বর্তমানে কিছুদিন যাবত একটা আলোচিত বিষয় হল সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু এ বিষয়টি। দেশের অনেকেই বিশেষ করে যারা আমাদের সংখ্যালঘুদের প্রতি খুবই সহানুভূতিশীল তারা বলেন যে,"দেশে সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরু বলতে কিছুই নেই।প্রত্যেকটি নাগরিক আমরা সকলেই সমান এবং আমরা সবাই বাংলাদেশী।"কথাটা আসলে সুন্দর,আমরাও প্রতিনিয়ত বলি। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের মধ্যে, বিশেষ করে আমি নির্দিষ্ট করে বলতে পারি যে, সংখ্যালঘুদের মধ্যে সংখ্যায় বেশী হলেও ; সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশে যদি সংখ্যালঘু কাউকে বলা হয় তাহলে সেটা হিন্দুসম্প্রদায়। কারণ হিন্দু সম্প্রদায়কে রক্ষার্থে কোন বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান নেই।হিন্দু সম্প্রদায়ের উপরে অত্যাচার হলে, সেই অত্যাচার প্রতিরোধে কোন বহির্বিশ্বের চাপ নেই।হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের পক্ষে কথা বলার জন্য কোন দেশের 'এ্যাম্বাসি' নেই। ৫০ বা ১০০ টি এ্যাম্বাসি'ও(Embassy) নেই হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের পক্ষে থেকে কথা বলার জন্য। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ 'সবেধন নীলমণি' আছে শুধু ভারত। সেই ভারত বিশ্বের কোথাও হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা নির্যাতিত হলে কতটুকু কি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয় তা আমরা সবাই জানি এবং সবাই দেখি।
সংখ্যালঘু শব্দটি ব্যবহার না করতে আমার যতদূর মনে পড়ে,এ বিষয়ে প্রথম প্রচারণা শুরু করে বাংলাদেশের দক্ষিণপন্থী রাজনীতিবিদরা। তারাই সর্বপ্রথম প্রচারণা শুরু করে যে,"আপনারা কেউ নিজেকে সংখ্যালঘু বলবেন না,নিজেকে কেউ ছোট ভাববেন না, আমরা আমরা সবাই সমান, আমরা সবাই বাংলাদেশী।" কথাটা শুনতে খুব সুন্দর শোনায়।আসলেই খুবই সুন্দর বাক্যটা।একটা সুন্দর যুগের জন্য,সুন্দর কালের জন্য কথাগুলো প্রযোজ্য ।কিন্তু এই কথাটার মধ্যে যে একটা নিষ্ঠুরতার ফাঁদ আছে,সেই ফাঁদটা আমরা অনেকেই জানি না।একটা পুকুরে অসংখ্য ছোট ছোট মাছ আছে। সাথে আছে বড় বড় রুই, কাতল মাছ ।আমরা যখন ঐ পুকুরে মাছ চাষ করি, তখন ছোট্ট মাছগুলোকে আগে কিছুটা বড় হতে দিয়ে এরপরে পুকুরের বড় মাছগুলোর সাথে মিলতে দেউ। যদি মাছগুলোর ছোট্ট অবস্থাতে ছোট্টমাছ, বড়মাছ ছেড়ে দেই ; তবে ঐ বড় মাছগুলো মনের আনন্দে ছোট মাছগুলোকে খেয়ে নিঃশেষ করে দিবে। মহাভারতে একে 'মাৎস্যন্যায়' বলে অভিহিত করা হয়েছে। বাংলায় শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে, বাংলার ইতিহাসে এমনি এক মাৎস্যন্যায় অবস্থার সম্মুখীন হয়। ইতিহাসের ছাত্রমাত্রই বিষয়টি জানেন।ছোট মাছগুলোকে বড় মাছগুলো খাবে এটা পরিবেশের নিয়ম,জগতের নিয়ম। বিষয়টি শুধু মাছ নয়, মানুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই বড়রা যাতে ছোটদের খেয়ে নিঃশেষ করে দিতে না পারে তাই; ছোটদের রক্ষার্থে বিশেষ সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। ছোট মাছগুলোকে বিশেষভাবে সুরক্ষা দিয়ে বড় করে তোলা হয়।
