“সাম্প্রদায়িকতা” নিয়ে আমাদের উপমহাদেশে বহু আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক, এমনকি যুদ্ধ-বিগ্রহ হয়েছে, এখনো হচ্ছে। বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ভূ-প্রকৃতি, মানুষের মেধা ও সততা, সবকিছুই প্রগতির সহায়ক হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র এই সাম্প্রদায়িকতার কারণেই পিছিয়ে পড়ছে বিশ্বে, প্রগতির প্রতিযোগিতায়।

“সাম্প্রদায়িকতা” হচ্ছে সম্প্রদায়ভিত্তিক চিন্তাভাবনা ও কর্মকাণ্ড। আমি যে সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত সেটি বিশ্বে সবচেয়ে সেরা এবং আর সব সম্প্রদায় নিকৃষ্ট, এ ধারণায় বিশ্বাস স্থাপন। এরপর এ বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে আমার সব কার্যপদ্ধতি পরিচালনা করা। যেহেতু অন্যেরা নিকৃষ্ট সেহেতু তাদের অধিকারও ন্যূনতম। ধনসম্পদ থেকে শুরু করে সামাজিক ও রাজনৈতিক সকল সুযোগ-সুবিধাতে আমার অধিকার সবচেয়ে বেশি। এ বিশ্বাস ও কার্যকলাপের চূড়ান্ত রূপ হচ্ছে অন্যের ওপর চেপে বসা। হয় তারা আমার সম্প্রদায়ভুক্ত হবে নয়তো নিশ্চিহ্ন হবে।

“সাম্প্রদায়িকতা” শব্দটি ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রেই বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে রয়েছে দুটি সম্প্রদায়, একটি আস্তিক যারা স্রষ্টা ও ধর্মীয় আচারে বিশ্বাস করে এবং অন্যটি নাস্তিক যারা এসবে বিশ্বাস করে না। অবশ্য এ দুটোর মাঝামাঝি তৃতীয় আর একটি সম্প্রদায়ের কথা শোনা যায় যারা পুরোপুরি বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কোনোটাই করে না। আস্তিকের মধ্যে রয়েছে আরও কিছু উপবিভাগ। যেমন, মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, ইহুদি ইত্যাদি। অতএব একই রক্তমাংসের মানুষ হলেও নিজস্ব বিদ্যা, বুদ্ধি, সংস্কৃতি, পারিবারিক ঐতিহ্য ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন সম্প্রদায়ভুক্ত হচ্ছে। একমাত্র শিশু ও মানসিক প্রতিবন্ধীরা কোনো সম্প্রদায়ভুক্ত হতে পারে না কারণ সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। সুতরাং প্রত্যেক সুস্থ ও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষই এক অর্থে সাম্প্রদায়িক, কারণ সে যে সম্প্রদায়ভুক্ত তাকে তো শ্রেষ্ঠ মনে করবেই। অবশ্য কিছু মানুষ এ পৃথিবীতে আছে যারা নিজ স্বার্থে ধর্মীয় বিশ্বাস পাল্টায় অথবা ভান করে।

“সাম্প্রদায়িকতা” শব্দের সংজ্ঞায় প্রথম অংশ হচ্ছে নিজের সম্প্রদায়কে শ্রেষ্ঠ মনে করা। কিন্তু দ্বিতীয় অংশ হচ্ছে, এ বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে সব কার্যকলাপ পরিচালনা করা অর্থাৎ অন্যের ওপর আমার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করা। আমি বড় বলে, আমার চারপাশে ছোট কেউ থাকতে পারবে না অথবা থাকলেও আমার পদতলে থাকবে, এটি একেবারেই ঠিক না। বড় প্রাণী যেমন ছোট প্রাণীকে খেয়ে ফেলে সে রকম বড় মানুষ যদি ছোট মানুষকে খেয়ে ফেলতে চায় তবে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব কোথায়? মানুষ পশুর চেয়ে শ্রেয় কারণ তার বুদ্ধি ও বিবেক রয়েছে যা দিয়ে সে বিজ্ঞান ও সভ্যতার উন্নয়ন সাধন করে। মানুষ শ্রেষ্ঠ বলেই একটি সমাজে বাস করতে চায় যেখানে বিভিন্ন বিশ্বাস ও সম্প্রদায়ের মানুষ তো থাকবেই। আমার বিশ্বাস শ্রেষ্ঠ হলেও তা পেশিশক্তি নয়, বরং যুক্তি দিয়ে অন্যের কাছে প্রচার করতে পারি প্রয়োজন হলে। এরূপ বুদ্ধিদীপ্ত যুক্তিতর্কে অন্যের বিশ্বাস পাল্টে যেতে পারে, এমনকি আমারটাও পাল্টাতে পারে। যদি কারওটাই না পাল্টায় তবুও ক্ষতি নেই। নিজ নিজ বিশ্বাস নিয়ে পারস্পরিক সহাবস্থানই মানবসভ্যতার মূল কথা।

