ত ক্ষেত্র (field) স্থির হয়েও রূপ থেকে রূপান্তরিত হচ্ছে প্রতিক্ষণ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, আদি ক্ষেত্র (field) অব্যক্ত বা pre-space. কারণ সেখানে আকাশ নেই, সময় নেই। কথাগুলো ঋগ্বেদের পরমাত্মা সূক্তেও (১০.১২৯) বলা আছে। সেখানে বলা আছে, আদিতে কোন অস্তিত্ব বা অনস্তিত্ব কিছুই ছিলনা; কোন বায়ুমণ্ডলও ছিল না।" এ অব্যক্ত অবস্থায় জগতের স্রষ্টা ধ্যানস্থ শিবরূপে কল্পিত।
নটরাজ রূপে ভগবান শিবের ডানহাতে থাকে অভয় মুদ্রা , বামহাতে থাকে অনির্বাণ অগ্নি। ভগবানের বাম চরণ স্পর্শ করে রয়েছে দক্ষিণ চরণকে । রুদ্ররূপে নটরাজ ভগবান নীলকণ্ঠ শঙ্কা তিরোহিত করে জ্ঞান প্রদান করেন। একেই মুক্তি বা ‘মোক্ষ’ নামে আখ্যায়িত করা হয় । নটরাজ শিবের হাতে আগুণ হল প্রলয়ঙ্কারী ধ্বংসের প্রতীক। অন্য হাতে ডমরু হল, অনাহত নাদ ॐ এবং চতুর্দশ মাহেশ্বর সূত্রের প্রতীক জ্ঞান । বিজ্ঞানীরা বলছেন, শক্তি (energy) সম্পর্কে কেউ পরিপূর্ণ জানেনা। শক্তি হল বিমূর্ত, বস্তু-নিরপেক্ষ। শক্তি ছাড়া মহাবিশ্ব শুধুই অলীক কণিকা (particle), যাদের কোন দীর্ঘস্থায়ী অস্তিত্ব নেই। কোয়ান্টাম ফিল্ড থেকে এই কণাগুলি উঠছে, আবার মিশে যাচ্ছে। নটরাজ মূর্তিতেও ডমরু সৃষ্টি এবং আগুন ধ্বংসকে চিহ্নিত করছে। সাপ কুলকুণ্ডলিনী শক্তির প্রতীক, দেহে এ শক্তিটি জাগ্রত হলেই জীব মুক্তি পেয়ে পরমগতি লাভ করে। তাই শিব সকল কারণের উৎস এবং জীবের পরম মুক্তিদাতা ।
নমঃ শিবায় শান্তায় কারণত্রয় হেতবে
নিবেদয়ামি চাত্মানং ত্বং গতিঃ পরমেশ্বরঃ।।
নটরাজ শিবের নৃত্য বিশ্বের সকল অস্তিত্বের প্রতীক।বিশ্বের কোনও সৃষ্টিই স্থিতিশীল নয়, বরং সবসময় পরিবর্তনশীল আর আপেক্ষিকও বটে। আধুনিক পদার্থবিদ্যা বলে, শুধু জন্ম আর মৃত্যু দিয়েই সৃষ্টি আর ধ্বংস চিহ্নিত হয় না। এর সাথে অনেক অজৈব বিষয়ও জড়িয়ে থাকে। নটরাজ শিবের নৃত্য একটি অতিপারমাণবিক স্পন্দনের প্রতীক। শিব একাধারে সকল অস্তিত্বের আধার, আবার সকল অস্তিত্বের বিলয়। সৃষ্টি বিলয়ের দুটি ভাবই নটরাজে দেখা যায়। নটরাজ পায়ের নিচে দলিত করছেন অপস্মার নামক এক দৈত্যকে। অপস্মার হলেন, মোহ অজ্ঞতা, অন্ধকার এবং অবিদ্যার প্রতীক। তাই অপস্মরাকে নাশ করে অন্ধকার বিদূরিত করতে হয়। নটরাজ সর্বদা অনন্তকাল ধরে অজ্ঞতা, লোভ এবং স্বার্থপরতার প্রতীক ক্ষুদ্র দানব অপস্মারকে পা দিয়ে পদদলিত করে দমন করে আমাদের লোকশিক্ষা দিচ্ছেন। তিনি বিরুপাক্ষ রূপে পিনাকহস্তায় বজ্রহস্তায় হয়ে সকল আসুরিক ভাবাপন্নদের নাশ করে জগতকে রক্ষা করেন।
নমস্তুভ্যাং বিরূপাক্ষ নমস্তে দিব্যচক্ষুষে
নমঃ পিনাকহস্তায় বজ্রহস্তায় বৈ নমো নমঃ।।