ঠিক একইভাবে সংখ্যালঘুদের অধিকার এবং অস্তিত্ব রক্ষার্থে বিশেষ সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। এ সুরক্ষার অংশ হিসেবে পৃথিবীব্যাপী প্রায় সমস্ত দেশে সংখ্যালঘুদের বিশেষ কিছু সুযোগ সুবিধা আছে। এর মধ্যে অন্যতম হল সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়।বহুদেশে সংখ্যালঘুদের কোটা সহ অনেক রকমের বিশেষ সুবিধা আছে। যাতে সংখ্যালঘুরা নিরাপদে সম্মানের সাথে থাকতে পারে। বাংলাদেশ একটা সাংবিধানিক অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হওয়ার পরেও, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সুরক্ষায় বিশেষ সুযোগ সুবিধা কিছুই নেই। অবশ্য পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি চুক্তির পরে পাহাড়ি আদিবাসীদের জন্যে মন্ত্রণালয় সহ বেশকিছু সুযোগ সুবিধা আছে। কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের জন্যে এর কিছুউ নেই। এর কারণ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের নেতৃত্বের দুর্বলতা এবং নিজেদের অধিকার আদায়ের বিষয়ে প্রচণ্ড ধরণের অজ্ঞতা।
দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনীতিবিদরা যখন বোঝায়, "আমরা সবাই বাংলাদেশী,আমাদের এখানে কোন সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িক বিভাজন থাকবে না ইত্যাদি।" তখন আমাদের কিছু লোক না বুঝে বলে, "হ্যাঁ তাই; কে বলেছে আমি সংখ্যালঘু?আমি তো বাঙালি, আমি সংখ্যাগুরু।" নিগূঢ় এ বিষয়গুলো তারা বুঝে বলুক আর না বুঝে বলুক একজন যিনি বলেন যে, "কেউ আপনারা সংখ্যালঘু বলবেন না।" শুনতে ভাল লাগলেও, এ কথাটির মধ্যে একটি বিপদজনক ফাঁদ আছে।সে ফাঁদটা আমরা অনেকেই আপাতদৃষ্টিতে বুঝতে পারি না। সংখ্যালঘু শিকার করলে রাষ্ট্রের পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সংখ্যালঘুদের মত বিশেষ সুযোগ, সুবিধা এবং সুরক্ষার একটা দায়ভার চলে আসে। পৃথিবীব্যাপী সংখ্যালঘুদের বিশেষ অধিকার আছে।সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় থাকতে হয়,সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় কমিশন থাকতে হয়,সংখ্যালঘুদের চাকুরিক্ষেত্রে কোটা সুবিধা থাকতে হয় ইত্যাদি। এ বিশেষ সুযোগ সুবিধার নিরাপত্তা থাকতে হয় এ কারণেই যে, তারা যেন দেশ নিশ্চিহ্ন হয়ে না যায়।
বর্তমানে হু হু করে বাংলাদেশে যে হারে হিন্দুদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে; এর সমাধান লক্ষ্যে আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সংখ্যালঘিষ্ঠ সকলেরই সাধ্যমত ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা করা প্রয়োজন। এরজন্যেই একটি মন্ত্রণালয় সক্রিয়ভাবে কাজ করা উচিত। সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় প্রসঙ্গে অনেকেই জানতে চান, সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়ের কাজ কি হবে? এ প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তরে বলা যায়, তার সংখ্যালঘুদের জীবন এবং সংস্কৃতির উন্নয়নে বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করবে। সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়ের পরে দ্বিতীয় প্রয়োজনীয় হলসংখ্যালঘু কমিশন। এ কমিশন সংখ্যালঘুদের নির্যাতন সহ সার্বিক সুরক্ষায় বিভিন্ন আইনগত সাহায্য সহায়তা দিবে। এতে সংখ্যালঘুদের মনবল বৃদ্ধি পেয়ে, দেশত্যাগের প্রবনতা ধীরেধীরে কমবে। এরপরে তৃতীয় আরেকটি বিষয় হল, 'হিন্দু কল্যাণ ট্রাস্ট'কে ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের আদলে হিন্দু কল্যাণ ফাউন্ডেশনে পরিণত করা। এর মাধ্যমে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার ঘটবে।