পৃথিবীর সকল মানুষ যদি একই বিশ্বাস ধারণ করে, তবে তো সভ্যতা থমকে যাবে। প্রকৃতি সৃষ্টি করেছে মানুষের মাঝে নানা বৈচিত্র্য। এ বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না। বরং এ বৈচিত্র্যের যথোপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমেই উন্নতি ও প্রগতি সাধন সম্ভব। নানা বিশ্বাস ও সম্প্রদায়ের মাঝে সৌহার্দ্য বজায় না থাকলে ধ্বংস অনিবার্য। প্রত্যেক ধর্মেই ধর্ম প্রচারের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, কিন্তু কোথাও সহিংসতার মাধ্যমে এ কাজ করতে বলা হয়নি। নানা ধর্ম ও বিশ্বাসের অস্তিত্ব সব ধর্মেই স্বীকার করা হয়েছে। মৃত্যুর পর কে স্বর্গে যাবে আর কে নরকে যাবে সেটি ভিন্ন প্রশ্ন, কিন্তু এ পৃথিবীতে সকলেরই নিজ অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। শুধুমাত্র আত্মরক্ষার জন্য পেশিশক্তির ব্যবহার অনুমোদিত হয়েছে। সমাজে কেউ যদি আগে বাড়িয়ে অন্যের ওপর আক্রমণ না করে তবে তো কোনো হিংসা, বিদ্রোহ বা যুদ্ধ থাকতে পারে না।

“সাম্প্রদায়িকতা” নামক ব্যাধিটি শুধুমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রেই নয়, অন্য সকল ক্ষেত্রেও আমাদের নিয়মিত আক্রমণ করে চলেছে। আগেই বলেছি, প্রতিটি মানুষ পেশাগত, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে কোনো না কোনো সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। যেমন, ‘ছাত্র’ একটি সম্প্রদায়; এ সম্প্রদায়ের হয়ে অছাত্র জনতার ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পাই। প্রকৌশলী ও চিকিৎসকের মধ্যে সংঘাত রয়েছে। সরকারি প্রশাসনিক ক্যাডারের সঙ্গে অন্য ক্যাডারের দ্বন্দ্ব নিয়মিত ঘটনা। রাজনৈতিক সংঘাত তো ভয়ংকর। এরপর রয়েছে জাতি ও বর্ণগত সাম্প্রদায়িকতা। উন্নত বিশ্বে এরূপ বর্ণ ও জাতিগত বৈষম্য খুবই ভয়াবহ আকারে বিরাজ করছে, কিন্তু তারা কখনোই এসব বৈষম্যের কথা আমাদের জানতে দেয় না, বরং আমাদের মাঝে আরও নানা বিভেদ তৈরি করে তারা ফায়দা লোটে। ভারত উপমহাদেশে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ব্রিটিশদের সৃষ্টি। তারা তাদের স্বার্থে আমাদের লেলিয়ে দিয়েছে একে অন্যের বিরুদ্ধে, যার কুফল আজও আমরা ভোগ করছি এবং আরও যুগ যুগ হয়তো বয়ে বেড়াতে হবে।

অতএব যখনই সম্প্রদায় নিয়ে আমাদের ভাবনা আমাদের অবিবেচক করে তোলে, আমরা সহিংস হয়ে পড়ি, তখনই “সাম্প্রদায়িকতা” ব্যাধিটি আমাদের পুরো সমাজকে আক্রান্ত করে, ধ্বংস করে। তবে আবার অসাম্প্রদায়িকতার অর্থ সম্প্রদায়হীনতা নয় বরং সম্প্রদায় নিরপেক্ষতা। অনেকে অসাম্প্রদায়িকতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ধর্মহীনতার পক্ষে যুক্তি দিয়ে থাকে। কতিপয় তথাকথিত প্রগতিশীলজন অনেক সময় ধর্মকে কটাক্ষ করে থাকে এবং প্রকারান্তরে নিজেকেই সাম্প্রদায়িক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। কারণ সেও একটি সম্প্রদায়ের পক্ষ নিয়ে অন্য সম্প্রদায়ের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে তৎপর হয়ে উঠে। আমার বিশ্বাস যাই হোক না কেন, তা নিয়ে বিতর্ক করা যেতে পারে, কিন্তু কটাক্ষ করা অবশ্যই অনধিকার চর্চা।

সুতরাং আমরা সকলেই অল্পবিস্তর সাম্প্রদায়িকতা লালন করছি। অসাম্প্রদায়িক হওয়াটা আসলেই সহজ কাজ নয়। যারা অশিক্ষিত ও দরিদ্র তারা বোধকরি বেশি অসাম্প্রদায়িক, কারণ তাদের স্বার্থচিন্তা ততটা প্রকট নয়। অল্পতে যারা তুষ্ট থাকে তারা কখনো অন্যের ওপর চড়াও হয় না সহজে। বিত্তবানেরাই ধর্ম, রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয় সকলের মাঝে নিজের স্বার্থে। আর শাসকগোষ্ঠী তো চিরকালই শোষকের ভূমিকা পালন করেছে, কখনো সেবক হতে পারেনি। তাই সাম্প্রদায়িকতা তাদের কাছে এক মোক্ষম অস্ত্র। এ অস্ত্রের ব্যবহার আমরা যুগে যুগে দেশে দেশে দেখেছি, এখনো দেখছি।

বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িকতার এক স্বর্ণসময় আমরা প্রত্যক্ষ করেছি মুক্তিযুদ্ধে। সকল ধর্মের, সকল বর্ণের, সকল পেশার মানুষ এক জোট হয়ে আন্দোলন করেছে, যুদ্ধ করেছে। তখন ধর্মীয় ভেদাভেদ ছিল না, আবার ধর্মহীনতাও ছিল না। একজন মানুষের প্রতি অন্য মানুষের এমন মমতা ও ভালোবাসা আর কখনো দেখা যায়নি। যুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশেও আমরা চেয়েছি সেরকম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। সকল পেশা ও ধর্মের মানুষ যদি এক হয়ে কাজ না করতে পারি তবে এ দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়।

লেখক: ড. মো. নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক, ফার্মিংডেল, যুক্তরাষ্ট্র