শিব বিভিন্ন মূর্তিতে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে আবৃত করে রেখেছেন। তিনি সকল জীবের প্রভু তাই তাঁর নাম ‘ঈশান’। তিনি ষড়ৈশ্বর্য্যশালী , তাই ‘ভগবান’ । তিনি সকল দেবতার বন্দিত , তাই ‘মহাদেব’। পশু বা জীব গনের কর্ম বন্ধন করেন বলে তিনি ‘পশুপতি’। তাঁর জন্মদাতা বা জন্মদাত্রী কেউ নেই, তাই তিনি ‘স্বয়ম্ভু’। বিজ্ঞানীরা অনুভব করলেন, এ ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি-রহস্য লুকিয়ে আছে নটরাজ শিবের প্রতীকে।নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী রুডলফ যোসেফ আলেক্সান্ডার শ্রডিঞ্জার (১৮৮৭-১৯৬১) ঘোষণা করেন, বিজ্ঞানীদের যে দ্বন্দ্ব দেখা যায় পদার্থ ও চেতনা নিয়ে এর সমাধান লুকিয়ে আছে উপনিষদের প্রাচীন প্রজ্ঞায়। তিনি বেদান্ত দর্শন বিশেষ করে উপনিষদের দ্বারা প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত ছিলেন। তিনি উপনিষদে বর্ণিত অখণ্ড চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন। বিষয়গুলো নিয়ে শ্রডিঞ্জার পরবর্তীতে গবেষণা করেছেন পৃথিবীর অনেক শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীরা। বোহম, উইগনার, ওপেনহাইমার, জোসেফসন, সাগান, হুইলার, হেগ্লিস, বেলিজ প্রমুখ। তারা বললেন, উপনিষদ কথিত চেতনাই শ্রেষ্ট উত্তর এ কম্পনশীল বিশ্বব্রহ্মান্ড ও ক্ষুদ্রতম কণার। ওপেনহৈমার বললেন, "আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে (Physics) যা পাওয়া যাচ্ছে তা প্রাচীন হিন্দু প্রজ্ঞারই প্রতিফলন।" তাই আধুনিক বিজ্ঞানের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা কেন্দ্র CERN-এর সামনে বিজ্ঞানীরা স্থাপন করলেন নটরাজের মূর্তি।
যুগ-যুগান্ত ব্যাপি অসংখ্য শিল্পীসত্ত্বাকে প্রেরণাপ্রদীপ্ত করেছে নটরাজ। কবিরা তাকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন, সংগীত লিখেন। কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী ভাবের পিছনে পাওয়া যায় নটরাজের প্রভাব। তিনি তার 'বিদ্রোহী' কবিতা সহ অনেক গান এবং লেখাতেই নটরাজ শিবের প্রসঙ্গ অনেছেন। বিদ্রোহী কবিতাটিতে আমরা নটরাজের সুস্পষ্ট প্রভাব দেখি। নটরাজের মত বিদ্রোহীরও দুটি রূপ শান্ত এবং রুদ্র।
"আমি চিরদূর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহা-প্রলয়ের আমি নটরাজ,
আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস!"
শিল্পীরা অপূর্ব শৈলীতে তাকে চিত্রায়িত করেছেন। ভাস্করেরা তাঁর অপূর্ব মূর্তি গড়েছেন কঠিন পাথর খোদাই করে। দক্ষিণ ভারতে দেখা যায় ভরতনট্যম সহ যে কোন শিল্পের চর্চাকারী শিল্পীর সম্মুখে থাকে নটরাজ মূর্তি। দ্রাবিড় ভূমির শিল্প সংস্কৃতির এক বৃহত্তর অংশ জুড়ে আছেন নটরাজ। শিবমন্দির সহ বিভিন্ন মন্দিরে দেখা যায় নটরাজকে। তিনি নিজের ধ্যানে, নিজের করে নৃত্য করছেন, তাঁর নৃত্যের কম্পনেই জগৎ আজ সচল এবং স্পন্দিত; জীবজগত প্রাণময়। তাঁর নৃত্যের ছন্দে কখনও জন্ম, কখনও মৃত্যু। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় -
"নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু পাছে পাছে,
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ
দিবারাত্রি নাচে মুক্তি নাচে বন্ধ-"
লেখক: কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়