এ তিনটি দাবি যদি দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা রাষ্ট্র থেকে পেতে পারে, তবে এমনিতেই তারা সুরক্ষিত হবে। এ তিনটি দাবিই মুখ্য অন্য দাবিদাওয়াগুলো গৌণ। শুধু এ তিনটি দাবির বিষয়ে আমাদের হিন্দু নেতারা এগিয়ে যেত, সক্রিয় থাকত তবে অঅন্ততপক্ষে একটি দাবি হলেও আদায় করা যেত। আমাদের হিন্দু সংগঠনের কারও ৩২ দফা দাবি,কারও ১০ দফা দাবি। ভাবটা এমন যাদের সংগঠনের যত বেশি দাবি ; তারা তত বেশি সাংগঠনিক আত্মতুষ্টির ঢেকুর তোলে। দাবি প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত মতামত হল, ৩২ দফা,১০ দফা,৭ দফা,৫ দফা এত দফা না করে শুধু ৩ দফা আমাদের বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। প্রথমত সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়; দ্বিতীয়ত সংখ্যালঘু কমিশন এবং তৃতীয়ত হিন্দু কল্যাণ ফাউন্ডেশন।
বর্তমান সরকারের শাসনামল হল ১৯৭১ সালের অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধের ধারক বাহক একটি সংখ্যালঘু বান্ধব সরকার। ধর্মনিরপেক্ষ শ্বাশত বাঙালিত্বের আদর্শকে ধারণ করায়, বর্তমান সরকারকে আমরা হিন্দু সম্প্রদায় আমাদেরই সরকার মনে করি। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রায় অধিকাংশই বর্তমান সরকারকে তাদের একান্ত আপনজন মনে করে এবং বিশ্বাস করে।এ সরকারের শাসনামলে প্রচুর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের চাকুরিক্ষেত্রে সুবিধা পেয়েছে, চাকুরির ক্ষেত্রে পছন্দসই ভাল পোস্টিং পেয়েছে। এরপরেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যদি কেউ বিপদে পরে, অসহায় হয় তবে সরাসরি যাওয়ার কোন স্থান নেই।কিন্তু আজকে যদি সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় থাকে, তবে অন্ততপক্ষে আপদে বিপদে যাওয়ার পথ থাকে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ও আমাদের বিষয়গুলো দেখতে পারত, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের ক্ষেত্রে বরাদ্দকৃত অর্থের দিকে দৃষ্টি দিলে সহজেই তীব্র বৈষম্য চোখে পরে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ে স্বাভাবিকভাবে একজন সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের লোক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বে থাকেন।কিন্তু সেই ধর্ম মন্ত্রণালয়ে থেকে কতটুকু সুবিধা পান দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা? আজকে বাংলাদেশে নাই নাই করেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা প্রায় আড়াই-তিন কোটি।ইউরোপের অনেক দেশ আছে যে ৪-৫ টা দেশের সকল জনসংখ্যা একসাথে মিলে তবে আড়াই-তিন কোটি জনসংখ্যা হয়।
দেশে ধর্ম মন্ত্রণালয় আছে। কিন্তু ধর্ম মন্ত্রণালয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করা একজন প্রতিমন্ত্রী অবশ্যই থাকা অত্যন্ত আবশ্যক। যতদূর শুনেছি, শ্রীলঙ্কায় এমন পদ্ধতি আছে। অর্থাৎ ধর্ম মন্ত্রণালয়ে বৌদ্ধ, হিন্দু, মুসলিম এবং খ্রিস্টান সকল সম্প্রদায়ের থেকে একজন করে মন্ত্রী আছে। সকলেই নিজ নিজ সম্প্রদায়ের বিষয়গুলো দেখে।ধর্ম মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশে বিরাজমান চার সম্প্রদায়ের চারজন প্রতিমন্ত্রী যদি না থাকে ; তবে ধর্ম মন্ত্রণালয়ে অন্ততপক্ষে দুইজন প্রতিমন্ত্রী থাকা প্রয়োজন। বৃহত্তর সম্প্রদায়ের থেকে একজন এবং বৃহত্তর সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের থেকে একজন। তাহলে বিষয়টি একটি ভারসাম্যময় থাকবে। তা না হলে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে, ধর্ম মন্ত্রণালয়কে শুধু একধর্মের মন্ত্রণালয়ই মনে করবে।
সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় হলে আমাদের অনেক সমস্যার এমনিতেই সমাধান হবে। আজকে আমাদের সম্প্রদায়ের মানুষকে নিয়ে বিভিন্ন দুরভিসন্ধিমূলক অঙ্ক কষা হয়।ইউরোপ থেকে ডলার আসে, আরব থেকে পেট্রে ডলার আসে হিন্দু সম্প্রদায়ের গরীব মানুষকে ধর্মান্তরিত করার জন্যে। বাহাই ধর্ম দেশে ধর্মপ্রচার শুরু করেছে, তারাও অঙ্ক কষে কোথায় কোথায় গরীব হিন্দু আছে। সবার অঙ্ক কষার মধ্যে পরে গেছি আমরা। উত্তরণের পথ আমাদেরই খুঁজে নিতে হবে।
অনেকে বলে ধর্ম মন্ত্রণালয় হলে কি আর হবে, সেখানে যারা এমপি-মন্ত্রী-সচিব হবে তারা কি আমাদের সম্প্রদায়ের মানুষের কথা বলবে? যদি প্রতিষ্ঠান হয় তবে প্রথমে না বললেও ধীরেধীরে বলবে; সমস্যা নেই। নিরাশ হওয়ার কিছুই নেই। এ বিষয়ে একটি গল্প আছে। একজন সন্ন্যাসী ভিক্ষা করতে গেছে এক কৃপণের ঘরে। দরজার সামনে দাড়িয়ে সে, গৃহস্বামীর কাছে ভিক্ষা চাচ্ছে। ভেতর থেকে কেউ ভিক্ষা আসছে না। তখন কৃপণের স্ত্রী ঘরের গৃহকর্ত্রী ঘরের ভেতর থেকে সন্ন্যাসীকে বলছে, "ভিক্ষা না ছাই দিব।" কথাটি শুনে ভিক্ষা চাওয়া সন্ন্যাসী বললেন, "মা তুমি ওই ছাইটাই দাও। এ ছাই দিতে দিতেই একদিন সত্যি সত্যি মানুষকে ভিক্ষা দিবে।"
তেমনি প্রাথমিক অবস্থায় কাজে না লাগলেও, যদি এ প্রতিষ্ঠানগুলো হয় তবে একটা সময় সত্যি সত্যিই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কল্যাণ হবে। প্রত্যেকটি বিষয়ে আগে থেকেই নেতিবাচক চিন্তা ভাবনা করা উচিত নয়।সংখ্যালঘু কমিশন যদি হয়, তবে প্রতিষ্ঠানটি থেকে সংখ্যালঘু সুরক্ষায় অনেক কাজ হবে। তাই আবারও আমি আমার কথার পুনরাবৃত্তি করছি।আমরা শুধুই তিনটি অত্যন্ত যৌক্তিক দাবির সমাধান চাই।সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়, সংখ্যালঘু কমিশন এবং হিন্দু কল্যাণ ফাউন্ডেশন।
আজ দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় প্রতিনিয়ত হাজারটা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি। খাবারের পরিমাণ যখন কম থাকবে, সেই খাবার খেতে কাকেরা খাবার নিয়ে মারামারি করবে, কামড়াকামড়ি করবে। এটাই স্বাভাবিক। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকাংশ পরিবারে সম্পদের চাহিদার যোগান ঠিকমত হয় না। অর্থনৈতিক টানাটানি গ্রাম-গঞ্জ এবং শহরের নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতে। খাবার এবং সম্পদের সরবরাহ কম থাকায় নিজেদের মধ্যে পারিবারিক বিরোধ লেগে যায়। স্বার্থের প্রশ্নে মা-বাবার সাথে পর্যন্ত বিরোধ লেগে যায়। অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে পারিবারিক সম্পর্কগুলো ধীরেধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।আগে হিন্দু পরিবারগুলো ছিল যৌথ পরিবার। কিন্তু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে যাওয়ায়, যৌথ পরিবারও ভেঙে যাচ্ছে।পারিবারিক বন্ধনও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
আমি যদি বলি 'সংখ্যাগুরু' এবং 'সংখ্যালঘু' মানি না; দেশে এর কোন অস্তিত্ব নেই, আমারা সবাই সমান। যিনি বা যারা বলবেন, তবে বুঝতে হবে তিনি একজন মহাধূর্ত অথবা মহাবোকা একজন ব্যক্তি। এ দুজনের মধ্যে একজন তিনি। ছোট্ট একটি বটগাছের চারাগাছ লাগিয়ে আপনি যদি গাছটির আশেপাশে বেড়া দিয়ে না দেন তবে ছাগলে খেয়ে যাবে। চারাগাছটি নষ্ট হয়ে যাবে। আপনি যদি ছোট্ট চারাগাছকেই বলেন, সে নিজেই নিজের নিরাপত্তা দিবে ;তবে বুঝতে হবে আপনি বোকার স্বর্গে বাস করেন। সেই ছোট্ট চারাগাছটিই একটি সময়ে যখন বৃহৎ বটবৃক্ষতে রূপান্তরিত হবে; তখন সেই বটবক্ষের ডালে, কোটরে হাজার হাজার পাখি আশ্রয় নিতে পারবে।
একটু বড় হতে সুযোগ দিন না ছোট্ট মাছদের, ছোট্ট চারাগাছদের মত দেশের সংখ্যালঘুদের। অসহায় অস্তিত্ব রক্ষার্থে সুযোগ দিন। কিভাবে একটু একটু করে শুণ্যের কোঠায় চলে যাচ্ছে মানুষগুলো। সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষগুলো সংখ্যা কমতে কমতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া কি দেশ জাতির জন্যে কল্যাণের? বাংলাদেশে যদি হিন্দু সম্প্রদায় না থাকে, এ বর্ণাঢ্য বাঙালি সংস্কৃতি, গৌরবময় পুরাতাত্ত্বিক ঐতিহ্যও কি সচল থাকবে? জানি সচল থাকবে না।আমরা চাইনা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি মরুভূমির মত কণ্টকাকীর্ণ হোক। পূর্বের হিন্দু অধ্যুষিত হয়েও প্রায় সম্পূর্ণভাবে হিন্দু সম্প্রদায় শূণ্য হয়ে গেছে আফগানিস্তানে, পাকিস্থানে।আজ আফগানিস্তানের কি অবস্থা, পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকার কি অবস্থা, পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের কি অবস্থা; আমরা প্রতিদিন সংবাদপত্র এবং টেলিভিশনের নিউজে দেখছি। সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের নির্মম অত্যাচার করে তাড়িয়ে যারা দিয়েছে তারা নিজেরাও আজ শান্তিতে নেই। নিজেরা নিজেরা মারামারি করছে।
দেশের আবহমান সংস্কৃতি রক্ষার্থে হিন্দু সম্প্রদায় মানুষদের রক্ষা করা উচিত। যে জাতি সংগীতের মাধ্যমে ঈশ্বরের উপাসনা করে, নৃত্যের মাধ্যমে ঈশ্বরের উপাসনা করে; সর্বোপরি সংস্কৃতির প্রত্যেকটি উপাদানের মাধ্যমে ঈশ্বরের উপাসনা করে। যে জাতি বিশ্বাস করে সর্বভূতে ঈশ্বর বিরাজ করে।পরমাত্মারূপ ব্রহ্ম জগতের সবার মধ্যে বিরাজিত, “সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম”(ছান্দোগ্য উপনিষদ: ৩.১৪.১)।যে জাতি বিশ্বকে শেখায়, "যত্র জীব, তত্র শিব"। অর্থাৎ জগতের ধনী গরিব প্রত্যেকটি জীবের মধ্যেই শিবরূপ পরমেশ্বর বাস। প্রত্যন্ত গ্রামের একটি বেলতলায় যদি কোন পূজা অনুষ্ঠিত হয়, সে পূজাতেও জগতের সকল জীবের কল্যাণ কামনা করা হয়। প্রত্যেকটি জীবের মঙ্গল কামনা করা হয়, মঙ্গল কামনা করে প্রার্থনা করা হয়; জগতের কোন প্রাণী যেন দুঃখভোগ না করে।
সর্ব্বেষাং মঙ্গলং ভূয়াৎ সর্বেসন্তু নিরাময়ঃ।
সর্বে ভদ্রাণি পশ্যন্তু মা কশ্চিৎ দুঃখভাগ ভবেৎ ॥
প্রত্যেকটি পূজার আগে আমরা বৈদিক শান্তিমন্ত্র পাঠ করি এবং বেদপাঠের আগে শান্তিমন্ত্র পাঠ করে জগতের সকল জীবের শান্তি কামনা করি। এই বিশ্বাস আমাদের রক্তে, শাশ্বত চেতনায়।শুধু মানুষ নয়, প্রত্যেকটি জীবের আমরা শান্তি, কল্যাণ এবং ঋদ্ধি কামনা করি। এমন একটি সংস্কৃতি নির্ভর শান্তিপ্রিয় সম্প্রদায় যদি এদেশ থেকে ধীরেধীরে লুপ্ত হতে থাকে তবে কি এদেশ এবং ভূখণ্ডের জন্যে তা মঙ্গলজনক?
ইংরেজিতে দুটি শব্দ আছে 'EQUALITY', 'EQUITY'; এ দুটি শব্দের মধ্যে একটি শব্দের অর্থ 'সমতা' এবং অন্যটির অর্থ 'ন্যায্যতা'। সমতার নামে সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘুদের অসম দৌড়ে ফেলে দেয়াটা দুঃখজনক। তাই একটি কল্যাণকর রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুদের প্রয়োজন সমতার সাথে সাথে একটি মানবিক ন্যায্যতা।
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়